ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জ্বালানি পরিবহনে নেই বিএসসির পর্যাপ্ত ভেসেল

প্রকাশিত: ২৩:০৩, ২৯ জানুয়ারি ২০২২

জ্বালানি পরিবহনে নেই বিএসসির পর্যাপ্ত ভেসেল

হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ বাড়ছে শিল্পায়ন, বাড়ছে জ্বালানির চাহিদা। ক্রমবর্ধমান গ্যাসের চাহিদা মেটাতে কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়িতে হয়েছে এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) টার্মিনাল। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রের জন্য হচ্ছে কোলজেটি। প্রতিবছর ক্রুড ও তরল জ্বালানি আমদানির পরিমাণও বিপুল। সরকারী আমদানির একটি অংশ জাতীয় পতাকাধারী জাহাজে পরিবহনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের বহরে মাত্র আটটি জাহাজ। বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি পরিবহনের জন্য ১২টি জাহাজ সংগ্রহের পরিকল্পনা থাকলেও উল্লেখ করার মতো অগ্রগতি নেই। আর নিজস্ব ভেসেল না থাকায় সুযোগ নিচ্ছে বিদেশী শিপিং কোম্পানিগুলো। জাহাজ ভাড়া বাবদ শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। নতুন জাহাজ কেনার উদ্যোগ বহুদিনের। কিন্তু পরিকল্পনা অনুযায়ী রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটির জাহাজ সংগ্রহের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে আর কতকাল লাগবে, সে প্রশ্ন দীর্ঘদিনের। কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে নির্মিত ভাসমান টার্মিনালে এলএনজিবাহী প্রথম জাহাজ ভিড়ে ২০১৮ সালের ১৪ এপ্রিল। ‘এক্সিলেন্স’ নামের বিশেষায়িত এ জাহাজে তরলীকৃত গ্যাস আমদানির মাধ্যমে এলএনজিযুগে প্রবেশ করে বাংলাদেশ। প্রথম চালানে এসেছিল ৩৬ লাখ ঘনমিটার এলএনজি। এরপর থেকে চার বছরে ১৭৯টি জাহাজের মাধ্যমে ২৫ দশমিক ৩৩ মিলিয়ন ঘনমিটার এলএনজি আমদানি হয়। এক্ষেত্রে প্রতিবছরে বিপুল পরিমাণ জাহাজ ভাড়া গুনতে হচ্ছে সরকারকে, যা বৈদেশিক মুদ্রায় পেয়ে যাচ্ছে বিদেশী কোম্পানিগুলো। অত্যন্ত সম্ভাবনার একটি খাত হওয়া সত্ত্বেও বিএসসির নতুন জাহাজ সংগ্রহ পড়ে আছে দীর্ঘসূত্রতায়। শুধু এলএনজিই নয়, পায়রা, মাতারবাড়ি ও রামপালে বাস্তবায়নাধীন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র চালু হলে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ কয়লাও আমদানি করতে হবে। এছাড়া পরিবহনের জন্য ক্রুড ও ডিজেলসহ বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি আমদানি তো আছে। এ আমদানি করে থাকে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)। সতেরো কোটি মানুষের এ দেশের চাহিদা মেটাতে জ্বালানির প্রায় পুরোটাই আমদানি হয়ে থাকে সরকারীভাবে। ভাড়া বাবদ বিপুল আয়ের সুযোগ থাকলেও বিএসসি তথা সরকার তা পাচ্ছে না। এই সুযোগটি নিচ্ছে বিদেশী কোম্পানিগুলো। বিপিসি সূত্র জানায়, বাস্তবায়নাধীন বড় আকারের তিনটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রের ভবিষ্যত চাহিদা বিবেচনায় ৮০ হাজার টন ধারণক্ষমতার দুটি মাদার ভাল্ক ক্যারিয়ার ক্রয় করার পরিকল্পনা রয়েছে। এলএনজি পরিবহনের জন্য সংগ্রহ করা হবে ৬টি বিশেষায়িত জাহাজ। এরমধ্যে ১ লাখ ৪০ হাজার ঘনমিটার ধারণ ক্ষমতার দুটি, ১ লাখ ৭৪ হাজার ঘনমিটার ধারণ ক্ষমতার দুটি এবং ১ লাখ ৮০ হাজার ঘন মিটার ধারণ ক্ষমতার দুটি জাহাজ। এছাড়া রয়েছে ৮০ হাজার টন ধারণ ক্ষমতার দুুটি মাদার প্রোডাক্ট অয়েল ট্যাঙ্কার সংগ্রহের পরিকল্পনাও আছে। বিএসসির নির্বাহী পরিচালক (বাণিজ্যিক) ড. পীযুষ দত্ত জনকণ্ঠকে জানান, পরিকল্পনার ১২ জাহাজের মধ্যে ৬টি সংগ্রহের প্রক্রিয়া কিছুদূর এগিয়েছে। চীনের সঙ্গে জি টু জি প্রক্রিয়ায় এ জাহাজ সংগ্রহের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই হয়েছে। টেকনিক্যাল ও কমার্সিয়াল দিকগুলোও অনেকটাই এগিয়েছে। তবে জাহাজ সংগ্রহের প্রক্রিয়া একটু দীর্ঘমেয়াদী হয়ে থাকে। কারণ অনুমোদনের পর কার্যাদেশ প্রদান করা হলেও নির্মাণে ব্যয় হয় অন্তত ১৮ থেকে ২০ মাস। যে ৬টি জাহাজ সংগ্রহের প্রক্রিয়া এগিয়েছে তন্মধ্যে ২টি প্রোডাক্ট ক্যারিয়ার, ২টি বাল্ক কার্গো এবং ২টি ক্রুড বহনের জন্য বিশেষায়িত ভেসেল। তিনি জানান, বর্তমানে যে ৮টি জাহাজ বিএসসির বহরে রয়েছে সেগুলোর মধ্যে ৬টি জাহাজই মূল শক্তি, যা গভীর সমুদ্রপথে পণ্য আনা নেয়ার কাজে ব্যবহৃত হয়। অবশিষ্ট দুটি লাইটারিং কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিএসসির এ কর্মকর্তা স্বীকার করেন যে, রাষ্ট্রায়ত্ত এ সংস্থার যে আকার তাতে অন্তত অর্ধশত জাহাজ থাকা প্রয়োজন। বর্তমানে যে জাহাজগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে সেগুলোর সক্ষমতা বিএসসিকে লাভজনক পর্যায়ে রেখেছে। কারণ, এ জাহাজগুলো আগের জাহাজগুলো থেকে আকারে কয়েকগুণ বড়। ফলে পণ্য ধারণক্ষমতাও বেশি। বিপিসি প্রতিবছর প্রায় ৩৫ লাখ মেট্রিক টন জ্বালানি আমদানি করে। এরমধ্যে রয়েছে ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিট নির্মাণ কাজ শেষ হলে নিজ দেশেই পরিশোধন ক্ষমতা হবে দ্বিগুণ। ফলে ক্রুড আমদানির পরিমাণ আরও বাড়বে। জ্বালানি সেক্টরে আমদানি প্রতিনিয়ত বাড়ছে। অথচ ক্রমবর্ধমান এই বিপুল আমদানির তেল পরিবহনে সক্ষমতা বৃদ্ধি করেনি বিএসসি। এলএনজিসহ জ্বালানি পরিবহনে ১২টি জাহাজ সংগ্রহের উদ্যোগ থাকলেও বছরের পর বছর ধরে তা রয়ে গেছে প্রাথমিক পরিকল্পনার মধ্যে। বিএসসির পক্ষ থেকে জানানো হয়, এই আটটি জাহাজ পরিচালনা করেই সমাপ্ত ২০২০-২০২১ অর্থবছরে নিট মুনাফা হয়েছে ৭২ কোটি টাকা। সংস্থাটির পরিচালনা আয় ২৭৪ কোটি ২৭ লাখ টাকা এবং অন্যান্য খাতে আয় ৪৮ কোটি ৭০ লাখ টাকা। মোট ৩২২ কোটি ৯৭ লাখ টাকা থেকে ২২৭ কোটি ২৭ লাখ টাকা বাদ দিলে নিট আয় দাঁড়ায় ৭২ কোটি ২ লাখ টাকা। কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন জাহাজ সংগ্রহের বিশেষ করে জ্বালানি তেল পরিবহনের বিশেষায়িত ভেসেল ও অয়েল ট্যাঙ্কার সংগ্রহের পরিকল্পনাটি অত্যন্ত সময়োপযোগী। অর্থের সংস্থান না হওয়ায় তা কেনা সম্ভব হচ্ছে না। জাহাজ সংগ্রহের এ পরিকল্পনা কয়েক বছর আগের। কিন্তু আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে অনুমোদন না মেলায় অতি প্রয়োজনীয় এ কাজটি করা সম্ভব হচ্ছে না। বিএসসির বহরে জাহাজসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে ভাড়া বাবদ বৈদেশিক মুদ্রা যেমন সাশ্রয় হবে, তেমনিভাবে এতে কর্মসংস্থান হবে দেশীয় নাবিকদের।
×