ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পণ্যবাজারে অস্থিরতা কমবে, নিশ্চিত হবে ন্যায্যমূল্য শুরুতে পণ্য তালিকায় থাকছে সোনা, ক্রুড অয়েল ও কটন

চালু হচ্ছে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ

প্রকাশিত: ২৩:১০, ১০ মে ২০২২

চালু হচ্ছে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ

অপূর্ব কুমার ॥ পণ্য-বাজারের অস্থিরতা কমানো এবং নায্যমূল্য নিশ্চিতে দেশে প্রথমবারের মতো প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ। ১৭ কোটি মানুষের বিশাল বাজারের পণ্যের চাহিদা মেটাতে চলতি বছরেই চালু হবে এক্সচেঞ্জটি। প্রাথমিকভাবে সোনা, ক্রুড ওয়েল এবং কটনের কেনাবেচা হবে। এক্সচেঞ্জের ভার্চুয়াল প্ল্যাটফরমে কেনাবেচা হওয়ায় বিশ্ব ক্রেতা-বিক্রেতার সম্মিলন ঘটাবে। বাংলাদেশ ছাড়া সার্কভুক্ত সব দেশেই রয়েছে এই ধরনের এক্সচেঞ্জ। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও রয়েছে কয়েকটি এক্সচেঞ্জ। বাংলাদেশে এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠায় কারিগরি এবং পরামর্শক সব ধরনের সহায়তা করছে ভারত। জানা গেছে, পণ্যের বাজারে ক্রেতা-ভোক্তা পর্যায়ে ভারসাম্য রাখতে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জকে (সিএসই) কমোডিটি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠায় অনুমোদন দিয়েছে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এই কাজে সিএসইকে কারিগরি সহায়তা দেবে ভারত মাল্টি কমোডিটি এক্সচেঞ্জ। এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠায় সংস্থা দুটির মধ্যে ভার্চুয়ালি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। এই বিষয়ে সিএসইর ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম ফারুক বলেন, চলতি বছরেই এক্সচেঞ্জটি চালু হবে। শুরুতে সোনা, ক্রুড ওয়েল এবং কটন থাকছে পণ্য তালিকায়। ক্যাশ অন ননডেলিভারি আইটেমের লেনদেন হবে এক্সচেঞ্জটিতে। ভারতের প্রতিনিধি দল দ্রুত বাংলাদেশে এসে এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠায় কারিগরিসহ সব ধরনের সহযোগিতা দেবে। গোলাম ফারুক আরও বলেন, বাংলাদেশে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালানোর অভিজ্ঞতা কারও নেই। তবে বৃহৎ বাজার বিবেচনায় বাংলাদেশে একটি কমোডিটি এক্সচেঞ্জের সম্ভাবনা অনেক। বাংলাদেশ যেমন অনেক পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করে ঠিক আবার অনেক পণ্য রফতানিও করে। এসব আমদানি-রফতানির প্রায় পুরোটা ক্রেতা-বিক্রেতার সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে হয়ে থাকে। কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালু হলে বিশ্বের আগ্রহী সব ক্রেতা-বিক্রেতাকে ভার্চুয়াল মাধ্যমে যুক্ত হয়ে পণ্য কেনাবেচার সুযোগ করে দেবে। এতে পণ্যমূল্যে ভারসাম্য নিশ্চিতের সুযোগ বাড়বে। কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালুর বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এমপি বলেন, কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালুর সিদ্ধান্তটি খুবই সময়োপযোগী। সম্প্রতি পণ্য-মূল্যের যে বড় ধরনের উঠা-নামা দেখা যাচ্ছে, তাতে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালুর প্রয়োজনীয়তা নতুনভাবে অনুভূত হচ্ছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়নের যাত্রায় কমোডিটি এক্সচেঞ্জ একটি বড় পদক্ষেপ। বিএসইসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেন, কমোডিটি এক্সচেঞ্জ দেশের অর্থনীতিকে পরবর্তী ধাপে নিয়ে যেতে সহায়তা করবে। তিনি বলেন, কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালু হলে কৃষক ও উৎপাদকরা তাদের পণ্যের উপযুক্ত মূল্য পাবেন। বাজারে অস্থিরতা কমে আসবে। তিনি আরও বলেন, এই এক্সচেঞ্জ চালু হলে দেশে পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নত হবে, কোল্ড স্টোরেজ সুবিধা বাড়বে। সব মিলিয়ে পণ্য বাজারে উন্নয়নে এক নতুন মাত্রা যোগ হবে। বাংলাদেশের কমোডিটি এক্সচেঞ্জ নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী বলেন, বাংলাদেশে একটি কমোডিটি এক্সচেঞ্জের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। একটি কার্যকর কমোডিটি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশর অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন গতির সঞ্চার করবে। তিনি বলেন, এই এক্সচেঞ্জ কোল্ড স্টোরেজ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন এবং পণ্যের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ যে গতিতে এগোচ্ছে, তাতে অচিরেই এদেশ এই অঞ্চলের সিঙ্গাপুরে পরিণত হবে। আর এই যাত্রায় একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ হবে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ। কমোডিটি এক্সচেঞ্জ কি? এটা অনেকটা স্টক এক্সচেঞ্জের শেয়ার কেনাবেচার মতো। স্টক এক্সচেঞ্জের মতো কোম্পানি শেয়ার বিক্রি করে মূলধন সংগ্রহ করে ঠিক একইভাবে কমোডিটি এক্সচেঞ্জে শেয়ার নয়, পণ্য কেনাবেচা হয়। তবে এই পণ্য কেনাবেচা সাধারণ পাইকারি বাজারের মতো নয়। মোকামে ক্রেতা-বিক্রেতা দরদাম করে পণ্য কেনাবেচা করেন। কিন্তু কমোডিটি এক্সচেঞ্জে ক্রেতা-বিক্রেতা সরাসরি পণ্য কেনাবেচার সুযোগ নেই। অনেকটা শেয়ারের মতো বিক্রেতার দেয়া পণ্যের সার্টিফিকেট বিক্রি হয়। শেয়ারবাজারের মতো কমোডিটি এক্সচেঞ্জেও নির্দিষ্ট ও অনুমোদিত ব্রোকারের মাধ্যমে পণ্য কেনাবেচা করতে হয়। নিজের বা প্রতিষ্ঠানের নামে এ্যাকাউন্ট থাকতে হয়। সবকিছুই শেয়ারবাজারের মতো। তবে এই বাজারে পণ্য কিনে তা ডেলিভারি না নিয়ে ক্রয়কৃত সার্টিফিকেট অন্য কারও কাছে বিক্রি করা হয়। অনেকটা মিলগেটে অর্ডার বা ডিও কেনাবেচার মতো। কমোডিটি এক্সচেঞ্জের প্রয়োজনীয়তা ॥ বড় পাইকারি বাজারের মতো বাংলাদেশে কমোডিটি এক্সচেঞ্জের প্রয়োজন রয়েছে। এই বাজারটি বিপুল ক্রেতা-বিক্রেতার সম্মিলন ঘটাতে পারে। বর্তমান অনলাইন ব্যবস্থায় ভার্চুয়ালি ক্রেতা-বিক্রেতা অংশগ্রহণ করে বিশ্বের যেকোন প্রান্ত থেকে উৎপাদক তার পণ্য বিশ্বের অন্য যেকোন বাজারে বিক্রি করতে পারেন। এতে পণ্যের ভাল দাম পাওয়ার আশাও রয়েছে। এতে বিশ্বব্যাপী বা নির্দিষ্ট অঞ্চলে পণ্যের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করে। পণ্যের ভারসাম্য তৈরিতেও সহায়তা করে। কারণ কমোডিটি বাজারের কারণে কোন এলাকার অতিরিক্ত উৎপাদন এবং ঘাটতি এলাকায় যেতে পারে। কিভাবে নিশ্চিত হয় গুণগত মান? এ ধরনের বাজারে যেহেতু ক্রেতা-বিক্রেতার সরাসরি পণ্য দেখে বা দেখিয়ে কেনাবেচার সুযোগ নেই, তাই কমোডিটি এক্সচেঞ্জই পণ্যের গুণগতমান নিশ্চিতের নানা ব্যবস্থা করে থাকে। অর্থাৎ পণ্য নির্দিষ্ট ওয়ারহাউসে গুদামজাত করার সময়ই মান নির্দিষ্ট করা হয়। কোয়ালিটি কন্ট্রোল কর্মকর্তারা পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করে দেন। কেনাবেচার প্রক্রিয়া ॥ কেনাবেচার প্রাথমিক প্রক্রিয়া শেয়ার কেনাবেচার মতো। ব্রোকারের মাধ্যমে বিক্রেতারা পণ্য বিক্রির আদেশ দেন। উল্টোদিকে ক্রেতারা তার ব্রোকারের মাধ্যমে কেনার আদেশ দেন। বর্তমানের অনলাইন ব্যবস্থায় উভয়ের কেনাবেচার অর্ডার প্রদর্শিত হয় কমোডিটি এক্সচেঞ্জের ইলেকট্রনিক বা অনলাইন প্ল্যাটফরমে। ক্রেতা-বিক্রেতার দর মিললে লেনদেন হয়। তবে লেনদেন নিষ্পত্তি হয় ক্লিয়ারিং এ্যান্ড সেটেলমেন্ট হাউসের মাধ্যমে। প্রথমে ক্যাশ সেটেলমেন্ট অর্থাৎ ক্রেতার ব্রোকার থেকে অর্থ দিয়ে বিক্রেতার ব্রোকার এ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়। এরপর চুক্তি অনুযায়ী ফিজিক্যাল ডেলিভারি সম্পন্ন করতে পণ্যটি ওয়ারহাউস বা কোল্ড স্টোরেজে রয়েছে, ক্রেতার অর্ডার অনুযায়ী পণ্য জাহাজীকরণ করতে বলা হয়। আবার পণ্য বিদ্যমান না থাকার পরও ওই পণ্য কেনাবেচা করা যায় কমোডিটি এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে। কমোডিটি এক্সচেঞ্জের বাজারের অংশকে ফিউচার কন্ট্রাক্ট বলা হয়। যেমন মৌসুমি ফল আম বা অন্য ধরনের ফল যা সারা বছর হয় না। চাইলে কোন বিক্রেতা এই বাজারের মাধ্যমে ফলটির বিক্রির অগ্রিম আদেশ দিতে পারে। আবার কোন ক্রেতা চাইলে ফলটি কিনেও নিতে পারেন। এই পণ্য এক মাস বা দুই মাস পরে ডেলিভারি নিতে পারে। শুধু মৌসুমি ফল নয় যেকোন ধরনের পণ্যের ফিউচার কন্ট্রাক্ট হতে পারে।
×