ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এখন চলছে খুঁটিনাটি কাজ

পদ্মা সেতুজুড়ে পিচঢালা পথ ॥ ফুটে উঠছে মূল চেহারা

প্রকাশিত: ২১:৪৮, ১৬ এপ্রিল ২০২২

পদ্মা সেতুজুড়ে পিচঢালা পথ ॥ ফুটে উঠছে মূল চেহারা

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, মুন্সীগঞ্জ ॥ পদ্মা সেতুজুড়ে এখন ব্ল্যাকটপ বা পিচঢালা পথ। পদ্মা সেতু এখন মূল চেহারায় ফুটে উঠছে। পিচঢালা সড়ক পথ ছাড়াও ল্যাম্পপোস্টগুলো সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে। আর রোড মার্কিং এবং প্যারাপেট ওয়ালের ওপরে এ্যালুমিনিয়ামের চারকোনা রেলিং বসে গেলে আরও আকর্ষণীয় হবে সেতুটি। আগামী জুনে সেতু চালু করতে এখন পুরোদমে চলছে খুঁটিনাটি কাজগুলো। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ মূল সেতুতে ১ লাখ ২৩ হাজার স্কয়ার মিটার এলাকায় কার্পেটিং কাজ। প্রথমে সাদা, হলুদ, ব্রাউন ও কালো রংয়ের চার লেয়ার ওয়াটার প্রুভিং বা পানিরোধক। এর উপরে দুই লেয়ারে কার্পেটিং করা হচ্ছে। ওয়াটার প্রুভিংয়ের ওপরে প্রথমে ৬০ মিলিমিটার পুরুত্বের কার্পেটিং করার পরপরই চূড়ান্ত লেয়ার দেয়া হয়। ফাইনাল লেয়ারটি ৪০ মিলিমিটার পুরত্বের। সোমবার পর্যন্ত ১ লাখ ১২ হাজার ৬শ’ ৩৭ স্কয়ার মিটার এলাকায় প্রথম লেয়ায়ের কার্পেটিং সম্পন্ন হয়েছে। আর এর ওপর ফাইনাল লেয়ার হয়েছে ৭৪ হাজার ২শ’ ২৩ স্কয়ার মিটার পথ। মূল সেতুতে কার্পেটিং অগ্রগতি ৭৬ শতাংশ। আর ওয়াটার প্রুভিং অগ্রগতি ৮৮ দশমিক ৬৭ ভাগ। ভায়াডাক্টের কার্পেটিং অগ্রগতি ৫৬ শতাংশ। আর সেতু থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে শিমুলিয়া ঘাট বরাবর জাতীয় বিদ্যুত গ্রিডের ৪০০ কেভি টিএল প্ল্যাটফর্ম অগ্রগতি ৮০ শতাংশ। নদীতে ৭টি বিদ্যুত প্ল্যাটফর্ম নির্মাণের কাজটি মূল সেতুর কাজের সঙ্গে যুক্ত রাখা হয়েছে। তাই বিদ্যুত প্ল্যাটফর্ম কাজ কিছুটা পিছিয়ে থাকার কারণে মূল সেতুর অগ্রগতিতে প্রভাব পড়ে। মূল সেতুর কাজের অগ্রগতি এখন ৯৭ শতাংশ। কিন্তু বিদ্যুত প্ল্যাটফর্ম বাদ দিলে মূল সেতুর কাজের অগ্রগতি আরও বেশি। নদী শাসনের কাজের অগ্রগতি ৯০ দশমিক ৫০ শতাংশ। সব মিলিয়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ৯২ শতাংশ। পদ্মা সেতুর শেষ সময়ের কাজের মহাযজ্ঞ চলছে এখন সেতুটি চালু করতে। এটি চালু হলে দেশে যুগান্তকারী অধ্যায় রচিত হবে। সমীক্ষায় এসেছে, পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ হারে জিডিপি বৃদ্ধি পাবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। মোংলা বন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯টি জেলাকে সারাদেশের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করবে এই স্বপ্নের পদ্মা সেতু। বিশ্বব্যাংক সরে গেলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রজ্ঞাবান ও সাহসী সিদ্ধান্তে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তায়নের একেবারেই চূড়ান্ত পর্যায়ে এখন। আর পদ্মা সেতু শুধু অর্থনীতিতে সাফল্য, সহজ হবে দক্ষিণাঞ্চলের কোটি কোটি মানুষের চলাচলই নয় এই সেতু বাঙালী জাতির অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাওয়ার একটি স্মারক। যা বিশে^ বাংলাদেশকে বিশেষ এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে। ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর সর্বশেষ ৪১তম স্প্যানটি বসিয়ে দেয়ার পর পুরো সেতু দৃশ্যমান হয়ে যায়। এরপর রোডওয়ে স্লাব, রেলওয়ে স্লাব এবং সংযোগ সেতুতে গার্ডার স্থাপনের পর অবকাঠামোর কাজ প্রায় শেষ হয়। এরপর সেতুতে ছোট-বড় ২০ ধরনের কাজ ছিল। এর মধ্যে অন্যতম ছিল সেতুর দুই পাশে প্যারাপেট ওয়াল ও মাঝখানে বিভাজক বসানো এবং গ্যাসের পাইপ স্থাপন। এসব কাজ শেষ হয়ে গেছে ফেব্রুয়ারি মাসেই। এরপর বাতি লাগানোর জন্য সংযোগ সেতুর স্টিলের ল্যাম্পপোস্ট এবং নিচতলায় মেরামত কাজের জন্য ‘মনোরেল’ বসানো কাজও শেষ হয়েছে। এখন বাকি আছে আরও ১৪ ধরনের কাজ। এই ২০টি কাজকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ছকে তিন ধরনের রং ব্যবহার করা হয়েছে। যে ছয়টির কাজ শেষ সেগুলো সবুজ সঙ্কেত দেয়া হয়েছে। আর বাকি ১৪ ধরনের কাজ আবার বড় ও ছোট দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। বড় কাজগুলো লাল রং এবং ছোট কাজগুলো হলুদ রংয়ের সঙ্কেত দেয়া হয়েছে। বড় কাজ বাকি আছে মাত্র চারটি। এই চারটির মধ্যেই মূল সেতুতে ওয়াটার প্রুভিং, মূল সেতুর কার্পেটিং, সংযোগ সেতুর কার্পেটিং ও ৪০০ কেভি প্ল্যাটফর্ম। বাকি ১০টি ছোট কাজ। বড় চারটি কাজই এখন শেষ দিকে। সেতু বিভাগের ছকে মূল সেতুর উপরিভাগে ওয়াটার প্রুভিং তথা পানি নিরোধক ১৮ মে’র মধ্যে শেষ করার কথা রয়েছে। ওয়াটার প্রুভিং কাজ শুধু মূল সেতুতে। সংযোগ সেতুতে ঢাল থাকায় পানি জমে থাকা সুযোগ নেই। তাই ওয়াটার প্রুভিং প্রয়োজন হয়নি বলে জানিয়েছে সেতু বিভাগ। আর নদীর অংশে থাকা মূল সেতু ও তীরে থাকা সংযোগ সেতু অংশের কার্পেটিং আগামী ২৯ মে শেষ করার টার্গেট রয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা বলেছেন, চলতি এপ্রিল মাসেই ওয়াটার প্রুভিং ও কার্পেটিং শেষ হবে। এরপরই শুরু হবে কার্পেটিং। দক্ষিণাঞ্চল থেকে ঢাকার পথে বিদ্যুত সঞ্চালন লাইনের জন্যই ৪০০ কেভি টিএল প্ল্যাটফর্ম। ৪০০ কেভি টিএল প্ল্যাটফর্মের কাজ ২২ জুনের মধ্যে শেষ করার কথা। বাকি থাকা ছোট কাজগুলোর মধ্যে পিচ ঢালাইয়ের ওপর নির্ভরশীল। সেতু ও সংযোগ সেতুর সাইন-সঙ্কেত ও মার্কিং বসানো এবং পানি নিষ্কাশনের পাইপ বসানো। নিচতলায় রেললাইনের বিপরীত পাশে হেঁটে রেল লাইন সংস্কারের স্টিলের রাস্তা বা ‘রেলওয়ে ওয়াকওয়ে’ নির্মাণ কাজের অগ্রগতি ৫৫ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছোট কাজের মধ্যে বাকি থাকা এ্যালুমিনিয়ামের রেলিং স্থাপন এবং আর্কিটেকচারাল লাইটিং স্থাপন। এরমধ্যে এ্যালুমিনিয়ামের রেলিং স্থাপন কাজ জুনের মধ্যেই শেষ করা সম্ভব হবে। এ্যালুমিনিয়ামের রেলিং সমুদ্র পথে রওনা হয়েছে যুক্তরাজ্য থেকে। আর রেলিং পোস্ট রওনা হয়েছে ডুবাই থেকে। ছকে উল্লেখ করা হয়েছে ১৫ জুনের মধ্যে এই রেলিং মূল সেতু ও সংযোগ সেতুতে বসানোর সম্ভব হবে। তবে আর্কিটেকচারাল লাইটিংয়ের কাজটি হবে সেতু উদ্বোধনের পর। এটি মূলত দুবাইয়ের বুর্জ আল খলিফা টাওয়ারের মতো করে বিশেষ দিনে সেতুকে আলোকসজ্জিত করার কাজ। এ কাজ না হলেও যানবাহন চালুতে কোন বাধা নেই। কারণ ল্যাম্পপোস্ট থেকেই রাতে সেতুকে দিনের আলোরমতোই আলোকিত করবে। পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক মোঃ শফিকুর রহমান জানিয়েছেন, জুন টার্গেট রেখেই যথাসময়ে কাজ শেষ করতে চলছে কর্মযজ্ঞ। চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি ওপর সেতু কর্তৃপক্ষের চাপ রয়েছে ১৫ মের মধ্যে সব কাজ শেষ করার। তবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি ৩১ মের মধ্যে কাজ শেষ করার টার্গেটে কাজ করছে। তবে দায়িত্বশীল প্রকৌশরীরা জানিয়েছেন, ১৫ জুনের মধ্যেই তাই সকল কাজ সম্পন্ন করেই সেতুটি উদ্বোধন পর্যায়ে রাখা হবে। প্রধানমন্ত্রী ১৫ জুন থেকে ৩০ জুনের মধ্যেই তারিখ নিশ্চিত করবেন। সূত্রগুলো বলছে, প্রাধানমন্ত্রীর সামনের ক্যালেন্ডারে সেতু উদ্বোধনের সম্ভাব্য তারিখও মার্ক করা আছে। সেতুটি উদ্বোধনের দিন দেশব্যাপী উৎসবেরও পরিকল্পনা রয়েছে। ২০০৭ সালে একনেকে পাস হওয়া পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় ছিল ১০ হাজার ১শ’ ৬২ কোটি টাকা। ২০১১ সালে ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ২০ হাজার ৫শ’ ৭ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে দ্বিতীয় দফা সংশোধনের পর ব্যয় দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭শ’ ৯৩ কোটি টাকা। বর্তমানে কয়েক দফা সময় বৃদ্ধির পর এখন ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। প্রকল্প শেষ হওয়ার আগে আরেক দফা প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করতে হবে। পদ্মা সেতু এখন আর স্বপ্ন নয়। বাস্তবের দোরগোড়ায়।
×