ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

২০ সেটের মধ্যে চলছে মাত্র ৭টি

দ্রুত যাতায়াতের স্বপ্ন দেখানো ডেমু ট্রেন এখন বোঝা

প্রকাশিত: ২২:৫৯, ২৯ জানুয়ারি ২০২২

দ্রুত যাতায়াতের স্বপ্ন দেখানো ডেমু ট্রেন এখন বোঝা

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস ॥ ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের নিকটবর্তী এলাকার অফিসগামী যাত্রীদের দ্রুত যাতায়াতের স্বপ্ন দেখিয়েছিল ডেমু ট্রেন। অথচ বাংলাদেশ রেলওয়ের আনা এই ট্রেন এখন বোঝা। মিটারগেজ সেকশনে কম গতিসম্পন্ন ট্রেন প্রত্যাহার করে দ্রুতগতি সম্পন্ন ট্রেন প্রতিস্থাপন করার উদ্দেশ্যে ডেমু ট্রেনের যুগে বাংলাদেশ প্রবেশ করেছিল। কিন্তু তা পূরণ তো হয়ইনি, উল্টো টাকা জলে গেছে সরকারের। চীন থেকে কেনা ২০ সেট ডেমুর (ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট) মধ্যে বর্তমানে সচল মাত্র ৭ সেট। এসব ট্রেনের আয়ুষ্কাল ২০ থেকে ২৫ বছর বলা হলেও তা অকেজো হয়ে পড়ে চলাচলের ৫ বছরের মধ্যে। কোন ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই না করে ট্রেনগুলো কেনার পেছনে রয়েছে সরকারী অর্থ অপচয়ের অভিযোগ। যদিও দায়িত্বে থাকা কেউ এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি নয়। এমনকি কোন্ রুটে কতটি ট্রেন চলছে তা বলতেও নারাজ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। সূত্র নিশ্চিত করেছে, চীন থেকে সরঞ্জাম কিনে এসে জোড়াতালি দিয়ে আবারও ট্রেনগুলো কয়েকদিনের জন্য চলাচল উপযোগী করতে চেষ্টা করছে রেলওয়ে। কিন্তু পুরো ট্রেনে বিদেশী সফটওয়্যার থাকায় মেরামত করেও সুবিধা করতে পারছে না দেশের প্রকৌশলীরা। তাই বেশিরভাগ ডেমুর আস্তানা এখন মুমূর্ষু অবস্থায় ওয়ার্কশপে। আর যে কয়েকটি মোটামুটি সচল, তা কয়েকদিন পরপর মেরামত করে জোড়াতালি দিয়ে চালাতে হচ্ছে। প্রসঙ্গত, এসব ট্রেন যে বাংলাদেশের জন্য উপযোগী নয়, তা শুরু থেকেই বলে আসছিল বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কর্ণপাত না করে ২০১৩ সালে ৬৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে চীনের একটি কোম্পানি থেকে কিনে ডেমু। স্বল্প দূরত্বে উন্নত যাত্রীসেবা দিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করার জন্য ডেমু কেনা হলেও তা সরবরাহ করা কোম্পানির নিয়ম না মেনে মাত্রাতিরিক্ত দূরত্বে চলাচল করায় নষ্ট হয়ে পড়ে এসব ট্রেন। এত দূরত্বের কারণে গন্তব্য পৌঁছার সিডিউলও রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে। স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম থেকে ট্রেনের সিঁড়ির অতিউচ্চতা এবং গরমে অস্বস্তিবোধ করায় যাত্রীবান্ধব ট্রেন হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি ডেমু। যার কারণে ডেমু ট্রেন ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়ে। কখন, কোন্ সময়ে, কোন্ রুটে ডেমু দেখা যায় তা বলতে পারে না স্থানীয়রাও। তাই যাত্রীদের আস্থাও অর্জন করতে পারেনি এই ট্রেন। প্রতিটি ডেমুতে ১৪৯ জন বসে এবং ১৫১ জন দাঁড়িয়ে যাতায়াত করা যেত। কিন্তু উদ্বোধন পরবর্তী ধারণক্ষমতার চেয়ে দ্বিগুণের বেশি যাত্রী নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত দূরত্বে যাত্রী বহন করতে থাকে এসব ট্রেন বিভিন্ন বিভাগের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে। যার ফলে টানা দূরত্বে চলাচল করায় ত্রুটি দেখা দেয়। উল্লেখ্য, প্রতিসেট ডেমুতে সামনে-পেছনে দুটি ইঞ্জিনসহ তিনটি কোচ থাকে। ইঞ্জিন যেখানে আছে সেই কোচেও যাত্রী পরিবহন করা হয়। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল কমলাপুর-নারায়ণগঞ্জ রুটে দুই সেট ট্রেন দিয়ে এর যাত্রা শুরু করে। এরপর ঢাকা-টঙ্গী, ঢাকা-জয়দেবপুর, জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ, সিলেট-আখাউড়া, কমলাপুর-আখাউড়া, চট্টগ্রাম-কুমিল্লা, নোয়াখালী-লাকসাম, লাকসাম-চাঁদপুর, চট্টগ্রাম-নাজিরহাট, পার্বতীপুর-লালমনিরহাট, পার্বতীপুর-পঞ্চগড় রুটে এবং সর্বশেষ চট্টগ্রাম-বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম- দোহাজারী বাকি ট্রেনগুলো চালু হয়। আমদানির পর পূর্বাঞ্চলে ১৮ সেট ট্রেন এবং বাকি দুই সেট পশ্চিমাঞ্চলে বরাদ্দ দেয়া হয়। এরমধ্যে পশ্চিমাঞ্চলে ডেমু চলাচল বন্ধ। আর পূর্বাঞ্চলে ১৮ সেটের মধ্যে সচল আছে ৭ সেট। খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, করোনা পরবর্তী ডেমু চলাচল আরও অনিয়মিত হয়ে পড়ে। বেশ কয়েকটি রুটে এখনও বন্ধ। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে বর্তমানে ১৮ সেটের মধ্যে ঢাকা বিভাগে শুধুমাত্র ঢাকা-টঙ্গী রুটে ১ সেট চলে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে যে ২ সেট চলত তা এখন বন্ধ। ঢাকা-কুমিল্লা, ঢাকা-জয়দেবপুর ও ঢাকা-টঙ্গী রুটেও বন্ধ। আখাউড়া-সিলেট এবং ময়মনসিংহ রুটেও বন্ধ। তবে চট্টগ্রাম বিভাগের মধ্যে চট্টগ্রাম-নাজিরহাট রুটে ২ সেট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ সেট, চট্টগ্রাম-দোহাজারী রুটে ১ সেট চালু। উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে কেনা ডেমু ট্রেন সংস্কার করে চট্টগ্রামে গত বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম-দোহাজারী ও চট্টগ্রাম-পটিয়া রুটে চলাচলের জন্য উদ্বোধন করেন রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের উর্ধতন এক প্রকৌশলী জানান, পূর্বাঞ্চলের ১৮ সেটের মধ্যে ৬সেট মোটামুটি রানিং থাকে। তবে এরমধ্যেও অতিরিক্ত দূরত্বের রুটে ডেমুগুলোতে সমস্যা দেখা দিলে বন্ধ রাখতে হয়। কিছু সরঞ্জাম সংস্কার করে কয়েকটি ট্রেন চলাচল করলেও বেশিরভাগ অকেজো ডেমু সচল করা যাচ্ছে না। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো এসব ট্রেনের ইঞ্জিন থেকে কোচ পর্যন্ত সকল কিছুই সফটওয়্যার দ্বারা পরিচালিত হয়। যার কারণে চাইলেও যে মেরামত কিংবা খুলে যে কিছু করা যাবে, এমন না। নিজস্ব জনবল আর অভিজ্ঞ টেকনিশিয়ান দ্বারা এসব পুরোপুরি মেরামত সম্ভব নয়। নষ্ট হয়ে পড়া ডেমু সচল করতে হলে চীন থেকে সরঞ্জাম আনার বিকল্প নেই। কিন্তু এসব যন্ত্রাংশ না কিনে, মেরামত না করে এসি কোচ কেনা সম্ভব। আপাতত জোড়াতালি দিয়ে মেরামত করে সচল রাখা ছাড়া রেলওয়ের কিছু করার নেই। এ বিষয়ে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর হোসেনের সঙ্গে তিন দিন যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। রেলওয়ের বাণিজ্যিক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এসব ট্রেনে নারী ও বয়স্ক যাত্রীদের অনাগ্রহ ছিল। কেননা সিঁড়ি থেকে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের উচ্চতা ছিল আড়াই ফুট, এই সমস্যার কারণে ওঠা-নামা বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। এছাড়া এসব ট্রেনে বসামাত্র যাত্রীদের অত্যধিক গরমে শ্বাস নিতে কষ্ট হতো। বাংলাদেশ রেলওয়ে ২০১৩ সালে চীন থেকে ৬৮৬ কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা হয়েছিল ২০ সেট মিটারগেজ ডেমু। চীনের সিএনআর তানসান রেলওয়ে ভেহিকল কোম্পানি লিমিটেড থেকে এসব ডেমু কিনতে প্রথমে ব্যয় ধরা হয় ৪২৬ কোটি টাকা, পরবর্তীতে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৫৪ কোটিতে। অথচ ২৫ বছর আয়ুষ্কালের পরিবর্তে মাত্র ৫-৭ বছরে এসব ট্রেন অকেজো হয়ে পড়ে। এখন যে ৭ সেট ট্রেন সচল রয়েছে এসবও চলছে লক্কড়ঝক্কড়ভাবে। জানা গেছে, ২০২১ সাল পর্যন্ত ডেমু থেকে যে পরিমাণ আয় হয়েছে তার পুরো ব্যয় হয়েছে ট্রেন ব্যবস্থাপনায়। উঠে আসেনি ব্যয় হওয়া রেলওয়ের টাকাও। পূরণ হয়নি যাত্রীদের সেবার মান। উল্টো আগ্রহ হারিয়ে যাত্রীরা সড়কপথেই যাতায়াত বেশি করছে। এখন, কেন এত টাকা জলে গেল তার উত্তর কেউ দিতে রাজি নয়। এজন্য কোন কর্মকর্তা যাতে সাংবাদিকদের কাছে কোন তথ্য না দেয় এমন নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, মূলত ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরত্বের যোগাযোগ সুবিধার জন্য ডেমু উপযোগী। কিন্তু বেশ কিছু অজানা কারণে এবং হঠকারিতায় এসব ট্রেন ১৫০ কিলোমিটার দূরত্বেও নিয়ে গেছে কর্তৃপক্ষ। মূলত এ কারণেই ট্রেনগুলো অল্পদিনে বিকল হয়ে পড়ে। এর বাইরেও এসব ট্রেন যে বাংলাদেশের জন্য উপযোগী নয়। চীন আর বাংলাদেশের রেলযোগাযোগ ব্যবস্থা এক নয় জেনেও রেলওয়ের বেশ কিছু উর্ধতন কর্মকর্তা অর্থ লোপাটের জন্য কিনে আনে বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রসঙ্গত, ৪২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০ সেট ডেমু ট্রেন কিনতে রেলওয়ে যে চুক্তি করে তার সঙ্গে ৩০ কর্মকর্তার বিদেশ ভ্রমণ এবং আমদানির শুল্কসহ ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৬৫৪ কোটি টাকায়। তবে যে স্বপ্ন নিয়ে এসব ডেমু কেনা হয়েছিল তা যাত্রীসেবা দিতে বঞ্চিত হয়। এমন অদূরদর্শী পরিকল্পনার ফলে একের পর এক সরকারের উদ্যোগগুলো ভেস্তে যাচ্ছে; এর পেছনে রেলওয়ের অসাধু কর্মচারীরা জড়িত। এদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে দুদকে অভিযোগ পৌঁছেছে। রেলের দুর্নীতি-অনিয়ম নিয়ন্ত্রণে সরকারও বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে।
×