ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আট বছরে কয়েক কোটি টাকার মালিক নোমান

প্রকাশিত: ২২:০৯, ২৯ জানুয়ারি ২০২২

আট বছরে কয়েক কোটি টাকার মালিক নোমান

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ সরকারী বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের হোতা সাবেক সেনা সদস্য নোমান সিদ্দিকী। গত ৮ বছর ধরে তিনি বিভিন্ন সরকারী চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসে জড়িত। এই ফাঁসের প্রশ্ন দিয়ে তার নিকট আত্মীয়-স্বজদের চাকরিরও ব্যবস্থা করিয়েছেন তিনি। নিজে তা বিক্রি করে কোটি কোটি টাকার মালিক বনেছেন। রাজধানীতে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, দামী গাড়ি, গ্রামের বাড়ি প্রচুর সম্পত্তি ও বিশাল অঙ্কের ব্যাংক ব্যালেন্স রয়েছে। সম্প্রতি প্রতিরক্ষা মহাহিসাব নিরীক্ষকের কার্যালয়ের অধীন ডিফেন্স ফাইন্যান্স ডিপার্টমেন্টের অডিটর পদে নিয়োগের প্রশ্ন ফাঁসের হোতা হিসেবে তার নাম উঠে আসে। এই চক্রে শিক্ষক-জনপ্রতিনিধিসহ একাধিক রাঘববোয়াল জড়িত। এরপর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ নোমান সিদ্দীকি, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মাহবুবা নাসরীন রূপা ও হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের (সিজিএ) কার্যালয়ের কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান আজাদসহ ১০ জনকে গ্রেফতার করে। এ ঘটনায় দায়ের করা দুই মামলার তদন্তে এমনি চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। তদন্তে আরও বেরিয়ে এসেছে একাধিক রাঘব বোয়ালের নাম। ইতোমধ্যে ডিবি পুলিশ তাদের সন্ধানে মাঠে নেমেছে। এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান জনকণ্ঠকে জানান, প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় মাস্টারমাইন্ড সাবেক সেনা ওয়ারেন্ট অফিসার নোমান সিদ্দিকী। এক সময় তিনি র‌্যাবে কর্মরত ছিলেন। ২০১৪ সালে তিনি স্বেচ্ছায় অবসর নেয়ার পর প্রশ্নফাঁসে জড়িয়ে পড়েন। এরপর থেকে এই প্রশ্নফাঁস করে মোটা অঙ্কের টাকা উপার্জন করেছেন। একই সঙ্গে তার আত্মীয় স্বজনদের অনেকের চাকরির ব্যবস্থা করেছেন। চাকরি পেয়েছেন এমন ব্যক্তিদের তালিকা পাওয়া গেছে। এ ছাড়া নোমান আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য দিচ্ছেন। গ্রেফতারকৃত ১০ জনকে দুই দিনের রিমান্ড শেষে মঙ্গলবার কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে দুই মামলায় আবারও রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। ডিসি মশিউর রহমান জানান, সম্প্রতি তিনি তার চক্রে আরও একাধিক সদস্যকে যুক্ত করেন। এরমধ্যে বেসরকারী শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যায়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএতে) নিবন্ধিত একজন শিক্ষকও রয়েছে। তাকেসহ আরও একধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতারে অভিযান চালানো হচ্ছে। হোতা নোমান আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। তদন্তের স্বার্থে এখনই তাদের নাম প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না। তার দেয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, গ্রেফতারকৃত চক্রের প্রধান আসামি প্রশ্ন ফাঁসের হোতা নোমানের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি থানার চর আলগিয়া গ্রামে। তার বাবার নাম মোঃ আবু তাহের মিয়া। প্রশ্ন ফাঁসের টাকায় তিনি ঢাকায় ও তার গ্রামের বাড়িতে অঢেল সম্পত্তির মালিক বনে গেছেন। এ ঘটনায় পলাতক এনটিআরসিএতে শিক্ষক হিসাবে নিবন্ধন পাওয়ার ফারুকের সঙ্গে পূর্ব পরিচয় ছিল মাহবুবা নাসরীন রূপার। তিনি বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান। ইডেন কলেজের সাবেক ছাত্রলীগ নেত্রী ছিলেন তিনি। এমনি তদ্বির বাণিজ্য করে তিনি প্রচুর টাকা কামিয়েছেন। রাজনীতিতে দীর্ঘ সময় পার করে দেয়ায় তার সরকারী চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাচ্ছিল। সম্প্রতি তিনি সরকারী চাকরির জন্য বিভিন্ন স্থানে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। এক পর্যায়ে ফারুকের মাধ্যেমে পরিচয় নোমান সিদ্দিকীর সঙ্গে। সেই সূত্রধরে রূপা আরও কিছু পরীক্ষার্থী সংগ্রহ করেন। তাদের কাছ থেকে ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। এরকম ১৮ জন পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে বিকাশ ও রকেটের মাধ্যমে লেনদেনে করেন। তার এসব এ্যাকাউন্টে অস্বাভাবিক লেনদেন হওয়ায় নজরে আসে গোয়েন্দাদের। গোয়েন্দার নজরদারি ও তদন্তে বেরিয়ে আসে প্রশ্নফাঁসের চাঞ্চল্যকর তথ্য। এরই সূত্র ধরে গোয়েন্দা পুলিশ ২১ জানুয়ারি কাফরুল থানার শেনপাড়া পর্বতার ৪৯৮/৪ ভবনের এ/২ ফ্ল্যাটে অভিযান চালায়। এ সময় সেখান থেকে প্রশ্নফাঁসের নায়ক নোমান সিদ্দিকীকে গ্রেফতার করা হয়। তার বাসা ও দেহ তল্লাশি করে ৪টি মোবাইল ফোন ও একটি ডিজিটাল ডিভাইস উদ্ধার করা হয়। পরে সেখান থেকে ৬ পাতা অডিটর নিয়োগ পরীক্ষার ২০২২ এর পার্ট-১ এর এমসিকিউ প্রশ্নপত্রের ফটোকপি পাওয়া যায়। সেখানে একই পরীক্ষার ৮ জন প্রার্থীর নামের তালিকা উদ্ধার করা হয়। ওই প্রার্থীরা হচ্ছেন, ফারদিন ইসলাম, লুৎফর রহমান, আমিনুল ইসলাম, সেলিম মাতবর, আহাদ খান, পারুল বালা, আকলিমা খাতুন ও মোরশেদ। একই সময় মাহমুদুল হাসান আজাদকে গ্রেফতার করা হয়। তার দেহ তল্লাশি করে মফিজুর রহমান, পল্লব কুমার, হাসিবুল হাসান, সুরুজ আহম্মেদ নামে আরও ৪ জনের প্রবেশপত্র ও হাতে লেখা উত্তরপত্র উদ্ধার করা হয়। একই অভিযানে নাইমুর রহমান তানজীর ও শহিদুল্লাহকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকেও ফাঁস হওয়া প্রশ্নের উত্তরপত্র ও বিপুল পরিমাণ টাকা উদ্ধার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে একাধিক বিকাশ ও রকেটের নাম্বার উদ্ধার করা হয়। সেখানে লাখ লাখ টাকা লেনদেনের তথ্য পায় ডিবি তদন্তকারী দল। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, নোমান সিদ্দিকীর বাসায় অভিযান শেষে পুলিশ বিজিপ্রেস স্কুলে অভিযান চালায়। সেখান থেকে পরীক্ষারত অবস্থায় ভাইস চেয়ারম্যান রূপাকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনের মেসেঞ্জার থেকে হিরণ খান নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে কথোপকথনের প্রমাণ পাওয়া যায়। সেখানে প্রশ্নফাঁস নিয়ে তাদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা হয়। এমনকি ফাঁস হওয়া প্রশ্নে কিছু উত্তরও পাওয়া যায়। এরপর পুলিশ রূপার দেয়া তথ্যমতে রমনা থানাধীন ৫৫/১ নিউ শাহীন হোটেলের ২৪ নাম্বার রুমে অভিযান চালায়। এরপর সেখান থেকে মোঃ আল আমীন আজাদ রনি, মোঃ রাকিবুল হাসান, মোঃ হাসিবুল হাসান ও নাহিদ হাসানকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এ সময় তাদের কাছ থেকে অত্যাধুনিক ডিভাইস উদ্ধার করা হয়। এ সময় ডিভাইসের মাধ্যেমে পরীক্ষা কেন্দ্রে অবস্থান করা পরীক্ষার্থীদের কাছে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সমাধান পাঠানো হচ্ছিল। একই সঙ্গে তাদের কাছ থেকেও একাধিক বিকাশ ও রকেটের সিম উদ্ধার করা হয়। ওইসব সিম দিয়েও মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়। এ ব্যাপারে গুলশান জোনের এডিসি রেজাউল হক জানান, সরকারী নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের সম্ভাবনা থেকেই পুলিশ নজরদারি বৃদ্ধি করে। এ ছাড়া প্রশ্নফাঁস হবে এমন তথ্যও ছিল গোয়েন্দাদের হাতে। এ ধরনের আশঙ্কা থেকেই চক্রের সদস্যরা পুলিশের ফাঁদে পা দেয়। এ ঘটনায় গ্রেফতারকৃত সাবেক সেনা সদস্য নোমানসহ কয়েকজনের নামে কাফরুল থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃত চক্রের প্রধান আসামি নোমান প্রশ্ন ফাঁসের টাকায় ঢাকায় ও তার গ্রামের বাড়িতে অঢেল সম্পত্তির মালিক বনে গেছেন। এ বিষয়গুলোও তদন্তে তুলে ধরা হবে। এ ঘটনার তার সঙ্গে ছাপাখানার কেউ জড়িত আছে কিনা তাও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকেও কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। গুলশান জোনের সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার খলিলুর রহমান জানান, রমনার হোটেল থেকে গ্রেফতারকৃতদের নামে রমনা থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ওই মামলায় আসামি ৫ জন। এছাড়া পলাতক হিসাবে আরও একাধিক ব্যক্তির নামে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এসব বিষয় যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। আসা করা হচ্ছে এ মামলায় প্রশ্নফাঁসের রাঘব-বোয়ালদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে। তিনি জানান, ২১ জানুয়ারি শুক্রবার দুপুর থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত রাজধানীর মিরপুর, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল ও রমনার বিভিন্ন এলাকায় পৃথক দুটি অভিযান চালিয়ে অভিযুক্ত ১০ জনকে গ্রেফতার করে ডিএমপির গোয়েন্দা গুলশান বিভাগ। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৬টি ইয়ার ডিভাইস, ৬টি মাস্টার কার্ড মোবাইল সিম হোল্ডার, ৫টি ব্যাংকের চেক, ৭টি নন জুডিসিয়াল স্ট্যাম্প, ১০টি স্মার্ট ফোন, ৬টি ফিচার মোবাইল ফোন, ১৮টি প্রবেশপত্র ও চলমান পরীক্ষার ফাঁস হওয়া ৩ সেট প্রশ্নপত্র জব্দ করা হয়। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ২২ জানুয়ারি ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় (সন্দেহমূলক) বগুড়ার ধুপচাঁচিয়া উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মাহবুবা নাসরীন রূপাসহ ৬ জনকে ১০ দিনের পুলিশ রিমান্ডের আবেদন করে আদালতে হাজির করা হয়। এরপর আদালত তাদের দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। দুই দিনের রিমান্ড শেষে তাদের ২৫ জানুয়ারি আদালতে রমনা থানার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার দেখানোর আবেদন করে হাজির করা হয়। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শহিদুল ইসলাম আগামী ৩০ জানুয়ারি শুনানির দিন ধার্য করে তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
×