ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ডিসেম্বরে বিদেশ গেছেন ১ লাখ ৩১ হাজার শ্রমিক ২০২১ সালে গেছেন ৮০ হাজার নারী শ্রমিক জানুয়ারিতে ১৭০ কোটি ডলার রেমিটেন্স এসেছে

জনশক্তি রফতানিতে রেকর্ড

প্রকাশিত: ২৩:১৭, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২২

জনশক্তি রফতানিতে রেকর্ড

রহিম শেখ ॥ জনশক্তি রফতানিতে সুদিন ফিরছে। পণ্য রফতানির মতো জনশক্তি রফতানির পালেও হাওয়া লেগেছে। করোনা মহামারীর মধ্যে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গত ডিসেম্বর মাসে ১ লাখ ৩১ হাজার ৩১৬ জন কাজ নিয়ে বিভিন্ন দেশে গেছেন। যার মধ্যে ১১ হাজার ৫৬৪ জন নারী শ্রমিক বিদেশে গেছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই এক মাসে এত বেশি জনশক্তি রফতানি হয়নি। এর আগে ২০১৭ সালের মার্চে ১ লাখের কিছু বেশি কর্মী বিদেশে গিয়েছিলেন। তবে নতুন করে শ্রমবাজার না খুললেও পুরনো বাজার থেকেই চাহিদা বাড়ছে। শীঘ্রই মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানো শুরু হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। এদিকে জনশক্তি রফতানি বাড়তে থাকায় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সেও গতি ফিরেছে। গত জানুয়ারি মাসে ১৭০ কোটি ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা ডিসেম্বরের তুলনায় ৮ কোটি ডলার বেশি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই বছরের মহামারীর ধাক্কা সামলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় চাঙ্গা হচ্ছে মধ্যপাচ্যের অর্থনীতি। সব মিলিয়ে তাদের কাজের লোকের চাহিদা বেড়েছে। তাই বাড়ছে জনশক্তি রফতানি। এ কারণে আগামী দিনগুলোতে দেশে রেমিটেন্সের পরিমাণও বাড়বে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে এ দেশ থেকে মোট ৬ লাখ ১৭ হাজার ২০৯ জন কর্মী গেছেন বিভিন্ন দেশে। নতুন করে শ্রমবাজার না খুললেও পুরনো বাজার থেকেই চাহিদা বাড়ছে। এছাড়া খুলতে যাচ্ছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারও। ইতোমধ্যে দুদেশের সরকারের মধ্যে আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয়েছে। সব মিলিয়ে নতুন বছরে জনশক্তি রফতানি আরও বাড়বে বলে মনে করছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘গত ডিসেম্বরে জনশক্তি রফতানির রেকর্ডে আমরা (সরকার) সত্যিই খুশি। শীঘ্রই মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানো শুরু হবে। এবার কঠোরভাবে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর বিষয়টি মনিটর করব। এরই মধ্যে এ বিষয়ে সমঝোতা স্মারকে সই হয়েছে। এবার সম্পূর্ণ সিন্ডিকেটমুক্ত রেখে কম অভিবাসন খরচে কর্মী পাঠানোর চেষ্টা করব। ফলে সব মিলিয়ে জনশক্তি রফতানিতে নতুন মাত্রা যোগ হবে। আরও বেশি রেমিটেন্স দেশে আসবে।’ বিএমইটির তথ্যে দেখা যায়, গত বছর যে সোয়া ৬ লাখের মতো কর্মী বিদেশে গেছেন, তাদের মধ্যে জানুয়ারি মাসে গেছেন ৩৫ হাজার ২৩২ জন, ফেব্রুয়ারি মাসে ৪৯ হাজার ৫১০ জন এবং মার্চে ৬১ হাজার ৬৫৩ জন। এপ্রিলে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ার পর গতি কমে যায়। ওই মাসে ৩৪ হাজার ১৪৫ জন কর্মী গেছেন। মে মাসে গেছেন ১৪ হাজার ২০০ জন। জুন মাসে করোনার সংক্রমণ কমে আসতে থাকলে আবার সংখ্যা বাড়তে থাকে। জুনে গেছেন ৪৮ হাজার ৫৬৭ জন, জুলাই মাসে ১২ হাজার ৩৮০ জন, আগস্টে ১৯ হাজার ৬০৪ জন, সেপ্টেম্বর মাসে ৪২ হাজার ৮ জন গেছেন। অক্টোবরে ৬৫ হাজার ২৩৩ জন, নবেম্বরে ১ লাখ ২ হাজার ৮৬১ জন এবং ডিসেম্বরে সবচেয়ে বেশি কর্মী গেছেন ১ লাখ ৩১ হাজার ৩১৬ জন। ২০২১ সালে মোট জনশক্তি রফতানির মধ্যে ৪ লাখ ৫৭ হাজার ২২৭ জনই গেছেন সৌদি আরবে। অর্থাৎ ৭৪ শতাংশই গেছেন সৌদি আরবে। সংযুক্ত আরব আমিরাতে গেছেন ২৯ হাজার ২০২ জন, কুয়েতে ১ হাজার ৮৪৮ জন, ওমানে ৫৫ হাজার ৯ জন, কাতারে ১১ হাজার ১৫৮ জন, বাহরাইনে মাত্র ১১ জন, লেবাননে ২৩৫ জন, জর্ডানে ১৩ হাজার ১১৬ জন, লিবিয়ায় ৩ জন, সুদানে ৩৯ জন, মালয়েশিয়ায় ২৮ জন, সিঙ্গাপুরে ২৭ হাজার ৮৭৫ জন, দক্ষিণ কোরিয়ায় ১০৮ জন, ইউকেতে ১২৩ জন, ইতালিতে ৬৫৩ জন, জাপানে ৩ জন, ব্রুনাইয়ে ১২ জন, মরিশাসে ২১৫ জন এবং ইরাকে গেছেন ৫ জন। এদিকে নারী জনশক্তি রফতানিও আগের বছরগুলোর চেয়ে বেড়েছে। ২০২১ সালে ৮০ হাজার ১৪৩ নারী কর্মী কাজ নিয়ে বিদেশে গেছেন। জানুয়ারিতে গেছেন ৪ হাজার ৬৬৯ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৬ হাজার ৩৮২ জন, মার্চে ৮ হাজার ২৯৭ জন, এপ্রিলে ৫ হাজার ২৩৯ জন, মে মাসে ৪ হাজার ২৩৮ জন। জুনে ৬ হাজার ৯০১ জন, জুলাইয়ে ১ হাজার ৬৯১ জন, আগস্টে ৩ হাজার ৬৫৯ জন, সেপ্টেম্বরে ৮ হাজার ৫৩ জন, অক্টোবরে ৮ হাজার ৪৮৮ জন এবং নবেম্বরে ১০ হাজার ৯৬২ জন নারী কর্মী কাজ নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গেছেন। সবশেষ ডিসেম্বরে গেছেন সবচেয়ে বেশি ১১ হাজার ৫৬৪ জন। নারী কর্মীদের মধ্যেও সবচেয়ে বেশি সৌদি আরবে গেছেন ৪৬ হাজার ৩৬১ জন। এর পরে জর্ডানে ১১ হাজার ৬৯৭ জন, আর ওমানে গেছেন ৭ হাজার ৬৪৫ জন নারী কর্মী। গত বছর এই তিন দেশেই সবচেয়ে বেশি নারী কর্মী পাঠানো গেছে। জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ আবুল বাশার বলেন, ‘পণ্য রফতানির মতো জনশক্তি রফতানিতেও দেশে সুবাতাস বইছে। ডিসেম্বরে আমরা জনশক্তি রফতানিতে রেকর্ড গড়েছি। এরই মধ্যে দুটি সুসংবাদ এসেছে। ‘তিন বছর পর মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার উন্মুক্ত হয়েছে; ফের শ্রমিক যাবে সেখানে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনীতি চাঙ্গা হয়েছে। সেখানে আরও বেশি কর্মী যাবে; আরও বেশি রেমিটেন্স আসবে। আরেকটি সুখবর হচ্ছে, সরকার গত ১ জানুয়ারি থেকে রেমিটেন্সের প্রণোদনা ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে আড়াই শতাংশ করেছে। সব মিলিয়ে রেমিটেন্সে একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ইতোমধ্যে আমরা সেই প্রভাব দেখতে পাচ্ছি।’ নারীদের কাজের পরিবেশ ও নিরাপত্তা দিতে পারলে আরও অধিকসংখ্যক কর্মী শ্রমবাজারে পাঠানো সম্ভব বলে মনে করেন আবুল বাশার। ২০১৯ সালে মহামারী করোনার সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর মুখ থুবড়ে পড়ে বাংলাদেশের শ্রমবাজার। মহামারীর আগের বছর ২০১৯ সালে ৭ লাখ ১৫৯ জন কর্মী কাজ নিয়ে বিদেশে গিয়েছিলেন। করোনার ধাক্কায় ২০২০ সালে তা ২ লাখ ১৭ হাজার ৬৬৯ জনে নেমে আসে। তবে ২০২১ সালে ধীরে ধীরে তা আবার আলোর মুখ দেখতে শুরু করে; যা বছরজুড়েই গতিতে ছিল। মহামারীর আগের সময়ের গতিতে ফিরেছে। বিএমইটির রেকর্ড অনুযায়ী, ১৯৭৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত মোট ১ কোটি ৩০ লাখ বাংলাদেশী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজে গেছেন। এই বিশালসংখ্যক জনশক্তি পাঠানোর ক্ষেত্রে শ্রমিকদের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বেসরকারী গবেষণা সংস্থা রিফিউজি এ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্স ইউনিটের (রামরু) তথ্য মতে, গত বছর যে সংখ্যক কর্মী বিদেশে গেছেন, তাদের ৭৪ শতাংশই অদক্ষ। আর ৩ দশমিক ৬ শতাংশ আধা দক্ষ। আর দক্ষ কর্মীর সংখ্যা ছিল ২৩ দশমিক ৩ শতাংশ। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক মঞ্জুর হোসেন বলেন, ‘জনশক্তি রফতানি বাড়ায় এখন প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের পরিমাণও বাড়বে। এ কথা ঠিক যে, চলতি অর্থবছরে রেমিটেন্সপ্রবাহে ধীরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে আগের যে কোন অর্থবছরের সঙ্গে তুলনা করলে এই রেমিটেন্সকে কিন্তু কম বলা যাবে না। তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতিতেও গতি ফিরে এসেছে। এসব কিছুর প্রভাব রেমিটেন্সে পড়বে।’ রেমিটেন্সে গতি ॥ এদিকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স প্রবাহে ফের গতি ফিরছে। টানা পাঁচ মাস কমার পর গত ডিসেম্বরে কিছুটা বেড়েছিল অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক। নতুন বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে সেই গতি আরও বেড়েছে। জানুয়ারি মাসে ১৭০ কোটি ৪৪ লাখ (১.৭৪ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের সাত মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ১ হাজার ১৯৪ কোটি (১১.৯৪ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, ‘প্রবাসী শ্রমিকরা কাজে ফেরায় এবং বাড়িতে টাকা পাঠাতে শুরু করায় রেমিটেন্স আবারও বাড়ছে। এছাড়াও লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকার প্রণোদনার পরিমাণ ৫০ শতাংশ বাড়িয়েছে।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের রেমিটেন্স সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২১ সালে মোট ২ হাজার ২০৭ কোটি ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এক পঞ্জিকা বছরে এত বেশি রেমিটেন্স আগে কখনও আসেনি। এর আগের সর্বোচ্চ রেমিটেন্স এসেছিল ২০২০ সালে ২ হাজার ১৭৪ কোটি ডলার। ২০১৯ সালে রেমিটেন্স আসে ১ হাজার ৮৩৩ কোটি ডলার। এর আগে ২০১৮ সালে রেমিটেন্স এসেছিল এক হাজার ৫৫৫ কোটি ডলার। ২০১৭ সালে এসেছিল এক হাজার ৩৫৩ কোটি ডলারের সমপরিমাণ রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এর আগের বছর ২০১৬ সালে ছিল এক হাজার ৩৬১ কোটি ডলার। ২০১৫ সালে এসেছে এক হাজার ৫৩১ কোটি ডলার। আর ২০১৪ সালে রেমিটেন্সের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৪৯২ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ডিসেম্বরে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের পরিমাণ ১৬২.৯ কোটি ডলার, যা টাকার হিসাবে (এক ডলার সমান ৮৫ টাকা ধরে) প্রায় ১৩ হাজার ৮৪৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর আগের মাস নভেম্বরে দেশে ১৫৫ কোটি ৩৭ লাখ (১.৫৫ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার রেমিটেন্স আসে। টাকার হিসাবে যার পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার ২০৬ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। সে হিসাবে ডিসেম্বরে ৬৪০ কোটি টাকা বেশি এসেছে। এর আগের মাস অক্টোবরে সেপ্টেম্বরের তুলনায় প্রবাসী আয় কমে। অক্টোবরে ১৬৪ কোটি ৬৮ লাখ ডলার দেশে পাঠান প্রবাসীরা। টাকায় যার পরিমাণ ১৩ হাজার ৯৯৭ কোটি ৮০ লাখ টাকার (৮৫ টাকা ধরে) বেশি। সেপ্টেম্বরে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ছিল ১৭২ কোটি ৬৭ লাখ ডলার বা ১৪ হাজার ৬৭৬ কোটি ৯৫ লাখ টাকা।
×