ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম

দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স

প্রকাশিত: ২০:৫১, ২০ এপ্রিল ২০২২

দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স

দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। এই ঘোষণায় জনগণের বেশ আস্থা কুড়িয়েছিল বর্তমান সরকার। কিন্তু কথাটা যেন কথার কথাই মনে হলো। নির্বাচনের আগে এমন প্রতিশ্রুতি ভোটারের মধ্যে আশা জাগিয়েছিল বটে। যার ফলে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেই ক্ষমতায় আসীন হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সচিবালয়ে গিয়ে জনপ্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছি। আমাদের তৃণমূল পর্যন্ত পৌঁছে দিতে হবে। কেউ দুর্নীতি করলে সঙ্গে সঙ্গে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ প্রধানমস্ত্রী কর্মকর্তাদের উদ্দেশে আরও বলেছিলেন, ‘বেতন-ভাতা এত বেশি বৃদ্ধি করে দিয়েছি, সেক্ষেত্রে আমি মনে করি দুর্নীতি করার প্রয়োজন নেই, যা প্রয়োজন সেটাতো আমরা মেটাচ্ছি। তাহলে কেন সেটা করতে হবে?’ তিনি বলেছিলেন, উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ গড়তে হলে প্রবৃদ্ধি নিয়ে যেতে হবে ১০ শতাংশে। সেজন্য সুশাসনের দরকার। দরকার দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়ে তোলা। প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশের পর আশায় বুক বেঁধেছিলেন অনেকেই। দুর্নীতির মতো ব্যাধি জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছে দেশে সর্বত্র। অথচ মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্থনীতি, সমাজ-সভ্যতা, শিক্ষা ও সরকারী-বেসরকারী প্রশাসনে সুশাসন প্রতিষ্ঠার কথা ছিল। সেখানে দিনে দিনে বেড়েছে দুর্নীতির বিষবৃক্ষ। ঘটে গেছে দুর্নীতির সামাজিকীকরণ। দুর্নীতি ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান আর সরকারী-বেসরকারী প্রশাসনÑএমন কোন জায়গা নেই যেখানে দুর্নীতির শিকড় ছড়ায়নি। ক্ষমতা ও ক্ষমতার বাইরে থাকা সর্বস্তরেই দুর্নীতির ব্যাপকতা। দুর্নীতিপরায়ণ মানসিকতার কাছে গোটা সমাজ যেন বন্দী। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, দুর্নীতির কারণে প্রতি বছর ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা জিডিপি হারাচ্ছে দেশ। এ প্রসঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানের একটি কথা উল্লেখ করতে হয়। তিনি প্রায় বছর তিনেক আগে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো এক চিঠিতে বলেছিলেন, ‘এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতির প্রধান অন্তরায় দুর্নীতি। দুর্নীতি প্রতিরোধ করা গেলে বছরে দেশের আয় ২ শতাংশ বাড়বে।’ নানা সময়ে করা বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী সংস্থার গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে উঠে এসেছে যে, বেশি দুর্নীতি হয়ে থাকে প্রশাসনে। এর মধ্যে সেবা খাতে দুর্নীতির মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। দুর্নীতি সর্বত্রই বিরাজমান এবং এর মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আর ‘ঘুষ না দিলে সেবা পাওয়া যায় না’ এই মাননিসকতা আমাদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। ঘুষ ও দুর্নীতি সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করায় জাতি হিসেবে আমরা আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা হারাচ্ছি। দুর্নীতি প্রতিরোধে সব পর্যায়ে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে। প্রত্যেক নাগরিকের দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মতো মানসিকতা তৈরি করতে হবে। সেবা গ্রহীতা, সেবা প্রদানকারী, সরকারের উর্ধতন কর্মকতাবৃন্দ, প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে দুর্নীতিকে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সরকার, মন্ত্রণালয়, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের দুর্নীতির বিচার নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশে সংবিধানেই রয়েছে যথোপযুক্ত নির্দেশনা। সংবিধানে ৭৭ নং অনুচ্ছেদে ‘ন্যায়পাল’ নিয়োগের বিধান ও দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। দেশে সুশাসন ও জবাবদিহির যথেষ্ট অভাব রয়েছে, যা বলার অপেক্ষা রাখে না। যার ফলে ঘুষ দুর্নীতি অনিয়ম বিশৃঙ্খলা সর্বত্র লেগেই আছে। বিভিন্ন সরকারী, আধাসরকারী, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে জবাবদিহিতা ও সুশাসন যেন উধাও হয়ে গেছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে যার মতো করে লুটপাট করে চলেছে। টাকার পাহাড় গড়ে তুলছে। আমরা যদি সরকারী ব্যাংকগুলোর প্রতি তাকাই তাহলে কি দেখতে পাই? ব্যাংকের তহবিল প্রায় শূন্য, মূলধনের ঘাটতি। হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণখেলাপী। ঋণ আদায় ঠিক মতো হচ্ছে না। বেসরকারী ব্যাংকের কথা বাদই দিলাম। রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকগুলোকে অনিয়ম ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে প্রতিবছরই মূলধন ঘাটতিতে পড়তে হচ্ছে। জনগণের করের টাকায় বাজেট থেকে সেই ঘাটতি পূরণ করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যথাযথ দিকনির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণের অভাবে চলছে প্রায় অবাধ লুটপাট। এক একজন শত শত কোটি টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়ে যাচ্ছে। জবাবদিহি না থাকলে প্রশাসনিক কাঠামো ভেঙ্গে পড়ে। এটাই স্বাভাবিক। চেন অব কমান্ড না থাকলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা যেমন ভেঙ্গে পড়ে, পাশাপাশি উন্নয়ন কর্মকা-ও ব্যাহত হয়। সেই সঙ্গে দুর্নীতিও বেড়ে যায়। মনে রাখা দরকার যে, জনপ্রশাসন তত্ত্বের সঙ্গে জবাবদিহি সম্পর্কিত। জবাবদিহির ধরন এবং জনপ্রশাসনের বিভিন্ন ধরনের উদ্বেগের সংশ্লিষ্টতা আছে। বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ আরোপের মাধ্যমে এবং স্ব-নিয়ন্ত্রণকারী মূল্যবোধের প্ররোচনার মাধ্যমে জবাবদিহি প্রচার করা যেতে পারে। ক্ষমতা, বিচক্ষণতা, কর্মচারীর আচরণ নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়া যেমন-নিয়ন্ত্রক, তদারকি, প্রভাব এবং পরিচালনা ও অন্যান্য অতিরিক্ত আমলাতান্ত্রিক মূল্যবোধ জবাবদিহি নিশ্চিত করে। তা না হলে দুর্নীতি ও দুর্নীতির সমস্যা এবং জনস্বার্থের সঙ্গে সরকারী পদক্ষেপের অসামঞ্জস্যতা থেকে যায়। আসা যাক জবাবদিহির কথায়। জবাবদিহি ছাড়া স্বচ্ছতা অসম্ভব। এর সঙ্গে মানবাধিকারের বিষয়টিও জড়িত। জবাবদিহি একটি বড় বিষয় হলো দায়িত্ব। জবাবদিহি না থাকলে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বের প্রতি অবহেলা করাই স্বাভাবিক। আর সুশাসন হলো ন্যায়নীতি অনুসারে উত্তমরূপে সুষ্ঠুভাবে ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে পরিচালিত রাষ্ট্র প্রশাসন। সুশাসন একটি কাক্সিক্ষত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রতিফলন। সময়ের প্রয়োজনে এবং শাসিতের সম্পর্কের ভিত্তিতে কোন দেশের শাসন পদ্ধতির বিবর্তন হয়ে থাকে। শাসিতের কাম্য শুধু শাসন নয়, সুশৃঙ্খল ও নিয়মতান্ত্রিক শাসন, যাকে আমরা সুশাসন বলতে পারি। কোন দেশে সুশাসন আছে কিনা তা বোঝার জন্য প্রথমে দেখতে হবে, সে দেশে শাসকের বা সরকারের জবাবদিহি আছে কি না! গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনিক স্বচ্ছতা আছে কি না! সুশাসন একটি রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থাকে কাক্সিক্ষত উন্নয়নের চরম শিখরে পৌঁছে দেয়। সুশাসনকে এক প্রকার মানদ-ও বলা যায়। যে মানদণ্ডের সাহায্যে একটি রাষ্ট্র বা সমাজের সামগ্রিক অবস্থা যাচাই করা যায়। যে রাষ্ট্র বা সমাজ যত বেশি সুশাসন দ্বারা পরিচালিত হয়, সেই রাষ্ট্র বা সমাজ ততো বেশি অগ্রগতির দিকে ধাবিত হয়। লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কমিশন লিঃ
×