ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নাজনীন বেগম

আসন্ন ঈদে জনদুর্ভোগ ও হয়রানি

প্রকাশিত: ২০:৪৩, ১৯ এপ্রিল ২০২২

আসন্ন ঈদে জনদুর্ভোগ ও হয়রানি

রমজান মাস ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্যে এগিয়ে চলেছে। মাসটা যেহেতু ইবাদত বন্দেগির সঙ্গত কারণে শুধু রোজা রাখা নয়- প্রতিদিনের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সঙ্গে এশার নামাজের পর তারাবি পড়াও একটি ধর্মীয় বিধি। আবার এই মাসে আমাদের খাদ্যাভ্যাস ও খাবারের সময়ে কিছুটা পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। সেহেরি দিয়ে রোজা শুরু- আবার ঈফতার করে রোজা ভাঙ্গাও ধর্মীয় নিয়ম। সুতরাং দুপুরের খাবার আমরা খাই সেহেরিতে। আর ইফতার করি মাগরিবের সময়। রাতের খাবার অনেকেই খান না। ইফতারের সঙ্গেই সব শেষ করে নেন। এরপর সেহেরির জন্য তৈরি হওয়াও এক বিশেষ পালাক্রম। ইবাদতের এই মাসটি আসার আগ থেকেই ব্যবসায়ী মহলের মধ্যে শুরু হয়ে যায় এক ধরনের দুরভিসন্ধি। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অমূলকভাবে দাম বাড়ানো। যদিও বাজার পর্যালোচনায় আবশ্যিক খাদ্যপণ্যের কোন ঘাটতি সেভাবে পাওয়া যায় না। বেশি দাম দিলেই প্রয়োজনীয় জিনিসটা পাওয়া যায়, যা এক ধরনের হঠকারিতা। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের অসাধু কারসাজিতে বাজারে পণ্য সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও মূল্যের উর্ধগতিতে সৃষ্টি হয় সাধারণ ক্রেতাদুর্ভোগ। বিশেষ করে তেল, পেঁয়াজ, চাল, ডাল, ময়দা, চিনি অর্থাৎ রমজান মাসে যেসব পণ্য অতি প্রাসঙ্গিক সেগুলোর ওপরই ব্যবসায়ী মহল চড়াও হয়। ঘাটতি নেই তবু কৃত্রিম সঙ্কটে বাজার যেন চরম অস্থির সময় পার করার দুরাবস্থা। যার ফলে অতি সাধারণ মানুষ পড়েন বিপাকে। এবারে তেল নিয়ে যে নতুন কারসাজি সেখানে মধ্যবিত্ত এমনকি উচ্চবিত্তরাও পড়েন চরম দুর্ভোগে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে ভোক্তা অধিদফতরও চরম অব্যবস্থাপনায় হিমশিম খাওয়ার পর্যায়ে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারকেই ন্যায্যমূল্যে পণ্য সরবরাহ ছাড়াও হতদরিদ্র মানুষের মধ্যে পারিবারিক কার্ড বিতরণ করে জনজীবনে স্বস্তি আনতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হয়। সেখানে কোন স্বাভাবিক গতি দৃশ্যমান না হওয়াও আশঙ্কাজনক। টিসিবির সম্প্রসারিত সারিতে অপেক্ষমাণ ক্রেতা সাধারণের দুর্ভোগে যেন চরম সীমায়। গরমের তীব্র দাবদাহে ঘেমে-নেয়ে ওঠা ক্রেতা সাধারণের অনেককেই শেষ অবধি খালি হাতে ফিরে যেতেও দেখা যায়। সরকার চালের ঘাটতি পূরণে নতুন ধান গোলায় ওঠার আগে ওএমএসের মাধ্যমে চাল বিতরণ কর্মসূচীও শুরু করে। ফ্যামিলি কার্ড বিতরণে অসংযত এবং লাগামহীন হওয়ার বিপন্ন দৃশ্যও সংশ্লিষ্টদের হজম করতে হয়েছে। যেমন হতদরিদ্র, নিম্নবিত্ত যাদের এই কার্ড পাওয়ার ন্যায্য অধিকার ছিল তাদের অনেকেই বঞ্চিত হয়েছেন সরকারী এই প্রয়োজনীয় কার্যক্রম থেকে। যাদের হাতে কার্ড দেখা গেছে তাদের অনেকেই এই কার্ডের জন্য একেবারেই বেমানান। কার্ড সংখ্যাও মাত্র এক কোটি, যা পর্যাপ্ত নয়। রমজান মাস নিয়ে নয় ছয় নতুন কোন অপকৌশল নয়। তার মধ্যে অপরাধ, অভিযোগ থাকলেও তার যথার্থ সুরাহা কখনই হয় না। দ্রব্যমূল্যের নাভিশ্বাস হওয়ার চরম দুর্ভোগে আরও এক বিপন্নতা রাজধানীবাসীদের চেপে ধরেছে। সড়ক, মহাসড়ক, অলি-গলিতে যন্ত্রযানের সুবিশাল সারি। যাত্রা ভোগান্তির এমন দুঃসময়ে বৈশাখের খরতাপ যেন জীবন বিপন্ন হওয়ার দুর্দশা। ঢাকা শহরে যন্ত্রযানের জট অসহনীয় অবস্থা হলেও গত ২ বছর করোনার মহাদুর্যোগে অন্য রকম স্বস্তির পরিস্থিতি গণমানুষের সামনে হাজির করেছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা, সীমিত আকারে ব্যবসাবাণিজ্য চালু থাকায় রাস্তা যানজটের প্রাবল্য থেকে মুক্ত ছিল বলাই যায়। সে কারণেই নাকি জানি না এবারের জট পাকানো লম্বা গাড়ির সারিকে কোনমতেই সহ্য করা যাচ্ছে না। রাস্তায় বেরুনোর আগেই ভেতর থেকে অসহনীয় চাপ অনুভূত হয়। মনে হয় ঠিকমতো গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে তো? সব মিলিয়ে রাজধানী ঢাকা যেন এক অস্থির সময় অতিক্রম করছে। স্বস্তির বদলে এমন দুঃসহ যাত্রাপথ কবে যে শেষ হবে ধারণাই করা যাচ্ছে না। রোজার মধ্যেই শুরু হয়ে যায় ঈদের কেনাকাটা। ফলে বাড়তি যন্ত্রযানের অসহ্য ঝক্কি ঝামেলাও বাড়তে থাকে। ঈদ মৌসুমে শপিং মলগুলোতে উপচে পড়া ভিড়ে তিল ধারণের যেন ঠাঁই থাকে না। ব্যবসা বাণিজ্যের দৃশ্যও চমকৃত হওয়ার মতোই। এদিকে ১৪২৮ বঙ্গাব্দের বিদায় ঘণ্টায় ১৪২৯ সাল সবাইকে নতুন আমেজে মাতিয়ে দেয়। করোনার মহাদুর্যোগে আমরা গত দুই বছর বাংলার নববর্ষকে বরণ করতে পারিনি। উৎসব আর আয়োজনের মহাআড়ম্বরে নতুন বছরকে সাদর আমন্ত্রণ জানানো আমাদের সাংস্কৃতিক দ্যোতনা। সেই চিরায়ত ঐতিহ্যিক চেতনার বাতাবরণ থেকে গত দুই বছর যেন আমরা অন্য রকম বর্ষবরণ দেখেছি। শুধু প্রযুক্তির বিশ্ব আর গৃহের সীমিত আঙ্গিনায় ব্যাপক আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই নতুনকে আমন্ত্রণ জানানোর বিকল্প কোন পথ ছিল না। কিন্তু এবার পহেলা বৈশাখে সারাদেশে পথে-প্রান্তরে মানুষের ঢল উপভোগ্য হওয়ার মতোই। ১৪২৯ বঙ্গাব্দের প্রথম প্রহরে আমাদের গৌরব ছায়ানট তার গত দুই বছরের বিরতির পর এবার মহাউদ্যমে বৈশাখী আমন্ত্রণ উপলক্ষ্যে রমনা বটমূলকে উৎসব আর আয়োজনে বর্ণিল করে তোলে। সুরের ঝঙ্কার আর নৃত্যের তালে তালে বাদ্যযন্ত্রের অভাবনীয় শৈল্পিক চেতনায় সরগরম হওয়া রমনা বটমূলে মানুষের ঢল নামার যে দৃশ্য প্রতিভাত হলো তা যেন এক অভাবনীয় নান্দনিক ব্যঞ্জনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ আয়োজিত মঙ্গল শোভাযাত্রা যে মাত্রায় জনবান্ধব হয়ে ওঠে তাও আবহমান বাংলার চিরায়ত বৈভব। গ্রামবাংলার শাশ্বত শৌর্যে সজ্জিত এই মঙ্গল শোভাযাত্রা যেন মাতৃভূমির বহুকাক্সিক্ষত কর্মযজ্ঞ। বাংলাদেশ উন্নয়নের নানামাত্রিক প্রকল্পে জোর কদমে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। নিরন্তর গতি পাওয়া এমন সব কর্মকান্ড দেশকে তুলে ধরছে এক অনন্য মাত্রায়, যা বিশ্বসভায়ও নজরকাড়া আবেদন রেখে যাচ্ছে। এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে আমাদের চিরকালীন সমৃদ্ধবোধ, প্রতিদিনের নিত্য কর্মযোগের সঙ্গে নিজেকে পূর্ণ করার এক অভাবনীয় প্রেরণা। যা যুগে যুগে এই দেশের মানুষকে সংহত করেছে, এক ঐতিহ্যিক ভাবসম্পদে মিলনসৌধ শক্ত হয়েছে এবং জাতি হিসেবে নিজেদের বিশ্বসভায় আপন গৌরবে তুলে ধরতেও সক্ষম হয়েছে। সামনে আসছে ঈদের হরেক রকম ব্যস্ততা। রমজান মাসও কেটে যাচ্ছে নানামাত্রিক কাজের অনন্য গতিময়তায়। ঈদে শুধু কেনাকাটাই নয়, নাড়ির টানে গ্রামে ফিরে যাওয়ারও ব্যকুলতা থাকে প্রায় সবার মাঝে। যাত্রা তো নয় যেন অসহনীয় দুর্ভোগ। করোনাকালে ট্রাক, পিকআপ ভ্যানসহ বিভিন্ন যানবাহনে যে মাত্রায় জনগণ শিকড়র টানে যেভাবে বাড়ির পানে ছুটে চলেছিল ভাবাই যায় না। আসলে গ্রামের সঙ্গে শহরবাসী মানুষের এক অভাবিত টান যেন হৃদয়ে গেঁথে আছে। সময় সময় তা উদ্বেলিত হওয়াও মাটি আর মানুষের এক অনবদ্য মিলন দ্যোতনা। কিন্তু এবারের ঈদযাত্রা সব কিছুকে ছাড়িয়ে যাবে তেমন আশঙ্কাই উঠে আসছে বার বার। ধারণা করা হচ্ছে, এবারের ঈদযাত্রায় গণমানুষের যে ঢল নামবে সেটা অন্যবারের চেয়ে বেশি চোখে পড়ার মতো হতে পারে। সড়ক, নৌ ও রেলযাত্রায় উপচেপড়া ভিড়ে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ ও হয়রানি যে কি পরিমাণ বাড়বে তা ধারণার অতীত। আনন্দ ভ্রমণ শেষ অবধি যেন বিষাদে ছেয়ে না যায়। গেল বছর এক কোটিরও বেশি মানুষের রাজধানী থেকে নিজ নিজ জেলায় ঈদ করতে যাওয়ার চিত্র এখনও ভাস্বর হয়ে আছে অনেকের স্মৃতিতে। ধারণা করা অসঙ্গত নয় করোনাকে সামলানোর কারণে এবারে যাত্রা হবে আরও বেশি মানুষের। বিশেষ করে নারী ও শিশুদের ভোগান্তি হবে সবচেয়ে বেশি। তার ওপর সড়ক মহাসড়কে নির্মীয়মান রাস্তাগুলো এখনও সেভাবে অবারিত হতে পারেনি। সেখানে অসহ্য যানজটে জনদুর্ভোগ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে কল্পনারও অতীত। নদীমাতৃক বাংলাদেশে নৌপথের যাত্রাও এখন আর সেভাবে নিরাপদ নেই। কয়েকবার নৌদুর্ঘটনা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে আরম্ভ করে যাত্রীদেরও সচকিত করে দিয়েছে। নৌযানের যান্ত্রিক ত্রুটি থেকে আরম্ভ করে পুরো ব্যবস্থাপনায় অসংযত পর্যায় সব কিছু মিলে নিরাপত্তাহীনতার যে দুর্ভোগ সেটাও এবার আরও কিছু যোগ করবে কিনা সময়ই তা বলবে। তার ওপর ফেরির সঙ্কটও উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়। বৈশাখ মাসের শুরু। নতুন বছরের আবাহনই শুধু নয় হরেকরকম বিপত্তিও মাথাচাড়া দেয়। হঠাৎ করেই কালবৈশাখীর ঝড় শুরু হয়ে সবকিছু ল-ভ- করে দেয়াও এক অবধারিত দুর্গতি। আর নদীপথে যদি কোন ঝড় ঝাপটা আক্রমণ করে তাহলে নৌযান আর যাত্রীদের কাহিল অবস্থা কোথায় গিয়ে নামবে ভাবাই যাচ্ছে না। আর রেলপথের যে নৈমিত্তিক চলাচলের সিডিউল বিপর্যয় সেখানে ঈদযাত্রায় নতুন ট্রেন সংযোজন করলেও যাত্রী ভোগান্তি বিন্দুমাত্র কমতে দেখা যায় না। কারণ এখনও রেলপথকে নিরাপদ যাত্রাপথ হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। ফলে ট্রেন বাড়লে যাত্রী সংখ্যাও বৃদ্ধির সম্ভাবনাই বেশি। ট্রেনেও থাকে উপচেপড়া ভিড়। ছাদে, দরজার হ্যান্ডেলে ঝুলে দুঃসহ যাত্রার দৃশ্য উদ্বেগজনক। তবুও মানুষ ছুটবে নাড়ির টানে গ্রামে-গঞ্জে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এদিকে সরকারও যথানিয়মে তার কার্যক্রমকে জনবান্ধব করতে ইতোমধ্যে ব্যবস্থা নিয়ে যাচ্ছে। যাতে ঈদযাত্রায় জনগণ কোন ধরনের বিপত্তিতে আটকে না পড়ে সেদিকে নজরদারি করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পরামর্শ ও নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে। ঈদযাত্রায় মানুষ যেন অকারণে কোন দুর্ভোগের শিকার না হয় সেজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পদক্ষেপ নিতে আদেশ দিয়েছে সরকার। এই এপ্রিল মাসে রমজান, পহেলা বৈশাখ, দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি, অসহনীয় যানজট, ঈদের কেনাকাটা, মৌসুমী ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য সব মিলিয়ে এক অস্থির সময় পার করছে গোটা বাংলাদেশ। তার ওপর ঈদযাত্রায় চরম দুর্ভোগকেও আমলে নিয়ে শিকড়ের টানে গ্রামে যাওয়ার প্রস্তুতিও শুরু হয়ে গেছে। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঈদ আর বর্ষার আগে অসমাপ্ত সড়কপথ বিশেষ করে চার লেইনের রাস্তাগুলোকে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি শেষ করার নির্দেশ জারি করেছেন। তেমন নির্দেশনায় কাজ শুরুও করা হয়েছে। সারাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাগুলোও যাতে তাড়াতাড়ি মেরামত করা হয় তেমন কার্যক্রমের উপরও কড়া নজরদারি আরও বাড়ানো হয়েছে। শেষ অবধি সুফল কতখানি আসবে তা সময়ই বলে দেবে। লেখক : সাংবাদিক
×