ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এ কে এম এ হামিদ

৪র্থ শিল্প বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শন

প্রকাশিত: ২০:৫৩, ২০ এপ্রিল ২০২২

৪র্থ শিল্প বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শন

মানবসভ্যতার ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া ব্যাপকভিত্তিক মৌলিক পরিবর্তনকে প-িত-দার্শনিকগণ বিপ্লব হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নিত্যনতুন আবিষ্কারের পথ ধরে সভ্যতা এক ধাপ থেকে অন্য ধাপে প্রবেশ করছে। বিজ্ঞান প্রযুক্তির এ বৈপ্লবিক পরিবর্তনে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমিতে পরিবর্তনের প্রবাহ বিদ্যমান। তিনটি শিল্প বিপ্লবে ভর করে মানবসভ্যতা এখন স্মার্ট টেকনোলজি বা ডিজিটাল বিপ্লবে উপনীত। বলা যায়, বিজ্ঞান প্রযুক্তির ক্রমবিকাশের ইতিহাসই সমাজসভ্যতা বিকশিত হওয়ার ইতিহাস তথা শিল্প বিপ্লবের ইতিহাস। শিল্প-কারখানাসমূহে অটোমেশন বা স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় স্বল্প জনবলে দ্রুতগতিতে পণ্য উৎপাদন ও তথ্যপ্রযুক্তির ধারণা ব্যবহার করে কিভাবে বিশ্বব্যাপী ভোক্তা পর্যায়ে সহজে পরিষেবা নিশ্চিত করা যায় সে ধারণা থেকে জার্মানিতে ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের ধারণাগত সূত্রপাত হয়। এ বিপ্লব ইতোমধ্যে ঘটে যাওয়া তিনটি বিপ্লব থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। মূলত ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের বদৌলতে বিশ্বব্যাপী মানুষের জীবনব্যবস্থা ও চিন্তাচেতনার জগতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে। ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের যাত্রার শুরুতেই যান্ত্রিকতার আগ্রাসন থেকে সরে এসে যন্ত্রের সহাবস্থান তৈরি করার উদ্দেশ্যেই ৫ম শিল্পবিপ্লবের কথা ভাবা হচ্ছে। বিশ্ব অর্থনীতি ফোরাম ৫ম শিল্প বিপ্লবকে মানবিক বলছে। ৫ম শিল্প বিপ্লব প্রযুক্তি দিয়ে মানুষের স্থলাভিষিক্ত না করে মানুষের জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করার আশাবাদ ব্যক্ত করছে। ৪র্থ বা ৫ম শিল্প বিপ্লব মূলত প্রযুক্তির নব নব আবিষ্কারের একেকটি অধ্যায় বা ধাপ। ৪র্থ শিল্প বিপ্লব অভিযোজনের চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবেলা যেমন বিশ্বব্যাপী অও ও ওঙঞ টেকনোলজির দক্ষ মানবসম্পদ গুরুত্ব রয়েছে, তেমনি ৫ম শিল্প বিপ্লব ধারণের জন্য মানুষ ও যন্ত্রের সমন্বয় সাধনে মানবসম্পদই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করা হচ্ছে। মানবসম্পদ উন্নয়ন হলো জনরাশির জনসক্ষমতার এমন এক গুণগত পরিবর্তন প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে তারা উৎপাদনক্ষম ও দক্ষ জনশক্তি হিসেবে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ক্রমবর্ধিষ্ণুভাবে প্রয়োগে অবদান রাখতে পারে এবং মানবীয় শক্তি-সামর্থ্যরে সর্বোত্তম ব্যবহারে সক্ষম হয়ে উঠতে পারে। মানবসম্পদের এ ধারণাগত ভাবনা থেকে বলা যায় জনশক্তির গুণগত পরিবর্তনের সূচনা শিশুমন থেকে গড়ে তোলা অত্যাবশ্যক। যার ভিত্তি হতে হবে প্রাথমিক এবং পর্যায়ক্রমে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও সর্বোচ্চ পর্যায়ে। দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছেন, গবহ ধৎব নড়ৎহ রমহড়ৎধহঃ, হড়ঃ ংঃঁঢ়রফ. ঞযবু ধৎব সধফব ংঃঁঢ়রফ নু বফঁপধঃরড়হ. সত্যিই মানুষ অজ্ঞ হয়ে জন্মালেও কখনও মূর্খ হয় না, পারিপার্শ্বিক অবস্থা তার অজ্ঞতাকে ক্রমেই দূর করে দেয়। তবে এ কথা বলা যায়, প্রকৃত বা বাস্তবমুখী শিক্ষার অভাবে মানুষই ক্রমান্বয়ে শিক্ষার দ্বারা মূর্খ হয়ে পড়ে। যে শিক্ষা প্রকৃত অর্থে মানুষের মঙ্গল বয়ে আনে না, বরং ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায় এবং পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে মানুষ নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না। দার্শনিক রাসেল সেই শিক্ষার প্রতি ইঙ্গিত করেই হয়তবা বলেছেন ঞযবু ধৎব সধফব ংঃঁঢ়রফ নু বফঁপধঃরড়হ. বঙ্গবন্ধুর সীমাহীন ত্যাগ ও ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে আমরা কি বার্ট্রান্ড রাসেলের এই উক্তি সত্যে পরিণত করার অপকর্মে নিয়োজিত? দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা বিশ্লেষণে গুণীজনদের এহেন প্রশ্ন উত্থাপন হয়ত অর্থহীন হবে না। কেননা, একটি স্বাধীন দেশের শিক্ষাব্যবস্থার স্বরূপ কি হবে, ১৯৭২ সালেই বঙ্গবন্ধু তাঁর শিক্ষাদর্শনে স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছে। তবে শিক্ষানীতি কার্যকরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তৎপরতায় বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শন এবং বর্তমান সরকার প্রণীত শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে কতটা আন্তরিক তা প্রশ্নবোধক থেকে যায়। কেননা, জাতির পিতার ১৯৭২ সালে প্রদত্ত শিক্ষাদর্শন ও বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রণীত ২০১০ সালের শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া যদি লক্ষ্যমাত্রার ১০ বছর পর শুরু হয় তাহলে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আন্তরিকতা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরেও অপ্রত্যাশিতভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে ঔপনিবেশিক ধ্যান-ধারণার ধারাবাহিকতায় এখনও ‘শিক্ষার জন্য শিক্ষা’ ব্যবস্থা অব্যাহত রয়েছে। সঙ্গত কারণেই প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা একক জাতিসত্তা নির্মাণে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারছে না। বরং লক্ষ্যহীন উচ্চ শিক্ষিত বেকারত্বের হার অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা রাষ্ট্রীয় মেধার অপচয়। অন্যদিকে, রাষ্ট্রীয় আন্তঃক্যাডারের মধ্যে ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির প্রতিযোগিতায় কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি বিশেষায়িত পেশাজীবীদের মাঝে পেশা পরিবর্তনের হিড়িক লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিজ্ঞানের গ্র্যাজুয়েটগণ সমাজ বিজ্ঞানের স্থান দখল করে নিচ্ছেন। ফলে দরিদ্র জনগণের কষ্টার্জিত কোটি কোটি টাকার অপচয়ই হচ্ছে না, বরং সমাজব্যবস্থায় মানবিকতা হ্রাস পেয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে শ্রেণী বৈষম্য। যথার্থ দক্ষতার অভাবে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশের কর্মজীবীরা এদেশ থেকে প্রতিবছর কম পক্ষে ৬ বিলিয়ন ডলার নিয়ে যাচ্ছেন। প্রসঙ্গত, ২য় ও ৩য় শিল্প বিপ্লবকালীনও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা পিছিয়ে থাকায় জাতীয় উন্নয়ন উৎপাদন কার্যক্রম লক্ষ্যে পৌঁছানো বিলম্বিত হয়েছে। একইভাবে ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের প্রাক্কালে আমাদের প্রস্তুতি বিলম্বিত হওয়ার কারণেই দেশ ও জাতি পিছিয়ে পড়ছে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো প্রযুক্তির নব নব আবিষ্কারের অগ্রগমনের ধারাবাহিকতায় সৃষ্ট প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শিক্ষার গুণগত ধারণা অনুধাবন করে শিক্ষাকে জীবনমুখী/কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থায় ঢেলে সাজিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলায় শিক্ষার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য-গন্তব্য কোথায়? কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের মতে, ‘জ্ঞানের প্রয়োগে মানবতার পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ, ব্যক্তির আত্মিক গভীরতার বিকাশ, ব্যক্তি ও সমাজের মেলবন্ধন সৃষ্টি, মানুষ ও প্রকৃতির যোগসূত্র স্থাপন, সাক্ষর ও নিরক্ষরের মাঝে অসামঞ্জস্যতা হ্রাস, ফলপ্রদতার সঙ্গে ব্যক্তির জ্ঞানভিত্তিক কল্পনাশক্তির বিকাশ প্রসারণ, কর্ষণ এবং সৌন্দর্যবোধ চেতনা সৃষ্টি সমৃদ্ধি এবং জীবনে পূর্ণতাপ্রাপ্তিই হলো শিক্ষা।’ কিন্তু স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরেও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্টগণ প্রথাগত ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। তাই মানবসম্পদ উন্নয়নে সনদনির্ভর শিক্ষা জনশক্তির গুণগত উন্নয়ন বা পরিবর্তনে সহায়ক হয়নি। বরং জাতির জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনি পরিস্থিতিতে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সর্বাগ্রে ১৯৭২ সালে দেশের বিশাল জনরাশিকে জনসম্পদে পরিণত করার উদ্যোগ নিয়ে ড. কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিলেন। দেশের প্রথম শিক্ষা কমিশনকে একটি নব্য স্বাধীন দেশের জন্য প্রস্তাবিত শিক্ষানীতির ওপর জাতীয় দিকনির্দেশনা দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ঔপনিবেশিক আমলের শিক্ষার জন্য শিক্ষা নয় বা আজ্ঞাবহ কেরানি তৈরির জন্যও শিক্ষা নয়। আমি চাই আধুনিক জ্ঞান ও কর্মশক্তিতে বলীয়ান শিক্ষা ব্যবস্থা।’ বিশ্বের অন্য কোন নেতা এত স্বল্প শব্দে স্বদেশের শিক্ষানীতির স্বরূপ উন্মোচন করেছেন কি না সেটি জানা যায়নি। এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শন অবশ্যই অনন্য। ৪র্থ শিল্প বিপ্লবকালীনও বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শন সমভাবে প্রযোজ্য। এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শনকে অগ্রাধিকার দিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে মূল শ্রোতধারার শিক্ষায় রূপান্তরের লক্ষ্যে কারিগরি শিক্ষার হার ন্যূনতম ৫০ ভাগে উন্নীতকরণের অগ্রাধিকার দিয়ে যথাযথ পরিকল্পনা ও নির্দেশনা দিয়েছে। বিষয়টি জনগণের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছিল। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা শিক্ষা পরিকল্পনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বঙ্গবন্ধুর সেই শিক্ষাদর্শন অনুধাবনে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যথেষ্ট পারঙ্গমতা দেখাতে পারছে না। বরং মানবসম্পদ তৈরিতে বিশ্ববিদ্যালয়কে মূল কেন্দ্র উল্লেখ করে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় কোন কোন উর্ধতন ব্যক্তি ও শিক্ষক মত প্রকাশ করে যাচ্ছেন। একই প্রক্রিয়ায় শুরু হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় পুরো দেশই যেন ভুগছে বিশ্ববিদ্যালয় জ্বরে। বিশ্বের উন্নয়ন-উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতায় সংশ্লিষ্ট প্রায় সকল কর্মব্যবস্থায় যে কর্মশক্তির (ডড়ৎশভড়ৎপব) প্রয়োজন তার ৯৩ ভাগই আসে সেকেন্ডারি, হায়ার সেকেন্ডারি ও আন্ডার গ্র্যাজুয়েট লেভেল থেকে। আর হায়ার প্রফেশনাল ৬/৭ ভাগ সরবরাহ হয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সে কারণেই উন্নত ধনী দেশসমূহে উচ্চশিক্ষার বিষয়টি সীমিত। আর আমাদের দেশে তার উল্টো। হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট এ্যান্ড হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্টের কোন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা না থাকায় সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থাটি চলছে ‘যখন যেমন তখন তেমন’ দৃষ্টিভঙ্গিতে। যার ফলে জনগণের কষ্টার্জিত অর্থের যেমন সীমাহীন অপচয় ঘটছে, তেমনি মানবসম্পদেরও ঘটছে অপচয়। সৃষ্টি হচ্ছে বেকারত্ব, যা একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশে অব্যাহতভাবে চলতে পারে না বা চলতে দেয়া উচিত নয়। দেশের পাবলিক ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬ লাখ ৪৩ হাজার ৪৬২ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রকৌশল বিভাগে ১ লক্ষ ৯২ হাজার ১৬৫ জন ছাত্র-ছাত্রী ডিগ্রী ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। এর বিপরীতে মধ্যম স্তরের প্রকৌশল শিক্ষায় তথা ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষায় সরকারী মাত্র ৪৯টি পলিটেকনিক ও বেসরকারী ৪০০ পলিটেকনিকে প্রতিবছর সর্বোচ্চ ৯০ হাজার ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হয়। লক্ষণীয় যে, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং-এর চেয়ে দ্বিগুণের বেশি ছাত্র-ছাত্রী ডিগ্রী ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পড়াশোনা করছে। অথচ বঙ্গবন্ধু গঠিত দেশের প্রথম শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী ১ জন ডিগ্রী প্রকৌশলীর বিপরীতে ৫ জন ডিপ্লোমা প্রকৌশলী তৈরি করার কথা। উল্লিখিত তথ্যমতে, বর্তমানে প্রায় ২ লাখ ডিগ্রী ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র-ছাত্রীর বিপরীতে ১০ লাখ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র-ছাত্রী থাকার কথা। জনশক্তি তৈরির পরিকল্পনা না থাকায় দেশের প্রয়োজন না থাকলেও অনানুপাতিকহারে ডিগ্রী ইঞ্জিনিয়ার তৈরির প্রেক্ষিতে একদিকে শত শত কোটি টাকার অপচয় হচ্ছে, অন্যদিকে ব্যয়বহুল প্রকৌশল শিক্ষায় পেশাজীবীগণ স্ব স্ব পেশায় কর্মসংস্থান না হওয়ায় পেশা পরিবর্তন করে সাধারণ পেশায় কাজ করছে। ফলে পুনরায় রাষ্ট্রের শত শত কোটি টাকার অপচয় হচ্ছে। অন্যদিকে সরকারী-বেসরকারী ১৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবিক, বিজ্ঞান, হিসাব বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন বিষয় থেকে উচ্চশিক্ষায় ডিগ্রী নিয়ে লাখ লাখ শিক্ষার্থী চরম বেকারত্বের শিকার হচ্ছে। প্রফেশনাল গ্র্যাজুয়েটদের এই পেশা পরিবর্তনের আত্মঘাতী ব্যবস্থা অব্যাহত রাখলে মানবিক, সমাজবিজ্ঞানের গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে শীঘ্রই চরম হতাশা ও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়ে সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে। এমনকি রাজনীতিতেও আঘাত করতে পারে পেশা পরিবর্তন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক মানসিকতায় গড়ে ওঠা সমাজবাস্তবতায় কাজ ও কাজের মানুষকে ছোট বা কাজের মানুষ হিসেবে ছোট করে দেখার হীনদৃষ্টিভঙ্গির কারণে শিক্ষার্থীদের মাঝে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের এক ধরনের প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যায়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ মূল লক্ষ্য তথা জ্ঞান সৃষ্টি ও উচ্চতর গবেষণা কার্যক্রম থেকে লক্ষ্যচ্যুত হয়ে শুধু সনদনির্ভর লক্ষ্যহীন উচ্চশিক্ষা সার্টিফিকেট বিতরণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। উন্নত বিশ্বে উচ্চতর প্রফেশনাল শিক্ষার হার ৫ থেকে ৭ ভাগ, মধ্যমস্তরের টেকনিক্যাল এডুকেশনে শিক্ষার্থীর হার ৬০ থেকে ৭০ ভাগ এবং হাতেনাতে কাজ করার জন্য ৩৩ ভাগ অক্যুপেশনভিত্তিক ভোকেশনাল শিক্ষার হার নির্ধারণ রয়েছে। ধনী দেশসমূহে এই নীতিতে মানবসম্পদ উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে। অথচ আমরা এর সম্পূর্ণ বিপরীতে চলছি। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শন ‘আধুনিক জ্ঞান ও কর্মশক্তিতে বলীয়ান শিক্ষা ব্যবস্থা’ প্রবর্তনই ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে মানবসম্পদে পরিণত করার একমাত্র পথ এবং বিদ্যমান বহুমাত্রিক সমস্যা সমাধানের উপায়। বঙ্গবন্ধুর উক্ত শিক্ষাদর্শন আলোচনা-পর্যালোচনা করলে সকলের কাছেই প্রতীয়মান হবে যে, এমন শিক্ষা দিতে হবে মানুষ যেন জীবন-জীবিকা উন্নতি-সমৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করতে সক্ষম উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত হয়। চলমান ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর দর্শন অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ। প্রশ্ন হচ্ছে, জাতির পিতার সেই ঐতিহাসিক ও জনগুরুত্বপূর্ণ দর্শন অনুধাবনে কি উর্ধতন শিক্ষা কর্তারা ব্যর্থ হয়েছেন? নাকি বাঙালী জাতিকে তার চূড়ান্ত লক্ষ্য সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ষড়যন্ত্রমূলক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছেন? সরকারের সংশ্লিষ্ট কতিপয় উর্ধতন কর্তাব্যক্তি কি উদ্দেশ্যমূলকভাবে সরকারের উন্নত ও ধনী দেশে রূপান্তরের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছেন? এমনি পরিস্থিতিতে দেশ ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় জ্ঞান ও দক্ষতাভিত্তিক সমাজ ও সমৃদ্ধ জাতি রাষ্ট্র গঠনে জাতির পিতার শিক্ষাদর্শনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ জীবন ও কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনে সচেষ্ট হবে কি? লেখক : উন্নয়ন গবেষক ও সভাপতি, আইডিইবি
×