ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

ভাস্কর নভেরা আহমেদ ॥ প্রয়াণের সাত বছর

প্রকাশিত: ২০:৪৯, ১১ মে ২০২২

ভাস্কর নভেরা আহমেদ ॥ প্রয়াণের সাত বছর

ভাস্কর নভেরা আহমেদ ও হামিদুর রহমান শহীদ মিনারের কাজ শুরু করেছিলেন উনিশ শ’ সাতষট্টি সালে। শহীদ মিনারের জন্য অনেক মডেল জমা পড়লেও নভেরা-হামিদের ডিজাইনটিই নির্বাচিত হয়। প্রায় এক মাস খেটে দুজনে ডিজাইনটি তৈরি করেছিলেন। সাতান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। কাজ চলে আটান্ন সাল পর্যন্ত। কিন্তু শেষ হওয়ার আগেই মার্শাল ল জারি হওয়ায় শহীদ মিনারের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ভীষণ ভেঙ্গে পড়েছিলেন নভেরা। এরপর আটান্ন সালের শেষ দিকে তিনি এয়ারপোর্ট রোডে এম আর খান নামে এক ব্যবসায়ীর বাড়ির সামনে একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। উনিশ শ’ ঊনষাট সালে পাকিস্তান ইউনাইটেড এ্যাসোসিয়েশনের আর্থিক সহায়তায় একটি একক ভাস্কর্য প্রদর্শনী করেছিলেন নভেরা আহমেদ। নভেরা আহমেদের আগে জন্ম নেয়া মেক্সিকান শিল্পী ফ্রিদা কাহ্লোকে শুধু মেক্সিকো বা লাতিন আমেরিকা নয়, গোটা পৃথিবীর শিল্পপ্রেমীরা চেনেন। আমাদের নভেরাকে আমাদেরই চিনে নিতে হয় কষ্ট করে। প্রবীণ শিল্পীদের বাইরে তার যতটুকু পরিচিতি তা সম্ভবত কথাসাহিত্যিক হাসনাত আব্দুল হাইয়ের ‘নভেরা’ উপন্যাসের সুবাদে। ফ্রিদার ঘটনাবহুল জীবন নিয়ে লেখালেখি হয়েছে। হলিউডে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, যাতে শিল্পী ও ব্যক্তি ফ্রিদা সমানভাবে উপস্থাপিত হয়েছেন। ব্যক্তি জীবনে নিজের চেয়ে দ্বিগুণ বয়সী লাতিন শিল্পী ও কমিউনিস্ট নেতা দিয়েগো রিভেরার সঙ্গে প্রেম ও বিয়ে, বিয়ের ক’বছর পর স্বামীর বন্ধু এবং বলশেভিক বিপ্লবে লেনিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী, পরে মেক্সিকোয় নির্বাসিত কমিউনিস্ট নেতা লিও ট্রটস্কির সঙ্গে প্রেম, সমকামিতা ইত্যাদির জন্য আলোচিত হয়েছেন কিন্তু শিল্পী ফ্রিদা তাতে উপেক্ষিত হননি। আমাদের এখানে শিল্পী নভেরার চেয়ে ব্যক্তি নভেরাই আলোচিত হয়েছেন বেশি। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের মতো অভিনব কাজের মূল নক্সাবিদ হিসেবে অনেকেই তাকে চেনেন না। শহীদ মিনার তো শুধু একটি ভাস্কর্য নয়, আমাদের জাতীয় চেতনার অন্যতম স্মারক। সে হিসেবে সাধারণের মধ্যে তার আরও বেশি পরিচিতি থাকার কথা ছিল। ভাস্কর্যে যে আধুনিকতা তিনি এনেছিলেন তার সঙ্গে এদেশের পরিচয় সেই প্রথম। সম্ভবত এ উপমহাদেশেরও। পাকিস্তানে প্রথম যে শিল্পীর একক ভাস্কর্য প্রদর্শনী হয়েছিল তিনি নভেরা আহমেদ। শিল্প বিষয়ে পড়াশোনার মূল পর্ব পাশ্চাত্যে হলেও কাজ করেছেন দেশীয় উপাদানে। পড়াশোনা শেষে দেশে কাজ করবেন বলেই ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু দেশ তাকে ধরে রাখতে পারেনি। চারুকলা ইনস্টিটিউটের একজন শিক্ষক এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, ‘নভেরা আহমেদ দেশে থাকতেই ভাস্কর্য বিভাগ খোলা সম্ভব ছিল। সেটা করলে খুব ভাল হতো। তাহলে হয়ত তাকে ধরে রাখা যেত। কিন্তু বিভাগটি খোলা হয় তিনি চলে যাওয়ার এক-দেড় বছর পর।’ একে হয়ত অবহেলার চেয়ে আরও বেশি কিছু বলা যায়। নভেরার সমসাময়িক শিল্পীদের অনেকেই এখন বেঁচে নেই। সমসাময়িক না হলেও শিল্পী হাশেম খান অগ্রজ এ শিল্পী এবং শহীদ মিনারে তাকে ও শিল্পী হামিদুর রহমানকে কাজ করতে দেখেছেন। তার সম্পর্কে জানতে চাইলে স্মৃতি হাতড়ে শিল্পী হাশেম খান বললেন, ‘যদ্দুর মনে পড়ে, নভেরা আহমেদকে আমি প্রথম দেখি ১৯৫৬ সালে ঢাকায়। আমি তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। শহীদ মিনার তখন দাঁড়িয়ে গেছে। শিল্পী হামিদুর রহমানও তখন ঢাকায়। আমরা দলবেঁধে দেখতে যেতাম। আগেই শুনেছিলাম নভেরা আহমেদ শহীদ মিনারের ওপরের চত্বরে কিছু ভাস্কর্য করেছেন। দুয়েকটা কাগজে সে নক্সার খবরও বেরিয়েছিল। শহীদ মিনারের কাজ শেষে হামিদুর রহমান এবং নভেরা আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরির নিচতলায় দুটো ম্যুরাল করছিলেন। সেখানে এ দুজনকে একসঙ্গে কাজ করতে দেখেছি। নভেরা আহমেদ মাঝেমধ্যে আমাদের ক্যাম্পাসে যেতেন। অপূর্ব সুন্দরী ছিলেন। পোশাক-আশাকে এত আধুনিক ছিলেন যা সে সময়ের ঢাকা শহরে দেখা যেত না। কালো রঙের শাড়ি পরতেন, গলায় থাকত নানা রকম রঙিন মালা। শহীদ মিনারের নিচে পূর্ব-দক্ষিণ দিক ঘিরে একটি গ্যালারি ছিল। কথা ছিল ওখানে একটি লাইব্রেরিও হবে। দেয়ালে থাকবে শহীদদের প্রতি নিবেদিত এবং বাংলাভাষা বিষয়ক কিছু ম্যুরাল। হামিদুর রহমান অনেক ম্যুরাল করেও ফেলেছিলেন। তখনই শুনেছিলাম মূল নক্সা অনুযায়ী যেমন শহীদ মিনার শেষ করতে পারেননি, তেমনি ম্যুরালগুলোও শেষ করতে পারেননি। সে সময় কিংবা তার পরপরই নভেরা আহমেদ রেঙ্গুনে একটি প্রদর্শনী করেছিলেন এবং তা যথেষ্ট প্রশংসা পেয়েছিল। একজন শিল্পী হিসেবে তিনি সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়েছিলেন। উন্নত দেশের আধুনিক ধারার ভাস্কর্যের সঙ্গে পরিচয় ছিল নভেরার এবং সে ধারার সঙ্গে নিজের কাজ যুক্ত করে দেশীয় একটি ঘরানা তৈরি করেছিলেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি, পাবলিক লাইব্রেরি ও চারুকলা চত্বরে তিনি যে ভাস্কর্য করেছিলেন, সেগুলো অযতেœ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল। রাষ্ট্র, সমাজ এমনকি শিল্পীরাও তার ভাস্কর্যকে অবহেলা করেছেন, যেজন্য এ অপূর্ব ভাস্কর্যের অনেকটাই প্রায় পুরো নষ্ট হয়েছে। কিছু কিছু ভাস্কর্যের অংশবিশেষ নষ্ট হয়েছে। দীর্ঘদিন পর গত শতকের নব্বই দশকে নভেরা আহমেদের ভাস্কর্য, শহীদ মিনারের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা ইত্যাদি আবার গুরুত্ব পেতে থাকে। শিল্পকলা একাডেমি ও জাদুঘর নভেরার ভাস্কর্য সংরক্ষণে বেশ উদ্যোগ নেয়। পাবলিক লাইব্রেরির সামনে ভাস্কর্যগুলো সংরক্ষণ করে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। জাদুঘর কর্তৃপক্ষ তখন নভেরা আহমেদের একটি প্রদর্শনীও করেছিল। তাকে সম্মানিত করতে একুশে পদকও দেয়া হয় সে সময়। তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্যারিসে বিশেষ দূতও পাঠিয়েছিলেন নভেরাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে, কিন্তু তিনি আসেননি। ভাস্কর্য বিষয়ে পড়াশোনা করতে তিনি লন্ডন যান উনিশ শ’ একান্ন সালে। সেখানেই শিল্পী জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে তার প্রথম পরিচয়। ভাস্কর্যের ওপর তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শুরুও সেখানে। লন্ডনের ক্যাম্বারওয়েল আর্ট স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন উনিশ শ’ বায়ান্ন সালের জানুয়ারি মাসে। সেখানেই শিল্পী হামিদুর রহমানের সঙ্গে পরিচয় ও বন্ধুত্ব। হামিদুর রহমান বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন তাকে। দুজনের মধ্যে চমৎকার বোঝাপড়ার জন্য তাদের যৌথ কাজগুলোও অপূর্ব হয়ে ওঠে। উনিশ শ’ ঊনষাট কিংবা ষাটে নভেরা লাহোর চলে যান। একষট্টি সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ‘ন্যাশনাল এক্সিবিশন অব পেইন্টিং স্কাল্পচার এ্যান্ড গ্রাফিক আর্টস নামে এটি প্রদর্শনীতে তার ছয়টি ভাস্কর্য স্থান পেয়েছিল। প্রদর্শনীতে ‘চাইল্ড ফিলোসফার’ নামে তার একটি ভাস্কর্য ‘বেস্ট স্কাল্পচার’ পুরস্কার পায়। নভেরার সে পুরস্কার শুধু নারী ভাস্কর হিসেবে নয়, শিল্পকর্ম হিসেবে ভাস্কর্যের প্রথম স্বীকৃতি ছিল। এর আগে পশ্চিম পাকিস্তানে ভাস্কর্য করার ওপর এক ধরনের অলিখিত নিষেধাজ্ঞা ছিল। লাহোরে কয়েক বছর থাকার পর নভেরা চলে যান বোম্বেতে। সেখানে ইসমত চুগতাইর বাড়িতে কিছুদিন ছিলেন। বোম্বে থেকে প্যারিসে তারপর আবার গিয়েছিলেন লাহোরে। বেশিদিন থাকেননি। বিভিন্ন দেশ ঘুরে শেষে প্যারিসেই স্থায়ী হন। সম্ভবত ১৯৮৮ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় একটি পা হারান। সে সময় খুব অর্থকষ্টেও নাকি ছিলেন। তাকে শেষ দেখেছেন নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় সফরে ফ্রান্সে গিয়ে। সে অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওনাকে শুধু দেখেছি, কথা হয়নি। বয়স হয়েছে। ভাস্কর্য করাও ছেড়ে দিয়েছেন। নভেরা আহমেদ সম্পর্কে কল্পনায় অনেক কিছু ছিল কিন্তু তখন তিনি একজন সাদামাটা বয়স্ক নারী।’ সেই পঞ্চাশের দশকে যখন এ দেশে শিল্পকলার প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা হাঁটি হাঁটি পা পা করছে, সে সময় একজন নারীর ভাস্কর হিসেবে বিকশিত হওয়া সহজ কথা নয়। তার ভাস্কর্য দেখলে, তার জীবন সম্পর্কে কৌতূহল জাগবেই। ছয় মে তাঁর প্রয়াণের সাত বছর পুরো হলো। চলে গেছেন কিন্তু তার ভাস্কর্যগুলো চিরকাল বলে যাবে, সময়ের চেয়ে অগ্রগামী এক শিল্পী জন্মেছিলেন, তার নাম নভেরা। তিনি ছিলেন... আছেন... থাকবেন... শিল্পীর মৃত্যু নেই।
×