ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

স্বপ্নের পদ্মা সেতু পারাপারে

প্রকাশিত: ২১:১৩, ২৬ এপ্রিল ২০২২

স্বপ্নের পদ্মা সেতু পারাপারে

বাংলাদেশ উন্নয়নের অভিযাত্রায় হরেক রকম প্রকল্পে জোর কদমে এগিয়ে চলেছে। বিশেষ করে পদ্মা সেতুর মতো অভাবনীয় মেগা প্রকল্প দৃষ্টিনন্দনভাবে তার কাক্সিক্ষত ডানা মেলছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ়প্রত্যয়ে যেভাবে এই পদ্মা সেতু নির্মাণে উদ্যোগ গ্রহণ ও সফল বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছেন তা এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। একইভাবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা এবং প্রধানমন্ত্রীর আধুনিক ও প্রযুক্তির দেশ গড়ার মহাকর্মযোগও। হরেক রকম বাদ-প্রতিবাদ আর অপবাদের ঝক্কি সামলানোর পর পদ্মা সেতুর নির্মাণ যাত্রা শুরু হয় ২০১৪ সালে। চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড এই বৃহত্তর সেতু নির্মাণের গুরুদায়িত্ব পালন করে। ২০১৪ সালের ১৭ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে পদ্মা সেতু নির্মাণের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় বাংলাদেশ সরকার ও চীনা চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানির সঙ্গে। ৬.১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং ১৮.১০ মিটার (৫৯.৪ ফুট) প্রস্থের এই সেতু নির্মাণের মূল উপাদান কংক্রিট এবং স্টিল। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহারে বহুকাক্সিক্ষত সেতুটি আজ দেশের অহঙ্কার। নিজস্ব অর্থায়নে প্রস্তুত করার অদম্য প্রত্যয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে চ্যালেঞ্জ দর্পভরে নিয়েছিলেন সেটা আজ বাস্তবের মাটি ছোঁয়ার অপেক্ষায়। শাবাশ বাংলাদেশ এমন মহিমান্বিত এক কর্ণধারকে সরকারপ্রধানের মর্যাদায় অভিষিক্ত করায়। জিতলেন শুধু নিজে নয়, জিতিয়ে দিলেন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাকেও। ধারণা করা হচ্ছে এই বছরের জুন মাসেই তার নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হলে জুলাই থেকে যান চলাচলে উন্মুক্ত হওয়াও ভবিষ্যত পরিকল্পনা। বাকিটা সময়ই নির্ধারণ করে দেবে। সেতুটি পদ্মা নদীর ওপর নির্মিত বহুমুখী সেতু। এর মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের সঙ্গে উত্তর ও পূর্ব অংশের নিরবচ্ছিন্ন সড়ক ও রেল যোগাযোগ সম্ভব হবে। নদীবিধৌত বাংলাদেশে সড়ক, রেল এবং নৌ কোন যাত্রাপথই সহজ, স্বাভাবিক এবং নিরবচ্ছিন্ন নয়। যানজট, সিডিউল বিপর্যয় এবং ফেরির দুর্ভোগে যাত্রী ভোগান্তি সব সময় দেখা যায়। পদ্মা সেতু চালু হলে শুধু যে সময় বাঁচবে তা নয়, বিভিন্ন জেলার সঙ্গে আবশ্যক নানা কর্মকা-ে গতিও ফিরবে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠবে, অত্যাধুনিক শিল্পায়নে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের শ্রীবৃদ্ধি পাবে। সেটাও হবে এক সম্ভাবনাময় নতুন বাংলাদেশ। পদ্মা সেতু নির্মাণ এবং তার কাক্সিক্ষত বাজেট লক্ষ্যমাত্রাকে কতখানি নিয়মানুগ করবে সেটা নিয়েও বিভিন্ন প্রশ্নের অবতারণা হয়েছে। নিজ অর্থায়ন বলতে বাংলাদেশের অর্থ মন্ত্রণালয়, সেতু মন্ত্রণালয়কে সেতু নির্মাণে বাজেট বরাদ্দ দেয়। পদ্মা সেতু নির্মাণে মোট খরচের পরিমাণ প্রায় ৩০ হাজার ১৯৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা। যে সব খাতে খরচের হিসাব ধরা হয়েছে সেগুলো হলো সেতুর অবকাঠামো তৈরি, নদীশাসন, সংযোগ সড়ক, ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরিবেশ, বেতন ভাতা। দেশের অর্থ বিভাগের সঙ্গে সেতু বিভাগের চুক্তি মোতাবেক সেতু নির্মাণে ২৯ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা ঋণ বরাদ্দ করে সরকার। ১ শতাংশ সুদ হারে ৩৫ বছরের মধ্যে সেতু বিভাগকে এই ঋণ পরিশোধের সীমানা নির্ধারণ করা আছে। তবে নির্মাণের শুরুতেই পাইলিংয়ের সমস্যায় পড়ে এই পরিকল্পিত সেতুটি। পদ্মা নদীর গভীরতায় তলদেশে মাটি খুঁজে পেতেও অনেক বেগ পাওয়ার ঘটনা সংশ্লিষ্টদের উদ্বিগ্ন করে তোলে। নির্মাণকারী প্রকৌশলী ও বিশেষজ্ঞরা নদীর তলদেশে মাটি না পাওয়ায় কৃত্রিম প্রক্রিয়ায় নতুন মাটি তৈরি করে পিলার গাঁথার চেষ্টা করা হয়। প্রক্রিয়াটি কোনভাবেই সহজসাধ্য ছিল না। এমন পদ্ধতি বিশ্বে আর কোথাও সেভাবে দৃশ্যমান হয়নি। বাংলাদেশও প্রথমবারের মতো এই কৃত্রিম নতুন মাটিতে পিলার গাঁথার চেষ্টা করে। যা শুধু অসম সাহসিকতাই নয় বরং উন্নত প্রযুক্তির সফল ব্যবহারও বটে। কম ধকল আসেনি সেতুটি নির্মাণে। সঙ্গতকারণে পাইলিংয়ের সঙ্গে ছোট ছোট স্টীলের পাইপ ওয়েল্ডিং করে গেঁথে দেয়াও ছিল সে সময়ের এক অভিনব কর্ম পদ্ধতি। নদীর অভ্যন্তরীণ মাটিতে প্রযুক্তির নব পরিকল্পনাগুলো প্রয়োগ করার পর যাচাই-বাছাইয়ে দৃশ্যমান হয়েছে নতুন মাটিতে পাইলিং লোড ধারণে সক্ষম। যেখানে পাইল বসাতে আর ভাবতেও হয়নি। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সুদীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে সেতুতে পিলারের ওপর বসানো হয় প্রথম স্প্যান। এভাবে সময়ের গতিতে ক্রমান্বয়ে একের পর এক স্প্যান বসানো এগিয়ে যেতে থাকে। এক সময় ৪০তম স্প্যান তার যাত্রাকে অনেকখানি দৃশ্যমান করে তোলে সেতুকে সবার সামনে স্পষ্ট করে দেয়। ৪১তম স্প্যান বসানোর পরই পদ্মা সেতুর দৃষ্টিনন্দন অবয়ব আপামর জনগোষ্ঠীকে মুগ্ধতার বিস্ময়ে ভাসিয়ে নেয়। পদ্মা সেতুর বহু প্রত্যাশিত যাত্রাপথ জোরকদমে এগিয়ে যাচ্ছে। সেতুটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের অবহেলিত, পিছিয়ে পড়া এলাকা আধুনিকতার গতি প্রবাহে সার্বিক জনগোষ্ঠী নিজেদের মানোন্নয়নে যে সুযোগ-সুবিধা পাবে সেখানে বহু মানুষের কর্মসংস্থান ছাড়াও দারিদ্র্য বিমোচনসহ আরও বিভিন্ন প্রকার সমৃদ্ধিতে দেশ এগিয়ে যাবে নিরবচ্ছিন্নভাবে। আধুনিক শিল্প বিকাশে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখার কারণে সাধারণ মানুষের জীবনমানও অনন্য উচ্চতায় উঠতে সময় লাগবে না। প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার আমার শহর-আমার গ্রাম এমন যৌক্তিক বার্তায় দেশের অভাবনীয় কল্যাণ সাধন সারাদেশকে একযোগে এগিয়ে নেবে। ধারণা করা হচ্ছে দেশের মোট এলাকার ২৯% অঞ্চল জুড়ে ৩ কোটিরও অধিক জনগণ প্রত্যক্ষভাবে এই সেতুর মাধ্যমে লাভবান হবে। দেশের পরিবহন নেটওয়ার্কই শুধু নয়, বরং আঞ্চলিক অর্থনেতিক উন্নয়নেরও মূল চাবিকাঠি হিসেবে পদ্মা সেতু তার সফলতাকে দৃশ্যমান করে তুলবে। জিডিপি বৃদ্ধির সম্ভাবনাও থাকছে ১.২ শতাংশ। পদ্মা সেতু যে মাত্রায় তার শুভযাত্রা অবারিত করবে সেখানে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠবে সেতুর ওপর টোল নির্ধারণ নিয়ে। টোলের ব্যাপারে মূল সিদ্ধান্ত দেবে সরকার এমন আশা অমূলক নয়। ইতোমধ্যে সেতু পারাপারে টোল নির্ধারণ করেছে সেতু বিভাগ। দেশের অত্যাধুনিক ও নজরকাড়া এই সেতুটি পার হতে বড় অঙ্কের টাকা গুনতে হবে এমনই আভাস পাওয়া যাচ্ছে সেতু বিভাগ থেকে, যা নদীপথের প্রায়ই দেড় গুণের বেশি। তবে সেতু পার হতে যে সময় বাঁচবে সেটাকেও আমলে নিতে হবে। আবার সাধারণ মানুষ যারা এখনও নিম্নবিত্ত তাদের আয় রোজগারের দিকেও নজর দেয়া একান্ত আবশ্যক। তবে বৃহদাকার বাস, ছোট এবং মাইক্রোবাসের টোল নির্ধারণ যদি দেড় গুণ হয় তাহলে তেমন চাপ বর্তাতে পারে অতি সাধারণ যাত্রীদের ওপর। পরিবহন মালিক নিজে সে ব্যয়ভার বহন করবে নাÑ তা চাপিয়ে দেবে নিম্নবিত্তের অসহায় মানুষদের ওপর। যমুনা নদীর ওপর দৃশ্যমান বঙ্গবন্ধু সেতুর টোলেরও নাকি দ্বিগুণ হবে নবনির্মিত পদ্মা সেতুর টোল। নতুন সেতুর ওপর টোল নির্ধারণ হয়েছে বড় বাসের ২৪০০ এবং ট্রাকে ২৮০০। যা ফেরির তুলনায় দেড়গুণ এবং বঙ্গবন্ধু সেতুর তুলনায় ২ গুণ। এখানে আরও উল্লেখ্য, নিজ অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মিত হলেও অর্থ বিভাগ থেকে পাওয়া অর্থ সরকারকে ফেরত দিতে হবে সেতু বিভাগকে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি মোতাবেক। যদিও সেতু বিভাগ একটি স্বায়ত্তশাসিত আলাদা সংস্থা। তবে সেতু মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আভাস দেয়া হয়েছে সরকারের সঙ্গে এই ঋণ পরিশোধ নিয়েও পুনরায় আলাপ-আলোচনা চলতে পারে। স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাকে দেয়া সব ঋণ পরিশোধ নাও করতে হতে পারে। এমন কিছু সিদ্ধান্ত সরকার নিতে পারে যাতে কিছুটা ঋণ লাঘব করা যায়। সব কিছু এখনও বিবেচনাধীন। টোল নির্ধারণ করেছে সেতু বিভাগ। এই আয়ও যাবে সেতু বিভাগের কোষাগারে। আর বিভিন্ন সময়ে ব্যয়ও করতে হবে সেতু বিভাগকেই। সুতরাং শুধু টোল নির্ধারণ নয়, পরিস্থিতি বিবেচনায় আরও কিছু আমলে নিতে হবে অর্থ ও সেতু বিভাগকে। সবচেয়ে সম্ভাবনার দিক হলো পদ্মা সেতু শুধু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল নয়, সারাদেশের সম্প্রসারিত উন্নয়নে যে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে তা নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়কে অনেকখানি এগিয়ে নেবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকারও তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রায় ছুটে চলবে। দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের সঙ্গে দেশের সংশ্লিষ্ট অন্যান্য জেলায় যাতায়াতের যে নতুন গতি প্রবাহ দৃশ্যমান হবে তাতে সময় যেমন কম লাগবে, জ্বালানি খরচও সাশ্রয়ী অবস্থায় পৌঁছাবে। সব মিলিয়ে নতুন দৃশ্যমান এই পদ্মা সেতু বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেও আনবে অপার সম্ভাবনাময় এক বিশ্ব। গ্রাম আর শহরের ব্যবধান ঘুচবে। জীবনমান উন্নয়নের মাইলফলক হবে পদ্মা সেতু। অর্থনীতির দুরন্ত গতিশীলতায় কর্মসংস্থান বাড়ার আধিক্যে সাধারণ মানুষের জীবনকে স্বস্তিদায়ক করে তুলবে। লেখক : সাংবাদিক
×