ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বৈশাখেও বিষণœ মেলা

লোক ঐতিহ্যের নিভু নিভু আলো

প্রকাশিত: ২৩:৩১, ২০ এপ্রিল ২০২২

লোক ঐতিহ্যের নিভু নিভু আলো

মোরসালিন মিজান ॥ বহুবিদ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বিশ্বায়নের যুগে, হ্যাঁ, নতুন অনেক কিছু যোগ হচ্ছে। বিয়োগ হচ্ছে তারও বেশি। বিশেষ করে বাংলার লোক ঐতিহ্য, শেকড়ের সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। বাংলা একাডেমিতে আয়োজিত বৈশাখীমেলায় ঢুকে সেই হারিয়ে যাওয়ার চিত্রটাই বেশি চোখে পড়ছে। গ্রামীণমেলার কোন আবেগ বা উচ্ছ্বাস এখানে নেই। বরং লোক ঐতিহ্যের নিভু নিভু আলো। দেখে মন বিষণœ হয়ে যায়। চৈত্রসংক্রান্তির মেলার কথা আমরা জানি। একসময় এই জনপদে ঘটা করে চৈত্রসংক্রান্তির মেলা আয়োজন করা হতো। একইরকম জনপ্রিয় ছিল বছরের প্রথম দিন আয়োজন করা বৈশাখীমেলা। এসব মেলায় লোক ঐতিহ্যের নানা পণ্যের পসরা নিয়ে বসতেন দোকানিরা। কারিগররা আসতেন। মৃৎশিল্প, বাঁশ বেত শিল্প, সূচিশিল্পসহ গ্রামীণ জীবন ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরে এমন বিচিত্র পণ্য পাওয়া যেত মেলায়। মেলা ঘিরে সব বয়সী মানুষ, আলাদা করে যদি বলি, ছোটরা দারুণ কৌতূহলী ছিল। মেলায় নিয়ে না গেলে শিশু কিশোররা তো নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে দিত। তো, সেসব মেলার স্মৃতি ফেরাতেই রাজধানী শহরে বৈশাখীমেলার আয়োজন করা। কয়েক বছর ধরে বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনে রাজধানীর বাংলা একাডেমিতে এ মেলার আয়োজন করা হয়ে আসছে। করোনা মহামারীর কারণে দুই বছর বন্ধ ছিল। এবার আবার তা আয়োজন করা হলো। বিসিক আয়োজিত মেলা যথারীতি পহেলা বৈশাখ উদ্বোধন করা হয়। ১৪ দিনের আয়োজন এর পর থেকে চলছে। তবে শুরুতেই যে কথাটি বলছিলাম, একটা নিষ্প্রাণ মেলা। একশ’র মতো স্টল। অর্ধেক প্রায় শূন্য পড়ে আছে। বেশিরভাগ স্টলে আবার ঈদের জামা কাপড়। শহুরে উদ্যোক্তারা স্টলে নানা কিছু বিক্রি করছেন। এসবের বাইরে হাতেগোনা কয়েকটি স্টলে লোক ও কারুপণ্য। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে স্বল্প সংখ্যক লোক ও কারুশিল্পী এসেছেন। দু-দশটি পণ্য দিয়ে তাদের স্টল সাজানো। তার চেয়েও কম হচ্ছে বিক্রি। শিল্পী ও কারিগরদের কেউ কেউ স্টলে বসে টুকটাক কাজ করছেন। কেউ আবার ছায়া খুঁজে নিয়ে ঘুমিয়ে সময় কাটাচ্ছেন। মেলায় পাওয়া যাচ্ছে মৃৎশিল্প, শাখা শিল্প, বাঁশ-বেত শিল্প, কাঁসা পিতল শিল্প, শোলাশিল্প, সূচিশিল্পের কিছু নিদর্শন। শতরঞ্জি, কাঠজাতপণ্য পাওয়া যাচ্ছে। আরও কিছু টুকটাক জিনিসপত্র। রাজশাহীর একটি স্টলে আঁকা হচ্ছে শখের হাঁড়ি। স্টলে ঝুলিয়ে রাখা রঙিন হাঁড়িগুলোর দিকে অপনি চোখ চলে যায়। মূল রংটি হলুদ। এর ওপর লাল কালো সাদা সবুজ তুলির আঁচড়। ফুল-লতা-পাতার নক্সা। এক সময় কুটুমবাড়িতে মিষ্টি, পিঠা ইত্যাদি পাঠাতে শখের হাঁড়ি ব্যবহার করা হতো। এখন সেই ব্যবহার অনেক কমে এসেছে। ঐতিহ্যবাহী শখের হাঁড়ি ব্যবহৃত হচ্ছে শোপিস হিসেবে। বিভিন্ন আকারের হাঁড়ি একটির ওপর আরেকটি বসিয়ে চমৎকার সেট তৈরি করা হয়েছে। স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে কথা হয় শিল্পী সঞ্জয় কুমার পালের সঙ্গে। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলছিলেন, এটি তাদের বাবা দাদার পেশা। পরিবারের মোটামুটি সবাই শখের হাঁড়ি তৈরির কাজ করেন। কিন্তু যে পরিমাণ শ্রম ঘাম ও সময় দিতে হয় সে তুলনায় আয় খুব কম। করোনার সময়টাতে ঘরে বসে কাজ করেছেন। কিন্তু বিক্রি হয়েছে সামান্যই। ঢাকার মেলাটিতে বড় আশা নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু এখানেও বিক্রি হচ্ছে না বলে জানান তিনি। মেলায় শাঁখা তৈরি ও বিক্রির কাজ করছেন অনুপ নাগ। কেমন যাচ্ছে সময়? জানতে চাইলে তার কণ্ঠেও দীর্ঘশ্বাস। বলেন, আমাদের আর কী যাবে? সময়টাই তো বদলে যাচ্ছে। ফরাশগঞ্জের বাসায় বসে দিন রাত কাজ করি। বাসা থেকেই অনেকে হাতে পরার শাখা বা মন্দিরের জন্য শঙ্খ কিনে নিয়ে যান। যা বিক্রি হয় তা দিয়ে কোন রকমে সংসার চলে। চালিয়ে নিতে হয়। সারা জীবন শাখা শিল্পের কাজ করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, এখন বয়স হয়েছে। আর কতদিন পারব জানি না। মূল কারিগররা হারিয়ে যাচ্ছে। সেই সুযোগে ভারত থেকে আসা কমদামি জিনিস বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে শিল্পটি অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়তে দেরি হবে না বলে মনে করেন তিনি। মেলার একটি স্টলে পাওয়া যাচ্ছে সোনারগাঁওয়ের বিখ্যাত কাঠের পুতুল। পুতুলগুলোকে প্রাচীন মিসরীয় মমির আদলে অলঙ্কৃত করা হয়েছে। আর হাতি ঘোড়া বাঘ ইত্যাদি প্রাণীর পায়ে জুড়ে দেয়া হয়েছে চাকা। এ কারণে খেলনাগুলো একসময় ছোটদের ভীষণ পছন্দের ছিল। ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন কারিগর আশুতোষ সূত্রধর। এ চর্চা তাদের রক্তের সঙ্গে মিশে আছে। বলছিলেন, আমার বাবা মনিন্দ্র সূত্রধর কাছেই আমার হাতেখড়ি হয়েছিল। বাবা এখন আর নেই। ১৯৮৬ সাল থেকে পুরোদমে কাজ করছি আমি। এখন পাকা হাত। কোন ছাঁচ ব্যবহার করি না। হাতুড়ি বাটাল দিয়ে আস্ত কাঠ কেটে একটি একটি করে পুতুল তৈরি করেন বলে জানান তিনি। স্মৃতি হাতড়ে বলেন, একসময় সোনারগাঁওয়ের বহু ঘরে কাঠের পুতুলের কাজ হতো। এটাই ছিল তাদের মূল পেশা। আমার বাবা সারা বছর নিজ বাড়িতে কাঠের খেলনা তৈরি করতেন। সেগুলো নিয়ে মেলায় যেতেন। আমিও বাবার সঙ্গে গ্রামের বিভিন্ন মেলায় গিয়েছি। তখন তো সারাদেশে মেলা হতো। লাঙ্গলবন্দে কী বিশাল মেলা দেখেছি! ঢাকার ধোলাইখালেও মেলা হতো। বাবা সেখানে দোকান দিতেন। আমিও তার সঙ্গে থাকতাম। এরপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, এখন তো সব প্লাস্টিকের দখলে। কী করা যাবে? সূচিকর্ম করা হাতপাখাও এখন কালেভাদ্রে চোখে পড়ে। স্টলে বসেই এ কাজটি করছেন সোনারগাঁও থেকে আসা বাসন্তী। গোলাকার পাখার মাঝখানে রঙিন সুতোর কাজ। কী যে আকর্ষণীয় দেখতে! তবে বাসন্তীও জানান, বিক্রি কম। সোনারগাঁওয়ে কিছু ঘরে এখনও এ কাজ হয়। তবে শিল্পীর সংখ্যা কমছে শুধু। তিনি নিজে এ কাজটি ভালবেসে করে যাচ্ছেন। চোখ যতদিন ঠিক থাকবে, করবেন। মেলায় যোগ দিয়েছেন একজন পটশিল্পীও। নাম রতন কুমার পাল। জনশূন্য মেলায় বসে ছবি আঁকছেন তিনি। ছবি বিক্রি হচ্ছে না তেমন। তবে আপন মনে এঁকে যাচ্ছেন। তার পটে ফোক মোটিফ। উজ্জ্বল রং। তবুও কেমন যেন এক বিষণœতা এসে ভর করেছে তার পটে। অবশ্য আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু তথ্যও মেলা ঘুরে পাওয়া যাচ্ছে। রুবেলের গল্পটা এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। স্টলে বসে শোলা শিল্পের কাজ করছিলেন এই যুবক। কিন্তু কথা বলে জানা গেল, তিনি শুধু শোলা শিল্প নিয়ে নয়, লোক ও কারুশিল্পের বহুবিধ মাধ্যম নিয়ে কাজ করছেন। জানালেন, তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স মাস্টার্স শেষ করেছেন। তখন থেকেই আগ্রহ ছিল লোক ও কারুশিল্প নিয়ে। সেই আগ্রহ ও ভালবাসা থেকে এখন পুরোদমে কাজ করছেন। কখনও মৃৎশিল্প, কখনও শোলা শিল্প গড়ছেন। লোকচিত্রকলা নিয়ে কাজ করছেন। শাখা শিল্প, ধাতব শিল্প নিয়েও কাজ করতে চান। চাকরির পেছনে হন্যে হয়ে ঘুরার এই যুগে এমন লোক ঐতিহ্যপ্রেমী যুবক নতুন করে আশা জাগান বৈকি।
×