ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সাজেদ রহমান

নারী ও শিশুবান্ধব পুলিশ সুপার রেশমা শারমিন

প্রকাশিত: ০০:৪৪, ১৯ এপ্রিল ২০২২

নারী ও শিশুবান্ধব পুলিশ সুপার রেশমা শারমিন

বাবা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। মা গৃহিণী। তিন ভাই-বোনের বড় স্বপ্ন ছিল বাবাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার। সেই স্বপ্নের বুনন ছিল পরিবার থেকেই। সেই স্বপ্ন পূরণে পরিবারের নিরঙ্কুশ সহায়তা ছিল। বাবা-মায়ের সেই স্বপ্ন পূরণ করেছেন তিনি। সাফল্যের ধারাবাহিকতায় বর্তমান পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) যশোরের পুলিশ সুপার পদে কর্মরত আছেন রেশমা শারমিন। ৬ বছর আগে ঘুরে এসেছেন জাতিসংঘের শান্তি মিশন। সর্বশেষ মামলার তদন্ত, ক্লুলেস মামলার রহস্য উদঘাটন ও আসামি গ্রেফতারসহ বীরত্ব ও সাহসিকতাপূর্ণ কাজের স্বীকৃতি হিসেবে এ বছর (২০২১ সাল) ‘প্রেসিডেন্ট পুলিশ পদক’ (পিপিএম-সেবা) অর্জন করেছেন পুলিশ সুপার রেশমা শারমিন। রেশমা শারমিন বলেন, মেয়েদের এগিয়ে যাওয়ার জন্য পরিবারের ভূমিকা মুখ্য। পরিবার থেকেই মেয়ের স্বপ্ন দেখাতে হবে। স্বপ্নের বীজ পরিবার থেকেই বুনতে হবে। তাদের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। তাহলে মেয়েরাও সফল হবে, এগিয়ে যাবে। পরিবার সচেতন থাকলে পারিপার্র্শ্বিকতা আটকাতে পারবে না। মেয়েরা সব সেক্টরের নেতৃত্ব দিচ্ছে। আমার কথাই ধরুন। আমি পরিবার থেকে সবচেয়ে বেশি সাপোর্ট পেয়েছি। বাবা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, মা গৃহিণী। বাবা একটা কথায় বলতেন ‘আমাকে ছাড়িয়ে যেতে হবে, সেভাবে নিজেকে প্রস্তুত কর। দেশের মানুষ আমাকে তোমার বাবা হিসেবে চিনুক।’ আর মা বলতেন ‘বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে হবে।’ পরিবার আমার মাঝে স্বপ্নের বীজ বপন করেছে। আমি সেই স্বপ্ন পূরণে নিবেদিত ছিলাম। সফল হয়েছি। কর্মজীবনে প্রবেশ করেছি। চেষ্টা করছি সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে। একজন নারী হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে প্রতিটি ধাপে কাজের মূল্যায়ন পেয়েছি। রেশমা শারমিন বলেন, নারী পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পুরুষ সহকর্মীদের কাছ থেকে সহযোগিতা বেশি পেয়েছি। নারী হওয়ায় পুলিশের সেবা নিতে আসা নারী ও শিশুরা বেশি সুবিধা পায়। অনেক বিষয়ে ভিকটিম বা সেবা প্রার্থীরা আমার কাছে নিসংকোচে অনেক কিছু বলতে পারে। আমিও তাদের গুরুত্ব দিই। পুরুষ কর্মকর্তাদের অনেকের কাছে তারা সেইভাবে হয় বলতে পারে না। আবার অনেক ভিকটিম বা ভুক্তভোগী নারী, শিশুরা সহজেই সব বিষয় আমার কাছে শেয়ার করতে পারে। তাদের কথা শুনে ত্বরিত আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করি। তিনি আরও বলেন, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) পুলিশ সুপার পদে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে একটাই ব্রত নিয়েছি। সেটি হলো- সেবা নিতে আসা মানুষ যেন স্বস্তি বা হাসিমুখে ফিরতে পারে। আমরা মূলত মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে কাজ করি। এ ক্ষেত্রে দুটি মাধ্যমে তদন্ত করি। একটা আদালতের মাধ্যমে আসা মামলা, অপরটি স্বউদ্যোগে বা ছায়া তদন্ত। নারী ও শিশু সংশ্লিষ্ট মামলাগুলো আমি যেভাবে এনলাইসেস (বিশ্লেষণ) করি, অন্যদের জন্য সহায়ক হয়। এ বিষয়ে আমার সঙ্গে কাজ করতে সহকর্মীরাও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। পিবিআই মামলার তদন্তে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়। বাদীর কথা শুনতে আমরা বেশি সময় দিই। তদন্ত কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে যান। ছবি তোলেন, ম্যাপ তৈরি করেন। ভিকটিম উদ্ধার না করে কোন রিপোর্ট দিই না। পিবিআইয়ের তদন্ত কার্যক্রম নিয়ে আদালতও সন্তুষ্ট। তা ছাড়া পিবিআইপ্রধান বনজ কুমার মজুমদার মহোদয়ের সঙ্গে মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে সরাসরি কথা বলতে পারি। তার সরাসরি দিকনির্দেশনায় কাজ করি। কোন কাজে সফল হলে নারী হিসেবে বেশি হাইলাইটস করা হয়। এতে ভাল কাজে অনুপ্রাণিত হই। রেশমা শারমিন আরও বলেন, পুলিশের চাকরিতে বিভিন্ন ধরনের কাজ করতে হয়। পিবিআইতে আসার পর একটি বিষয়ে আলাদা গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি। মানুষ নিখোঁজ সংক্রান্তে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়। জিডির সূত্র ধরে তদন্ত করি। বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর ঘটনার রহস্য উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারীদের সুরক্ষা প্রসঙ্গে পুলিশ সুপার রেশমা শারমিন বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারীরা খুব বেশি সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়। নানাভাবে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হয়। এসব নারীরা আমাকে খুব বেশি খোঁজ করে। কারণ নারীরা আমার কাছে ফোন করে নিঃসঙ্কোচে সব ঘটনা শেয়ার করতে পারে। আমি তাদের আইনী সহায়তা দিই। রেশমা শারমিন বলেন, আমি নারীদের উদ্দেশে বলব ভার্চুয়াল জগতকে বেশি আপন ভাবার দরকার নেই। কারণ এটা বাস্তব দুনিয়া নয়। বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে শিখুন। সতর্ক না থাকলে ফাঁদে পড়ার আশঙ্কা থেকে যায়। ১৯৮০ সালের ৭ অক্টোবর সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন রেশমা শারমিন। বাবা নজরুল ইসলাম ও মাতা মাবিয়া সুলতানা। ভিন ভাইবোনের বড় তিনি। রাজপুর স্কুলে প্রাথমিকের হাতেখড়ি। এরপর ১৯৯৫ সালে সোনাবাড়িয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি ও ১৯৯৭ সালে খুলনা সরকারী মহিলা কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসি উত্তীর্ণ হন। এরপর বাংলাদেশ হোম ইকোনমিকস কলেজ থেকে খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান বিষয়ে ২০০৪ সালে অনার্স ও ২০০৬ সালে মাস্টার্স পাস করেন। ২০০৬ সালে ২৫তম বিএসিএসের মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে সরদা পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নেন। এরপর ২০০৮ সালে ঝিনাইদহের সহকারী পুলিশ সুপার (সদর) পদে যোগদান করেন। ২০১০ সালের জুনে যশোরের সহকারী পুলিশ সুপার পদে যোগদান করেন। পরবর্তীতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদোন্নতি পান। ২০১৫ সালে জাতিসংঘের শান্তি মিশনে কঙ্গোতে যান। সেখানে এক বছর এক মাস দায়িত্ব পালন করেন। এরপর দেশে ফেরেন ২০১৬ সালের মে মাস। যোগ দেন সিআইডি যশোর-কুষ্টিয়া বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদে। ২০১৮ সালের নবেম্বর মাসে পুলিশ সুপার পদোন্নতি পান। ২০২০ সালের ৬ জুন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) যশোরে যোগদান করেন। বর্তমানে সেখানেই কর্মরত আছেন। ২০০৩ সালে মাগুরার বাসিন্দা ব্যাংকার রোকনুজ্জামানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের একমাত্র সন্তান তাহমিদ জামান অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র।
×