ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর প্রতিষ্ঠা কাজের ৫৭ ভাগ অগ্রগতি

আগামী জুনে উৎপাদনে যাবে দেশী-বিদেশী ৬ প্রতিষ্ঠান

প্রকাশিত: ২২:৫৩, ২৯ জানুয়ারি ২০২২

আগামী জুনে উৎপাদনে যাবে দেশী-বিদেশী ৬ প্রতিষ্ঠান

হাসান নাসির/ রাজিব মজুমদার, চট্টগ্রাম ॥ চলতি বছরের প্রথমার্ধেই উৎপাদনে যেতে প্রস্তুত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে গড়ে ওঠা অন্তত অর্ধডজন শিল্প প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রামের মীরসরাই, সীতাকু- ও ফেনীর সোনাগাজীর চরাঞ্চলে ক্রমেই উদ্ভাসিত হচ্ছে এই শিল্পশহর, যা শিল্পায়নের মাধ্যমে কর্মসংস্থান যেমন সৃষ্টি করবে তেমনিভাবে রফতানি আয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে দেবে অনেক বড় একটি ধাপ। বিশাল আয়তন নিয়ে গড়ে ওঠা এই শিল্পনগর পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে শুধু এখান থেকেই বছরে কমপক্ষে ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রফতানি হবে। করোনা পরিস্থিতির কারণে বাস্তবায়নে গত বছর কিছুটা ধীরগতি থাকলেও এখন কাজে বেশ গতি এসেছে। প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি প্রায় ৫৭ শতাংশ বলে জানিয়েছে বেজা কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ বেজা) সূত্র জানায়, গত বছরই ৫টি প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে যাবার প্রক্রিয়ায় চলে এসেছিল। কিন্তু কোভিড পরিস্থিতিতে তা আর সম্ভব হয়নি। চলতি বছরে প্রায় ১৫টি প্রতিষ্ঠান তাদের কারখানা স্থাপনের কাজ দ্রুত এগিয়ে নিচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর এখন দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয় একটি স্থান। দেশের বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো ভূমির জন্য এমনই হুমড়ি খেয়ে পড়েছে যে, এই শিল্পনগরে একটি প্লট থাকা যেন এক ধরনের মর্যাদার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষয়টি এমনই যে, মীরসরাইয়ে একটি শিল্পপ্লট থাকবে না, তা কী করে হয়। সরেজমিনে দেখা যায়, আধুনিক নির্মাণশৈলীর ছোঁয়া বিভিন্ন কারখানার ভবনগুলোতে। কোথাও টাঙানো হয়েছে কারখানার সাইনবোর্ড। কোথাও বালুমাটি দিয়ে চলছে নিচু জমি ভরাটের কাজ। বিশাল এলাকায় নানাপ্রান্ত থেকে ভেসে আসছে নির্মাণ কাজের বিকট শব্দ। ধীরে ধীরে ঢেকে যাওয়া বালুচরে মাথা তুলতে শুরু করেছে কারখানার ভবন। বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকা সন্দ্বীপ চ্যানেলের পাশে ১৩৭ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে গড়ে তোলা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর। বেজার মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, ৩৩ হাজার ৮০৫ একর আয়তনের এ শিল্পনগরের ৪১ শতাংশ অর্থাৎ ১৪ হাজার একরে থাকবে শুধু শিল্পকারখানা। বাকি ৫৯ শতাংশ এলাকার মধ্যে খোলা জায়গা, বনায়ন, বন্দর সুবিধা, আবাসন, স্বাস্থ্য, প্রশিক্ষণ ও বিনোদন কেন্দ্র থাকবে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য ২৫ দশমিক ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক তৈরি ও ৪৫ একর জমিতে হবে জলাধার। পরিবেশ সুরক্ষার জন্য একটি সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট ও চারটি কেন্দ্রীয় তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য পাইপলাইন স্থাপন করা হবে। অর্থনৈতিক অঞ্চলে নতুন করে ফায়ার স্টেশনসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি, দুটি কারখানা ভবন, ফুটপাথ, গাড়ি মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ, তিনটি আবাসিক ভবন, একটি মসজিদ এবং একটি মেডিক্যাল সেন্টার নির্মাণসহ কয়েকটি নতুন অঙ্গ সংযোজন করা হবে। মূলত সংশোধনের মাধ্যমে এ অর্থনৈতিক অঞ্চল থেকে আরও বেশি প্রত্যাশা করছে সরকার। জানা যায়, মূল প্রকল্পের ব্যয় ছিল ৭৫০ কোটি ৫৮ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। এখন প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়াচ্ছে এক হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। মূল অনুমোদিত প্রকল্পটি ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২১ সালের জুন মেয়াদে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা ছিল। এখন প্রকল্পের মেয়াদ বেড়ে ২০২৩ সালের জুন নাগাদ করা হয়েছে। বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াজাতকরণ কর্তৃপক্ষ (বেপজা) জানিয়েছে, বেপজার আওতায় দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত আটটি ইপিজেডে শিল্পপ্লট ও নিজস্ব কারখানা ভবনের ফ্লোরস্পেস বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ভাড়ায় বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বর্তমানে ইপিজেডগুলোতে কোন শিল্পপ্লট খালি নেই। বিনিয়োগের ক্রমবর্ধমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম বা চট্টগ্রামের অদূরে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন জরুরী হয়ে পড়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ শুরু করা হয়। রফতানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল স্থাপনের জন্য এক হাজার ১৫০ একর জমি বরাদ্দের বিষয়ে বেপজা ও বেজার মধ্যে ‘ডেভেলপমেন্ট এ্যাগ্রিমেন্ট’নামে সমঝোতা স্মারকও সই হয়েছে। এর আওতায় ‘অর্থনৈতিক অঞ্চল, মীরসরাই’ প্রকল্প বাস্তবায়নে এক হাজার ১৩৮ একর জমি ৫০ বছরের জন্য লিজ পেয়েছে বেপজা। ‘মীরসরাই বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চল-১’ প্রকল্পে এখন পর্যন্ত ৮১ শিল্প প্রতিষ্ঠান ৬৪৩টি শিল্প প্লটের চাহিদার কথা জানিয়েছে। এ পর্যন্ত ৫৮৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব পাওয়া গেছে। প্রস্তাবিত কর্মসংস্থান এক লাখ ২০ হাজার ২৯৩ জন। প্রথম পর্যায়ে ২৫০টি শিল্পপ্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে প্রয়োজনীয় মাটি ভরাট কাজ শেষ হয়েছে ৪৭১টি শিল্পপ্লটের। অবশিষ্ট এলাকায় মাটি ভরাট কাজ চলমান। বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে চলতি বছর মার্চের মধ্যে অন্তত অর্ধডজন শিল্প প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে যাবে বলে জানান বেজা কর্তৃপক্ষ। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এশিয়ান পেইন্ট, ম্যাগডোনাল স্টিল, মডার্নসিনট্রেক, জাপানের নিপ্পন স্টিল অন্যতম। জাপানের নিপ্পন স্টিল কোম্পানি একটি অটোকার ম্যানুফ্যাকচারিং কারখানা করেছে। ইতোমধ্যে তারা ৬০ কোটি টাকা বিনিয়োগ নিশ্চিত করেছে। বেজার সহকারী ব্যবস্থাপক আমজাদ হোসেন জানান, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা, পণ্য উৎপাদন ও রফতানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, নতুন প্রযুক্তি স্থানান্তরের মাধ্যমে বাংলাদেশী নাগরিকদের কর্মদক্ষতা বাড়ানো হবে। অগ্রজ ও ব্যাকোয়ার্ড লিঙ্কেজ শিল্পকারখানা গড়ে তোলা এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্ব ও দারিদ্র্য হ্রাস তথা দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নও করা হবে প্রকল্পের মাধ্যমে। প্রকল্পের কাজ পুরোদমে শুরু হয়েছে। সড়কসহ গুরুত্বপূর্ণ অর্ধেক কাজ এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। বেজা সূত্রে জানা গেছে, এই অঞ্চলে দেশী-বিদেশী শিল্প উদ্যোক্তাদের ৮৩ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব পাওয়া গেছে। সেখানে প্রায় দুই হাজার একর জমিতে বিনিয়োগ করতে চায় বসুন্ধরা, পিএইচপি, কেএসআরএম, বিএসআরএম, ঝেজিয়াং, কুনমিংসহ বিভিন্ন শিল্পগ্রুপ। এছাড়া ১ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে সামিট চিটাগাং পাওয়ার। ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে চায় সিরাজ সাইকেল ইন্ডাস্ট্রি। বিপিডিবিআরপিসিএল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বিনিয়োগ করতে চায় ১ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া আরব-বাংলাদেশ ফুড ১০০ কোটি টাকা, গ্যাস-১ লিমিটেড ২০০ কোটি টাকা, ফন ইন্টারন্যাশনাল ২০০ কোটি টাকা, ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল সাড়ে ৫০০ কোটি টাকা, আরমান হক ডেনিমস ১০০ কোটি টাকা এবং অর্কিড এনার্জি ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ প্রস্তাব করেছে পিএইচপি গ্রুপ। পিএইচপি স্টিল ওয়ার্কস বিদেশী কোম্পানির সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগে সেখানে স্টিল মিল স্থাপন করবে। এই গ্রুপ ৫৬৪ একর জমিতে স্টিল মিলসহ বিভিন্ন খাতে দুই ধাপে ৩২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করার প্রস্তাব দিয়েছে। পাশাপাশি ৫০০ একর জমি বরাদ্দ পেয়েছে বসুন্ধরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোনমিক জোন। এতে আধুনিক পাল্প এ্যান্ড বোর্ড মিলসহ বিভিন্ন উৎপাদনমুখী শিল্প স্থাপন ও ইকোনমিক জোনের উন্নয়নে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হবে। এছাড়া আগামী ৩-৪ বছরের মধ্যে ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হতে পারে বলে বেজা সূত্রে জানা গেছে। সর্বশেষ সৌদি সরকারের যোগাযোগমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর পরিদর্শন করে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেন। বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে অবকাঠামো উন্নয়ন কাজ গুছিয়ে এনেছে বেজা। সড়ক, ড্রেন, বৈদ্যুতিক লাইন ও সাবস্টেশন, সৌর বিদ্যুত বাতি, পানির লাইন, ইনফ্লুয়েন্ট নেটওয়ার্ক, গভীর নলকূপ, গ্যাস নেটওয়ার্ক স্থাপনের কাজ চলছে। এছাড়া একটি জোন সার্ভিসেস কমপ্লেক্স (বেপজার প্রশাসনিক ভবন), দুটি ডরমিটরি, একটি ইনভেন্টস ক্লাব, বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি ইনভেস্টরস আবাসিক ভবন, সিকিউরিটি ও কাস্টম ভবন, একটি প্রধান ফটক ও দুটি সিকিউরিটি/আনসার ব্যারাকের কাজ চলমান। এসব ভবন ও স্থাপনার কাজ চলতি বছরের জুনে শেষ হবে। এছাড়া সংশোধিত প্রকল্পের আওতায় নতুন করে আরও এক হাজার ১০ একর ভূমি উন্নয়ন, এক হাজার ১৩৮ দশমিক ৫৫ একর জমিতে সড়ক অবকাঠামো নির্মাণ, এক হাজার ১৩৮ দশমিক ৫৫ একর জমিতে নর্দমা নির্মাণ করা হচ্ছে। এছাড়া জোন সার্ভিসেস কমপ্লেক্স নির্মাণ ও ইনভেস্টরস ক্লাব এবং ইনভেস্টরস আবাসিক ভবন নির্মাণ করা হবে। নতুন করে অফিসার্স ডরমিটরি ও স্টাফ ডরমিটরি, আবাসিক ভবন, দুটি কারখানা ভবন, মসজিদ, মেডিক্যাল সেন্টার, ফায়ার স্টেশন, হেলিপ্যাড ও কালভার্ট, সিকিউরিটি ও কাস্টম ভবন, সিকিউরিটি ব্যারাক, সীমানা প্রাচীর, প্রধান ফটক ও কাস্টমস ফটক নির্মাণ করা হবে।
×