ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শুভ্র সেই বনফুল ফুটেছে

ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো কেঁদেছিল পায়...

প্রকাশিত: ২৩:৪৩, ১৯ এপ্রিল ২০২২

ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো কেঁদেছিল পায়...

মোরসালিন মিজান ॥ বেহুলা লক্ষ্মীন্দরের সেই পৌরাণিক কাহিনীর কথা স্মরণ করা যেতে পারে। নব দম্পতি আগে থেকেই সতর্ক ছিলেন। এরপরও তাদের বাসরঘরে ঢুকে পড়েছিল সাপ। লক্ষ্মীন্দরকে সাপে কাটল। বিষে নীল স্বামীকে সারিয়ে তুলতে প্রাণপণ লড়াই শুরু করলেন স্ত্রী বেহুলা। এ অবস্থায় ডাক পড়ল স্বর্গলোকে। সেখানে গিয়ে নেচে মহারাজ ইন্দ্রকে সন্তুষ্ট করতে পারলেই কেটে যাবে বিপদ। নেতাই ধোপানির সঙ্গে সেখানে গিয়ে পৌঁছলেন বেহুলা। নাচলেনও। সাধারণত ঘুঙুর পরেই নাচেন শিল্পীরা। কিন্তু বেহুলার পায়ে কি অন্য কিছু ছিল? উত্তর দিতে গিয়ে রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ লিখছেন: বাংলার নদী মাঠ ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো তার কেঁদেছিল পায়...। অর্থাৎ ভাঁটফুলকে ঘুঙুরের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন তিনি। অনিন্দ্য সুন্দর সে ফুলটির গল্পই আজ করব। না, স্বর্গলোকে নয়। মর্ত্যইে ফুটেছে শুভ্র বনফুল। অনেকদিন আগে ফুটেছিল। এখনও ফুরিয়ে যায়নি। মূলত গ্রামের বিভিন রাস্তার ধারে, ঝোপঝাড়ের আড়ালে গুল্ম জাতীয় এ উদ্ভিদ জন্ম নেয়। কারও যতেœর দরকার হয় না। আপনি বাঁচে। কেউ একে ঘরে তুলে নেন না। তাতে কী? এর ফুল প্রকৃতিকে সুন্দর করে। প্রতিটি ফুলে পাঁচটির মতো পাপড়ি। চারটি সাদা লম্বা কেশর। ফুলের মাঝখানে হলুদের ওপর হাল্কা মেরুন রঙের ছোঁয়া। কেশরের অগ্রভাগে আবার বেগুনি রঙের রেণু। ভাঁটের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম ক্ল্যারোডেনড্রাম ভিসকোসাম ভেন্ট। উদ্ভিদবিদ দ্বিজেন শর্মার বর্ণনা অনুযায়ী, এর পাতা চার ইঞ্চি থেকে সাত ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়। ডিম্বাকৃতি পাতার আগা সরু। খসখসে। বোঁটা ১ থেকে ৩ ইঞ্চি লম্বা। মঞ্জরিদ- ১২ ইঞ্চির মতো। গাছ মাটি থেকে খুব উপরে ওঠে না। এর কচি কা-। গায়ে নরম রোম হয়। ফুলের বাইরের আবরণেও রোম থাকে। ভাঁটফুলের আরেক নাম ঘণ্টাকর্ণ। এ নামেও আছে পৌরাণিক কাহিনী। রবীন্দ্রনাথেরও দৃষ্টি কেড়েছিল এইটুকুন ফুল। কবিগুরুর ‘সে’ গল্পে ঘণ্টাকর্ণকে একটি চরিত্র হিসেবে পাওয়া যায়। এর দুই কানে দুই ঘণ্টা। লেজও দুটি। দুই লেজে দুই হাতুড়ি। ওগুলো দিয়ে নিজেই নিজের ঘণ্টা বাজিয়ে যায়! ভাঁটফুলের আছে ঔষধী গুণও। গুণের কথা বেশ মজা করে লিখেছেন বিপ্রদাশ বড়ুয়া। লেখাটি এরকম: ঘণ্টাকর্ণের বিয়ে হয়েছিল বসন্ত-বিষফোঁড়া রোগের দেবী শীতলার সঙ্গে। এই ঘণ্টাকর্ণ, ঘেঁটু বা ভাঁটে জ্বর চর্মরোগ বিছার হুল ফোটানোতে ওষুধের কাজ করে। আর কী আশ্চর্য বসন্তকালে এসব রোগের প্রাদুর্ভাব হয়। এমনকি ম্যালেরিয়া জ্বরে, পা-ু রোগে, অজীর্ণে এর রস কাজ করে ওষুধের মতো। এ জন্য চৈত্রসংক্রান্তিতে ঘণ্টাকর্ণ বৃক্ষের আরাধনা করা হয় চর্মরোগ নিবারণের জন্য। তিনি জানাচ্ছেন, এখনো গ্রামের মানুষ জ্বর হলে এর পাতার রস খেয়ে থাকে। ক্রিমি, পুরনো শূল বেদনা দূর করতে ভাঁট একটি উৎকৃষ্ট ভেষজ। বৈদ্যদের পাশাপাশি ইউনানি হেকিমেরাও এর ব্যবহার করেন বলে লেখায় উল্লেখ করেছেন বিপ্রদাশ বড়ুয়া। ফুলের আলোচনায় ফিরি। আগেই জানিয়েছি, সাজানো বাগানে নয়, রাস্তার ধারে অযতেœ অবহেলায় ফোটে ভাঁট। পথিকের পা ছুঁয়ে থাকে। কত পথিক যে একে অবহেলা করে, এমনকি পায়ে মাড়িয়ে চলে গেছে! এ খেলাটি যিনি পড়বেন, অনুরোধ থাকবে, পায়ে অন্তত মারাবেন না। অনেক দুর্লভ হয়ে গেছে ফুলটি। একে বাঁচতে দিন। সৌন্দর্য উপভোগ করুন। একটু নুইয়ে ঘ্রাণটাও নিন। নিশ্চিত বলতে পারি, মন আপনার ভাল হয়ে যাবে।
×