ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. মিহির কুমার মজুমদার

ধনী হওয়ার স্বপ্নে দেউলিয়া শ্রীলঙ্কা

প্রকাশিত: ২০:৪১, ১৯ এপ্রিল ২০২২

ধনী হওয়ার স্বপ্নে দেউলিয়া শ্রীলঙ্কা

ভারত মহাসাগরের নৈসর্গিক সৌন্দর্যমণ্ডিত দেশ শ্রীলঙ্কা। ‘পার্ল অব ইন্ডিয়ান ওশেন’ নামে পরিচিত এ দেশ মানব উন্নয়ন সূচকেও দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে অগ্রগামী। কাছাকাছি কেউ নেই, একমাত্র ভারতের কেরালা রাজ্য ছাড়া। ৬৫,৬১০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ দেশে জনসংখ্যা প্রায় ২.১৫ কোটি। প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যা মাত্র ৩২৮ জন। শিক্ষিতের হার ৯২.৬৪% এবং গড় আয়ু ৭৭ বছরের বেশি। মাথাপিছু গড় আয় ভারত বা বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ উন্নয়নের অধিকাংশ সূচকে এ অঞ্চলের সবচেয়ে অগ্রগামী শ্রীলঙ্কা এখন অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত। বিদ্যুত উৎপাদনের জ¦ালানি ক্রয়ের অর্থ নেই। রিজার্ভ মাত্র ০২ বিলিয়ন ডলার। খাদ্য সঙ্কট, বিদ্যুত সঙ্কট এবং জ¦ালানি সঙ্কটের পাশাপাশি ওষুধ এবং চিকিৎসা সামগ্রীর সঙ্কট। এজন্য জনরোষ বাড়ছে নিত্যদিন। ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রীর জন্য চিকিৎসকরা নেমেছেন রাস্তায়। মন্ত্রীরা পদত্যাগ করছেন। দেশ-বিদেশের পত্র-পত্রিকার আলোচনায় এখন অন্যতম বিষয় শ্রীলঙ্কা। বলা হচ্ছে- গোষ্ঠীতন্ত্র, ভুল সিদ্ধান্ত, বৈদেশিক ঋণে অলাভজনক মেগা প্রকল্প গ্রহণ এবং করোনার কারণে পর্যটন শিল্প ধাক্কা খাওয়ায় শ্রীলঙ্কার বর্তমান দশা ইত্যাদি। শ্রীলঙ্কার এরূপ একটা অবস্থা সৃষ্টির আশঙ্কা দিগন্তে আগে থেকেই ছিল। সে কারণেই এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ২০১৯ সালে শ্রীলঙ্কার ওপর বিশেষ একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে। শিরোনাম ছিল : ‘এৎড়রিহম ঙষফ ইবভড়ৎব ইবপড়সরহম জরপয— ঈযধষষবহমবং ড়ভ ধহ ধমরহম চড়ঢ়ঁষধঃরড়হ রহ ঝৎরষধহশধ’. যার অর্থ দাঁড়ায় : ‘ধনী হওয়ার আগেই বৃদ্ধ হয়ে যাওয়া- বয়স্ক জনসংখ্যার চাপে শ্রীলঙ্কা।’ বয়স্ক জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে উন্নয়নের একটি নিবিড় নেতিবাচক সম্পর্ক আছে, যেমন আছে কর্মক্ষম জনসংখ্যার সঙ্গে উন্নয়নের গতি বৃদ্ধির সম্পর্ক। পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহের ওপর পরিচালিত এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কোন দেশের ৩৩% থেকে ৪৪% উন্নয়ন সে দেশের কর্মক্ষম জনসংখ্যা বৃদ্ধির ওপর নির্ভর করে। কোন দেশে কর্মক্ষম জনসংখ্যা বৃদ্ধি হঠাৎ করেই ঘটে না। আবার বৃদ্ধি পেলেও নির্দিষ্ট সময় পরে তা আর থাকে না। কর্মক্ষম জনসংখ্যাসহ জনসংখ্যা হ্রাস-বৃদ্ধির বা পরিবর্তনের কয়েকটি ধাপ আছে। ডেমোগ্রাফি বা জনসংখ্যাবিদ্যার ভাষায় এসব ধাপকে ডেমোগ্রাফিক ট্রানজিশন বা জনসংখ্যা পরিবর্তনের ধাপ ১, ২, ৩ ও ৪ নামে অভিহিত করা হয়। কোন জনপদে জন্মহার ও মৃত্যুহার যদি উচ্চমাত্রায় থাকে, তবে সে অবস্থাকে জনসংখ্যা পরিবর্তনের পূর্ব ধাপ হিসেবে গণ্য করা হয়। এ অবস্থায় খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নয়নের প্রচেষ্টা নেয়া হয়। আর এসব ক্ষেত্রে উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুহার কমতে থাকে এবং শুরু হয় জনসংখ্যা পরিবর্তনের ধাপ। উচ্চ জন্মহার থাকা অবস্থায় এই মৃত্যুহার নিম্নগামী হওয়াই হচ্ছে জনসংখ্যা পরিবর্তনের প্রথম ধাপ। এ অবস্থায় দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং জন্মহার নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয়া হয়। এভাবে জন্মহার ও মৃত্যুহার উভয়ই কমতে থাকলে জনসংখ্যা পরিবর্তনের দ্বিতীয় ধাপের সূচনা ঘটে। দ্বিতীয় ধাপ ধীরে ধীরে তৃতীয় ধাপের রূপ নেয় এবং কর্মক্ষম জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটে। কর্মক্ষম জনসংখ্যা একটি নির্দিষ্ট সময় পরে বার্ধক্যে উপনীত হয় এবং শিশু বয়সী জনসংখ্যা কমে যায়। সে কারণে ক্রমহ্রাসমান কর্মক্ষম জনসংখ্যার ঘাটতি পূরণ হয় না। শুরু হয় জনসংখ্যা পরিবর্তনের চতুর্থ ধাপ। এ ধাপে বয়স্ক জনসংখ্যা বেড়ে যায়, শিশু বয়সী জনসংখ্যা কমে ও কর্মক্ষম জনসংখ্যা ৫০%-এর নিচে নেমে যায়। বয়স্ক জনসংখ্যার আধিক্য সমাজে ভোগ্যপণ্যে চাহিদা সীমিত করে, স্বাস্থ্য খাতে চাপ বাড়ায়, সঞ্চয় হার হ্রাস পায় এবং সার্বিক উৎপাদন প্রক্রিয়া বিঘিœত করে। যা দেশকে ঋণাত্মক উন্নয়নের কাতারে শামিল করে। কর্মক্ষম জনসংখ্যার সংখ্যা বৃদ্ধির এ সময়কালকে জনসংখ্যাবিদ্যার ভাষায় বলা হয় ‘ডেমোগ্রাফিক বোনাস’। এ সময়কালে জনগণের দক্ষতা বৃদ্ধি, শিল্পায়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন, স্ব-কর্মসংস্থানসহ কর্মসংস্থান করে দেশের সার্বিক উন্নয়ন করা সম্ভব হলে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনসংখ্যা সম্পর্কিত লাভ অর্জিত হয়। না হলে বয়স্ক জনসংখ্যার সংখ্যা বৃদ্ধি এবং কর্মক্ষম জনসংখ্যার ঘাটতি এক দুর্যোগ অবস্থার (উবসড়মৎধঢ়যরপ উরংধংঃবৎ) সৃষ্টি করে। শ্রীলঙ্কা এখন এ অবস্থার কাছাকাছি বা প্রান্তসীমায় অবস্থান করছে। এজন্যই এত শোরগোল। তবে শ্রীলঙ্কার এ বিপর্যস্ত অবস্থায় পতিত হওয়ার কথা ছিল না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য মানব উন্নয়ন সূচকের ব্যাপক উন্নতির কারণে শ্রীলঙ্কার ডেমোগ্রাফিক বোনাসের সময়কাল ১৯৯০-এর দশকের প্রথমেই শুরু হয়। বাংলাদেশে এর ১০ থেকে ১৫ বছর পরে এ বোনাস সময়কালের সূচনা ঘটে। একজন মা গড়ে কতজন সন্তান জন্মদান করেন এ অবস্থাকে বলা হয় টোটাল ফার্টিলিটি রেট (টিএফআর)। শ্রীলঙ্কায় ১৯৫৩ সালে এ টিএফআর ছিল ৫.৩, যা ১৯৯৫-২০০০ সময়কালে মাত্র ১.৯-এ নেমে আসে। অর্থাৎ, মৃত্যুহারের চেয়ে জন্মহার কম। এ সময় বাংলাদেশের টিএফআর ছিল ৩.৫, যা এখন কম-বেশি ২.১৫। দক্ষিণ এশিয়াসহ এতদ অঞ্চলের মধ্যে শ্রীলঙ্কায় কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী (১৫ থেকে ৬৪) এখন সবচেয়ে বেশি (৬৭.২%)। কম জন্মহারের কারণে সেখানে গত দুই দশক ধরে শিশু (০-১৪ বছর) ও তরুণ বয়সী জনসংখ্যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে এবং বয়স্ক (৬৫+)-এর সংখ্যা বাড়ছে। জাতিসংঘের জনসংখ্যা কর্মসূচীর প্রতিবেদন অনুযায়ী শ্রীলঙ্কায় বয়স্ক জনসংখ্যার হার ২০০০ সালে ৯.৩% থেকে ২০২০ সালে ১৬.৭-এ উন্নীত হয়েছে, যা ক্রমান্বয়ে আরও বৃদ্ধি পাবে। অপরদিকে, শিশু বয়সী ও তরুণ জনগোষ্ঠী জনসংখ্যা কমে যাওয়ায় বর্তমানের সর্বোচ্চ কর্মক্ষম জনসংখ্যার হারও ২০৩১ সালের পরে নিম্নমুখী হবে। যা উৎপাদন ও উন্নয়নের গতি নিম্নমুখী করবে। বর্তমানে উচ্চ হারে কর্মক্ষম জনসংখ্যা থাকলেও এর একটা বড় অংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক সেক্টরে কাজ করে এবং উল্লেখযোগ্য অংশ কর্মহীন। যথাযথ শিল্পায়ন এবং সংশ্লিষ্ট সেক্টরের অগ্রগতি না হওয়ায় কর্মক্ষম জনগণকে সঠিকভাবে উৎপাদনে ব্যবহার করা যায়নি। এ অঞ্চলে পোশাক রফতানি প্রথম শুরু করে শ্রীলঙ্কা। এখনও দেশের রফতানি বাণিজ্যের ৫২% দখল করে আছে পোশাক খাত। এর পরে আছে চা (১৭%), রাবার, মাছ ও নারিকেলজাত দ্রব্য ইত্যাদি। গৃহযুদ্ধের কারণে পোশাক খাত এবং শিল্পায়নের অন্য খাতে বিদেশী বিনিয়োগ আসেনি। বাংলাদেশ ২০১৯ সালে ১২১টি দেশে ওষুধ রফতানি করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ওষুধ রফতানি হয়েছে শ্রীলঙ্কায়। অর্থাৎ, চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদা নিরসনে ওষুধ শিল্পও সেখানে বিকাশলাভ করেনি। অন্যান্য শিল্পের অবস্থাও সন্তোষজনক নয়। ডেমোগ্রাফিক বোনাসকাল কোন দেশের জন্য মাত্র একবার আসে। সমাজভেদে এ সময়কাল ৩০ থেকে ৩৫ বছর স্থায়ী হয়। কাজেই, এ সময় কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি, শিল্পায়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন, স্বকর্মসংস্থানসহ তাদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার কোন বিকল্প নেই। ডেমোগ্রাফিক বোনাসের সময়কাল হচ্ছেÑ চায়ের কাপে বিস্কুট ভিজিয়ে খাওয়ার মতো, একটু বিলম্ব বা ভুল হলে হারিয়ে যায়, চেষ্টা করেও তা ফিরে পাওয়া যায় না। এখন সর্বত্র আলোচনা হচ্ছে ঋণ করে ঘি খাওয়ার মতোÑ শ্রীলঙ্কা বৈদেশিক ঋণে জর্জরিত। বৈদেশিক ঋণে হাম্বানটোটা সমুদ্র বন্দর, রাজাপাকসে বিমান বন্দর এবং অনেক অপ্রয়োজনীয় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রীসহ অনেক মন্ত্রীর পদ একই পরিবার কর্তৃক দখল, রাসায়নিক সার ব্যবহার বন্ধ, ভ্যাট ও কর হ্রাস ইত্যাদি অনেক ভুল করেছে শ্রীলঙ্কা সরকার। এগুলো সত্য কোন সন্দেহ নেই। তবে বড় সত্য হচ্ছেÑ তাদের ঐতিহাসিক ভুল স্বাধীনতার পর থেকে শুরু হয়েছে। তামিল জনগোষ্ঠীকে ব্রিটিশরা চা ও কফি উৎপাদনের জন্য ১৯ শতকে শ্রীলঙ্কায় নিয়ে আসে। যেমন- আমাদের দেশে ও অনেক দেশেই তারা সস্তায় শ্রমিক এনেছে। তামিলরা শিক্ষায় ভাল করে প্রশাসন ও অন্য ক্ষেত্রে অগ্রগামী হয়েছে। স্বাধীনতার পরে বন্দরনায়েক সরকার তামিলদের শিক্ষা, প্রশাসন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে অগ্রগতি বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছেÑ সিলোন সিটিজেনশিপ আইন-১৯৪৮ এবং ঝরহযধষধ ঙহষু অপঃ- ১৯৫৬ পাস করা। সঙ্গে আছে দাফতরিক ভাষা ইংরেজীর পরিবর্তে সিংহলী চালু এবং উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে ভাষাভিত্তিক কোটা পদ্ধতি প্রচলন। নাগরিকত্ব আইনে কয়েক লাখ তামিল জনগোষ্ঠী নাগরিকত্ব হারায়। ১৯৬৪ সালে ভারতের সঙ্গে ইন্দো-সিলোন চুক্তি করায় প্রায় ৩.৫ লাখ তামিল ভারতে ফিরে যায়। অবশিষ্টরা প্রথমে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন এবং পরে এলটিটিই নামে সংগঠনের মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করে। ২০০৯ সালে এলটিটিই প্রধান মি. প্রভাকরণের হত্যার পরেই এ গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে। কাজেই, শ্রীলঙ্কার ডেমোগ্রাফিক বোনাসের (১৯৯১-২০২০) অধিকাংশ সময় কেটেছে গৃহযুদ্ধ দমন কার্যক্রমে। বিভিন্ন উন্নয়ন সূচকে অগ্রগামী থাকলেও এ গৃহযুদ্ধের কারণে কাক্সিক্ষত বিদেশী বিনিয়োগ আসেনি, যথাযথ শিল্পায়ন হয়নি, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ বেকার থাকায় উৎপাদনে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। এখন দিন দিন বয়স্ক জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও কর্মক্ষম জনসংখ্যা কমতে শুরু করবে। দেশের একটি ছোট জনগোষ্ঠীকে পেছনে ঠেলতে গিয়ে শ্রীলঙ্কা ডেমোগ্রাফিক বোনাসের মহামূল্যবান সময় নষ্ট করেছে। নিজেই পিছিয়েছে অনেক পথ, যা থেকে উত্তরণ বেশ কষ্টকর। লেখক : সাবেক সচিব
×