ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কাওসার রহমান

নিখোঁজ রহস্যের সমাধান কোন পথে

প্রকাশিত: ২২:৩৮, ২৯ জানুয়ারি ২০২২

নিখোঁজ রহস্যের সমাধান কোন পথে

(গতকালের পর) আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নিজেদের দায়মুক্ত করার লক্ষ্যে এই উদ্যোগ নিয়েছে। গত বছর (২০২১ সালে) জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিটি ৩৪ জনের একটি তালিকা দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের কাছে তাদের অবস্থান জানতে চেয়েছে। ওই তালিকায় যাদের নাম আছে তাদের সবার বাড়িতে নতুন করে পুলিশ যাচ্ছে। পুলিশের নতুন তৎপরতার কারণ সম্পর্কে মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলছেন, ‘একটা হচ্ছে, জাতিসংঘের তরফ থেকে প্রতিবেদন চাচ্ছে। আরেকটা হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত তথা নিষেধাজ্ঞা আরোপ। তারই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এসব। সবকিছু মিলিয়ে মনে হচ্ছে, অন্য যে কোন সময়ের চাপের চেয়ে এই সময়ে চাপটি খুব প্রবলভাবে আসছে। তাতে মনে হচ্ছে, এই বিষয়টাকে অবহেলা করার সুযোগ নেই। এই চাপটি শেষ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেবে, যদি তারা যথাযথ পদক্ষেপ না নেয়।’ পুলিশ জানাচ্ছে, তদন্ত এগিয়ে নেয়ার স্বার্থে তাদের এই তৎপরতা। ঢাকা মেট্রোপলিটল পুলিশের মিডিয়া এ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস্ বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার মোঃ ফারুক হোসেন বলেন, ‘তদন্ত এগিয়ে নেয়ার স্বার্থেই পরিবারগুলোর কাছে যাচ্ছে পুলিশ। হয়রানির কোন বিষয় না। নিখোঁজ ব্যক্তিকে খুঁজে বের করার জন্য তদন্তকে শেষ করার জন্য আমাদের অবশ্যই ওই ভিকটিমের বাড়িতে যেতে হবে, তথ্য নিতে হবে এবং মামলার প্রক্রিয়াটাকে শেষ করতে হবে। সেই শেষ করার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই কিন্তু আমরা ভিকটিমের ফ্যামিলির কাছ থেকে তথ্য সহায়তা চাচ্ছি। এই কারণেই তাদের বাড়িতে যাওয়া।’ ফারুক হোসেনের কথায় বোঝা যায়, নিখোঁজ ব্যক্তিদের ব্যাপারে তদন্তে পুলিশ নতুন করে সক্রিয় হয়েছে। তার ভাষায়, ‘যেই ব্যক্তিদের এখনও আমরা উদ্ধার করতে পারি নাই, তাদের ব্যাপারে আমাদের যেসব অফিসার এ্যাসাইন্ড করা আছে, তারা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করছে কিনা সেই বিষয়টা আমরা উর্ধতন কর্মকর্তারা মনিটরিং করছি। যত দ্রুত সম্ভব তাদেরকে খুঁজে বের করা যায় সেজন্য আমরা আন্তরিকভাবে আরও এ্যাকটিভলি কাজ শুরু করেছি।’ বিভ্রান্তিকর তথ্য : গুম বা নিখোঁজের ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে কোন সুনির্দিষ্ট বক্তব্য দেয়া হয়নি কখনও। ফলে বিভিন্ন সংস্থা এ ব্যাপারে বিভিন্ন রকম তথ্য দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থায় সেই সকল তথ্য পাঠাচ্ছে এনজিওগুলো। আর ওই সংস্থাগুলো সেই তথ্যই ব্যবহার করছে। ফলে একেক সংস্থার একের রকম তথ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হচ্ছে। জাতিসংঘের গুম সংক্রান্ত ওয়ার্কিং গ্রুপের (ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিসএ্যাপিয়ারেন্সেস) তালিকায় বাংলাদেশের ৭৬টি অমীমাংসিত গুমের ঘটনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশে বলপূর্বক নিখোঁজের শিকার ৮৬ জন ব্যক্তি এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত ১১৫ জনের সাক্ষাতকারের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে বলে জানিয়েছে এইচআরডব্লিউ। বাংলাদেশের বিতর্কিত মানবাধিকার সংগঠন অধিকার তথ্য দিয়েছে, ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৫৮৭ জন নিখোঁজ হয়েছে। এর মধ্যে ১৪৯ জন এখনও নিখোঁজ। ৩৫৭ জন দীর্ঘ সময় ধরে নিখোঁজ থেকে ফিরে এসেছে। আর ৮১ জনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। অধিকার কিন্তু জিয়াউর রহমানের আমলে গুম, খুন ও নির্বিচারে ফাঁসিতে ঝোলানো সামরিক বাহিনীর সদস্যদের হত্যার কথা একবারও বলে না। ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবরের পর তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের নির্দেশে ১ হাজার ১৪৩ জন সদস্যকে গুম, খুন ও ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল। এরমধ্যে ওই সময় গঠিত বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনালের বিচারে ফাঁসি হওয়া ১৯৩ জনের নাম-পরিচয় পাওয়া যায়। বাকিদের আজ পর্যন্ত কোন হদিস পাওয়া যায়নি। ওই ঘটনার জেরে কারাদন্ড ভোগ করেছিলেন সেনা ও বিমানবাহিনীর আড়াই হাজার সদস্য। এসব বিষয় নিয়ে কিন্তু অধিকার, আইন ও সালিশ কেন্দ্র কিংবা মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন কেউ কোন উচ্চবাচ্য করে না। নিখোঁজ ও গুম হওয়া সামরিক বাহিনীর এই সদস্যদের স্ত্রী, মা কিংবা সন্তানেরাও কিন্তু তাদের স্বামী, ছেলে কিংবা বাবার পথ চেয়ে বসে আছে আজও। এই গুম ও খুনের রহস্যও উন্মোচন করা প্রয়োজন। এরসঙ্গে কারা জড়িত, তাদের পরিচয় জানতে এখনই তদন্ত শুরু করা প্রয়োজন। যদি মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কাছে এত তথ্য থাকে তবে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে নেই কেন? এই তথ্যতো সবার আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংরক্ষণ করার কথা। পুরো বিষয়টিই আইনশৃঙ্খলাজনিত। অথচ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জাতিসংঘের দেয়া তথ্য অনুযায়ী কাজ করতে হচ্ছে। এর চেয়ে লজ্জাজনক আর কি হতে পারে? ২০২১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে ডব্লিউজিইআইডি জানিয়েছে, ‘তারা বার বার সরকারের কাছে এই ঘটনাগুলো সম্পর্কে তথ্য চেয়েও পায়নি। বরং বাংলাদেশ সরকার বার বার বিষয়টি অস্বীকার করছে।’ এ কারণেই বিষয়টি নিয়ে এক লেজেগোবরে অবস্থার তৈরি হয়েছে। ফল হয়েছে, র‌্যাব এবং তার বর্তমান ও সাবেক ৭ কর্মকর্তার ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা। অথচ সরকারের উচিত ছিল প্রতিটি ঘটনার তদন্তের অগ্রগতিসহ এসব ঘটনার ব্যাপারে সরকারের পদক্ষেপের কথা জাতিসংঘকে জানানো। বর্তমান সরকারের আমলের পুরোটা সময় জুড়েই এই ইস্যুটি নিয়ে বার বার রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত হচ্ছে। এটি একটি মানবিক আবার রাজনৈতিক স্পর্শকাতর ইস্যুতেও পরিণত করা হচ্ছে। নিখোঁজের ঘটনাগুলোকে জিইয়ে রেখে সেই সুযোগ কেন দেয়া হচ্ছে? আন্তর্জাতিক সংস্থা বিশেষ করে জাতিসংঘ বারবার এই বিষয়টি সামনে নিয়ে আসছে। ফলে এর সঙ্গে সরকারের ভাবমূূর্তি জড়িয়ে পড়েছে। তাহলে কি সরকারের ভেতর থেকেই কেউ সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্যই কৌশলে এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। কোন ব্যক্তি তিনি যে মতাদর্শেরই হোক না কেন, তিনি নিখোঁজ বা গুম হওয়ার পর নিকটস্থ থানাকে অবহিত করার পর পুরো দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। কারণ, রাষ্ট্রের মানুষের নিরাপত্তা বিধানই তাদের কাজ। এখানে গাফিলতি বা হয়রানির কোন সুযোগ নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তো অনেক গুম বা নিখোঁজ ব্যক্তিকে খুঁজে এনে তাদের পরিবারের হাতে তুলে দিয়েছে। বেশির ভাগ ব্যক্তিকেই খুঁজে এনে দেয়া হয়েছে। তাহলে ৩৪ ব্যক্তির ক্ষেত্রে তা সম্ভব হলো না কেন? যদি সম্ভব না হয় তাহলে তদন্ত করে আদালতের মাধ্যমে মামলার নিষ্পত্তি করা হলো না কেন? তখনতো জাতিসংঘকে বলা যেতো, যাদের পাওয়া যায়নি তাদের ব্যাপারে এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারের অভিযোগ, নিখোঁজের পর থানায় তাদের মামলা নেয়া হয়নি। গুমের সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকার পরেও তারা মামলা দায়ের করতে পারেননি। এর বিপরীতে পরিবারের সদস্যদের সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে দেয়া হয়েছে। অথবা মামলার বিবৃতিতে লিখতে বলা হয়েছে, ভুক্তভোগী ‘হারিয়ে গেছেন’, ‘কখনও ফেরেননি’ অথবা ‘অজ্ঞাত ব্যক্তিরা তুলে নিয়ে গেছে’। বিষয়টিকে যদি গুরুত্ব না দেয়ার জন্যই মামলা না নিয়ে সাধারণ ডায়রি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে, তাহলে এতদিন পর এই সাধারণ ডায়েরি নিয়ে সংশ্লিষ্ট থানাগুলো এতো তৎপর হয় উঠল কেন? কেন এখন নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারকে লিখে দিতে বাধ্য করা হচ্ছে, ‘আমার ছেলে মাহাবুব হাসান সুজন যে নিখোঁজ হইয়াছে সে ঘটনাটি আমি পুরোটা আড়াল করে ভুল তথ্য দিয়ে সবুজবাগ থানায় গত ইং ১১/১২/২০১৩ তাং উল্লিখিত সাধারণ ডায়েরি এন্টি (এন্ট্রি) করি। এটাই আমার জবানবন্দী’-এই বাক্য। এটা কি দায়মুক্তির জন্য করা হচ্ছে? দায়মুক্তির কী পরিণাম হয় তা কী তাদের জানা নেই? বঙ্গবন্ধুর খুনীদের দায়মুক্তি দিয়েও কিন্তু বাঁচানো যায়নি। প্রকৃতির বিচার বলে একটি বিষয় আছে। সেটাই ঘটেছে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের ক্ষেত্রে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর পাকিস্তানী ধ্যান ধারণা এদেশে জেঁকে বসেছিল। কেউ কোন দিন ভাবেনি এদেশে ক্ষমতায় আবার আওয়ামী লীগ ফিরে আসবে। শেখ হাসিনার দেড় দশকের ধারাবাহিক আন্দোলনের ফলে এদেশের মানুষ কিন্তু ভোটের অধিকার ফিরে পেয়েই ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগকে পুনরায় ক্ষমতায় নিয়ে এসেছে। যার ফলে সম্ভব হয়েছে ইনডেমনিটি বিল বাতিল করে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচার। দায়মুক্তি নিয়েও কিন্তু খুনিরা বাঁচতে পারেনি। ব্যক্তি স্বার্থে সরকারকে ভুল বুঝিয়ে কেউ যদি দায়মুক্তির জন্য কোন অপতৎপরতা চালায়, সেটা কতটা সফল হবে তা নিয়ে সংশয় আছে। ঢাকা মেট্রোপলিটল পুলিশের মিডিয়া এ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস্ বিভাগের উপপুলিশ কমিশনারের বক্তব্যে কিন্তু দায়মুক্তির প্রতিফলন নেই। পুলিশ উপ-কমিশনারের বক্তব্য অনুযায়ী, নিখোঁজ ব্যক্তিকে খুঁজে বের করার জন্য, তদন্তকে শেষ করার জন্যই পুলিশ ভিকটিমের বাড়িতে যাচ্ছে। যাতে মামলার প্রক্রিয়াটা শেষ করা যায়। তাহলে সংশ্লিষ্ট থানাগুলোর বিরুদ্ধে হয়রানির অভিযোগ উঠছে কেন? এটিও খতিয়ে দেখতে হবে। পুলিশকে জনবান্ধব হতে হবে। বর্তমান আইজিপি নিজেও বলেছেন, তিনি পুলিশকে একটি জনবান্ধব পুলিশ বাহিনীতে পরিণত করতে চান। এটি এদেশের মানুষেরও একমাত্র চাওয়া। অন্যান্য দেশের মতো পুলিশ যেন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ভরসাস্থল হয়। সাধারণ মানুষের কাছে পুলিশের এই ভাবর্মূতিটা খুবই জরুরী। (সমাপ্ত) ২৬.০১.২২ লেখক : সাংবাদিক
×