ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষকের কপালে চিন্তার ভাঁজ

হাওড়াঞ্চলে নদ-নদীর পানি বাড়ছেই, ঢুকছে ফসলের জমিতে

প্রকাশিত: ২২:১৬, ১৮ এপ্রিল ২০২২

হাওড়াঞ্চলে নদ-নদীর পানি বাড়ছেই, ঢুকছে ফসলের জমিতে

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ উজান থেকে ধেয়ে আসা পাহাড়ী ঢলে নেত্রকোনার ধনু নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। রবিবার বিকেল ৩টায় পরিমাপ করে দেখা গেছে, বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে নদীটির পানি। অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাওয়া ঢলের পানির চাপে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে খালিয়াজুরীর কীর্তনখোলাসহ বেশকিছু ফসল রক্ষা বাঁধ। ফলে চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছেন হাজার হাজার কৃষক। এদিকে ভারি বৃষ্টিপাতের পর উজানের প্রবল ঢেউয়ে পাটলাই নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে তাহিরপুর উপজেলার গুরমার হাওড়ের বাঁধ উপচে পানি ঢুকছে। এছাড়া ২৪ ঘণ্টায় সুরমা ও যাদুকাটা নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। খবর নিজস্ব সংবাদদাতাদের। নেত্রকোনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী এমএল সৈকত জানান, খালিয়াজুরী পয়েন্টে ধনু নদীর পানি বিপদসীমার ৪ দশমিক ১৫ মিটারে। কিন্তু রবিবার বিকেল ৩টায় পরিমাপ করে দেখা গেছে, তা ৪ দশমিক ২৯ মিটারে পৌঁছে গেছে। অর্থাৎ বিপদসীমার ১৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। কোথাও কোথাও নদীটির পানি উপচে পড়েছে। এদিকে ধনু ছাড়াও জেলার কংস, মগড়া, উব্দাখালি ও সোমেশ্বরী নদীর পানিও হুহু করে বাড়ছে। এ কর্মকর্তা আরও জানান, ভারতের মেঘালয় ও চেরাপুঞ্জিতে বৃহস্পতিবার থেকে ফের ভারি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এর প্রভাব পড়ছে হাওড়াঞ্চলের নদীগুলোতে। ধনু নদীর পানি বাড়ায় খালিয়াজুরী, মোহনগঞ্জ ও মদনের হাওড়াঞ্চলের অন্তত ২০টি বেড়িবাঁধ আবারও হুমকির মুখে পড়েছে। কোন কোন বাঁধের প্রায় সমান সমান হয়ে গেছে নদীর পানি। এ কারণে বাঁধগুলোতে পানির চাপ পড়ছে। বিশেষ করে ধনু নদীর পাড়ে অবস্থিত খালিয়াজুরীর কীর্তনখোলা বাঁধটি খুব বেশি ঝুঁকির মধ্যে আছে। স্থানীয় কৃষকরা মাটি, চাটাই, বাঁশ প্রভৃতি দিয়ে বাঁধটি কোনরকমে টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। এ উপজেলার সিংহভাগ বোরো ফসলই ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এ বাঁধটির ওপর নির্ভরশীল। নদ-নদীর পানি বাড়ায় উঠতি বোরো ফসল নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছেন হাওড় উপজেলাগুলোর হাজার হাজার কৃষক। নিরূপায় হয়ে অনেকে কাঁচা ও আধাপাকা ধান কাটতে শুরু করেছেন। খালিয়াজুরী উপজেলার কৃষি অফিসার জসীম উদ্দিন জানান, ‘এ বছর সেখানকার ২০ হাজার ১শ’ ২০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছিল। এর মধ্যে রবিবার নাগাদ ৬৫ ভাগ জমির ধান কাটা হয়ে গেছে। তবে ব্রি-২৯ ও হাইব্রিড জাতের ধান এখনও পাকেনি। সেগুলো পাকতে আরও সপ্তাহখানেক দরকার।’ তবে খালিয়াজুরীর জগন্নাথপুর গ্রামের কৃষক আলী হোসেন ও পুরানহাটির কৃষক শফিকুল ইসলামসহ কয়েকজন বলেছেন, ‘কৃষি বিভাগের এ হিসাবের সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। বেশিরভাগ জমির ধান এখনও পাকেনি। তাই অর্ধেক জমির ধানও এখনও কাটা হয়নি। তবে ঢলের পানি বাড়তে থাকায় কিছু কিছু কৃষক কাঁচাধান কেটে খোড়াকি জোগাড়ের চেষ্টা করছেন। কাঁচাধান কাটলেও খুব একটা লাভ হবে না। চিটা হয়ে যাবে।’ জগন্নাথপুর গ্রামের মাহবুবুর রহমান আশঙ্কা করে বলেন, পানি যেভাবে বাড়ছে তাতে মনে হয়, আর কোন কিছুতেই কাজ হবে না। যে কোন সময় বাঁধ ভেঙ্গে অথবা বাঁধ উপচে ফসলি হাওড়গুলোতে পানি ঢুকে যাবে। যদি এমনটি হয়, তাহলে এক-দু’দিনের মধ্যেই সব হাওড় তলিয়ে যাবে। এখন কেবল আল্লাহই ভরসা।’ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী এমএল সৈকত বলেন, ‘নদীর পানি বাড়লেও কোন বাঁধ এখনও ভাঙ্গেনি। বাঁধ রক্ষায় আমরা স্থানীয় কৃষকদের নিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি।’ খালিয়াজুরী উপজেলার নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) এইচএম আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘ধনুর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ফসলরক্ষা বাঁধগুলোতে পানির চাপ খুব বেড়েছে। সমস্যা হচ্ছে কীর্তনখোলা হাওড়ের বাঁধ নিয়ে। কীর্তনখোলা বাঁধের ৭ কিলোমিটার অংশ ধনু নদের তীরে হওয়ায় ঝুঁকি বেশি। আমরা বাঁধটি টিকিয়ে রাখার সবোচ্চ চেষ্টা করছি।’ সুনামগঞ্জ ॥ জেলার নদ-নদীর পানি আবারও বাড়তে শুরু হয়েছে। ভারি বৃষ্টিপাতের পর উজানে প্রবল ঢেউয়ে পাটলাই নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার গুরমার হাওড়ের বাঁধ উপচে পানি ঢুকছে। গত ২৪ ঘণ্টায় পানি বৃদ্ধি পেয়েছে সুরমা নদীতে ২৫ সেমি এবং যাদুকাটায় ১৬ সেমি। সুনামগঞ্জ জেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় ১৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। স্থানীয়রা জানান, রবিবার সকালে টাগুয়ার হাওড়ের ওয়াচ টাওয়ার সংলগ্ন এলাকায় বাঁধে ফাটল দেখা দেয়। বর্ধিত গুরমার ২৭ নং প্রকল্পটি দেবে গেছে এবং পানি ঢুকে পড়ছে গ্রামে। বর্ধিত গুরমার হাওড়ের ফসল রক্ষা বাঁধের কাজে তদারকিতে নিয়োজিতরা জানিয়েছেন এভাবে হাওড়ে পানি প্রবেশ করতে থাকলে বর্ধিত গুরমার হাওড় অংশের খাউজ্যাউরি, নোয়াল, আইন্যা, কলমা ও গলগলিয়া ও ধর্মপাশা উপজেলার বংশীকুন্ডা এলাকার হাওড়গুলোর ফসলি জমিও ডুবে যাবে। ১০ দিন ধরে আমরা এ অবস্থায় আছি। এ অবস্থায় ক্লান্ত হয়ে আমরা এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছি। তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ রায়হান কবীর বলেন, পাটলাই নদীর পানি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় অবস্থা এখন খারাপের দিকে যাচ্ছে। ওয়াচ টাওয়ার সংলগ্ন বাঁধে মাটি ও বাঁশের চাটাই দিয়ে পানি আটকানোর চেষ্টা চলছে। গত তিনদিন ধরে থেমে থেমে বৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢল অব্যাহত থাকায় আবারও বাঁধে ধস কিংবা ভাঙ্গন নিয়ে চিন্তিত রয়েছেন কৃষকরা। সারা বছরের সোনালি ফসল পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।
×