ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শৈল্পিক মৃত্যুর দিকে যাত্রা

প্রকাশিত: ০০:২০, ২৮ জানুয়ারি ২০২২

শৈল্পিক মৃত্যুর দিকে যাত্রা

পৃথিবী নামে একটি গ্রহ রয়েছে। সেখানে সুন্দরের চর্চা হয়। সেখানে সুন্দরকে অসুন্দর থেকে পৃথক করা হয়। সেখানে সুন্দরকে নিয়ে কবিতা লেখা হয়। সুন্দরকে নিয়ে, সত্যকে নিয়ে, মানুষকে নিয়ে কবিতা লেখা হয়। সেখানে ভালবাসা রয়েছে। মানুষ মানুষকে ভালবাসে, মানুষ কবিতাকে ভালবাসে। এ কারণে সেখানে সুন্দরের বিভাজন হয়, আরো সুন্দর সৃষ্টির দিকে মানুষ এগিয়ে যায়। বর্তমান শতাব্দী সেই অবর্ণনীয় সুন্দরের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। আর এখান থেকেই মানুষ অসহ্য সুন্দরকে দেখে উল্লাসে বা বিস্ময়ে আঁতকে উঠছে। সেই অসহ্য সুন্দরের দিকে কবি শেখ নজরুলের পদযাত্রা। কবি শেখ নজরুলের কবিতার একজন দীর্ঘদিনের মনোযোগী পাঠক হিসেবে চল্লিশটিরও বেশি কাব্যগ্রন্থে দেখা গেছে তিনি মানব শরীরকে বিভিন্নভাবে ফরংংবপঃরড়হ করে সেখানে প্রেম খুঁজতেন, প্রকৃতির ভেতর প্রেম খুঁজতেন, দৈনন্দিন ব্যস্ত শহরে মানবিক মূল্যবোধের অবমূল্যায়ন খুঁজতেন, ব্যস্ত নাগরিক জীবনে কৃত্রিম প্রলেপে রাঙানো নারীদের দেখতেন, দেশজ জীবনের সঙ্গে কখনও নগুরে জীবনের তুলনা করতেন। বিশ^-অর্থনৈতিক সাম্যহীনতাকে উপজীব্য করে কবিতা গড়ে তুলতেন। দীর্ঘদিন তাঁর কবিতায় একটি পরিবর্তন বা ভিন্নতর ঢেউ পাঠক সমাজে কাক্সিক্ষত ছিল। এবার এই একবিংশের সময়ে এসে শেখ নজরুলের কবিতায় দু’-তিনটে পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়। কবিতা দর্শন বা জীবনকে কেন্দ্র করেই নতুন বক্তব্যের উদ্ভাবন বাংলা সাহিত্যে অনেকেই করেছেন। রবীন্দ্রনাথ সোনার তরী এবং চিত্রায় যা বলেছেন, তা ক্ষণিকা থেকে সরে আসার স্পষ্ট ছাপ সেখানে রয়েছে। কাজী নজরুল বা বিষ্ণু দের কবিতাতেও এসব লক্ষ্যণীয়। ‘অসহ্য সুন্দর’-এ শেখ নজরুল প্রথম সরাসরি মৃত্যুর দিকে ধাবিত হওয়ার প্রেরণা লাভ করেছেন। এর আগের কাব্যগুলোতে কবি যে মৃত্যুর কথা উচ্চারণ করেননি তা নয়, কিন্তু এতটা প্রকট নয়। রবীন্দ্রনাথ যেমন মৃত্যুকে বিধাতার একটি উপহার হিসেবে বলেছেন, ‘অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে তোমার/ সে পায় তোমার হাতে শান্তির অক্ষয় অধিকার’ [শেষের কবিতা]। শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক যেমন মৃত্যুর পর অনন্ত মহাকাশে তারা হয়ে থাকবার অনন্ত আগ্রহ দেখিয়েছেন, শেখ নজরুল সেখানে বলেন, ‘শেষ সব ডাকাডাকি-আবেদন নিবেদন/ ঘাঁটা শেষ, সব সরকারী-বেসরকারী মন/ সব্বাইকে টা টা-বাই বাই/ তোমরা থাকো, আমি যাই।’ (পৃঃ-৮)। ‘তুমি শোক হতে চেয়ো না/ কান্নাকাটি চাই না তোমার জন্য/ কষ্টের চোখ দুটো খেয়ো না/ আমি দেখতে চাই না তোমাকে অন্য/ পাশে থেকো খুব পাশে/ ভালোবাসা পাঠিও/ ভালো থেকো খুব ভালো/ ভালো থেকো প্রিয় (পৃঃ-৯)। তিনি সুন্দরকে শাশ^ত করে অনন্তকালের চলিঞ্চু জীবনে প্রবহমান রাখতে চেয়েছেন। কবি অন্যলোকে গিয়ে ‘খুব ইচ্ছে একদিন শুধু পাখির হবো/ কৃষ্ণচূড়ার রঙে এ মন হারাবো’ (পৃঃ-২৭) অর্থাৎ প্রকৃতির অন্য পাখি হয়ে আবারো ফালগুনে জন্ম নিতে চান। এভাবে কবি একটি মৃত্যুকে টা টা-বাই বাই জানাতে চেয়েছেন। আর একটি বিশেষ রূপ কবিতায় উঠে এসেছে। বিংশের বেশ কিছু বিভিন্ন ভাষা-ভাষীর কবিরা কবিতা শেষে বিরতি চিহ্ন ব্যবহার থেকে বিরত থেকেছেন। এটি বাংলাদেশের শামসুর রাহমান থেকে তারাপদ রায়, রফিক আজাদ হয়ে অনেক কবি অনুসরণ করেছেন। কবিতা শেষে বিরতিচিহ্ন না দেয়ার তাঁরা যুক্তি দেখান কবিতাকে অনন্ত ভাবসৌকর্যে প্রবহমান রাখতে তাঁরা এ কাজটি করেন। শেখ নজরুল এ কাব্যে বেশ কিছু কবিতার সৃষ্টি করেছেন যেখানে কবিতা শেষে যতিচিহ্ন ব্যবহার থেকে বিরত থেকেছেন। এমনটি তাঁর আগের কাব্যগুলোতে দেখা যায়নি। এটি একটি বাক-বদল ধরা যায়। এই কাব্যগ্রন্থে দু’শ’রও বেশি কবিতা স্থান পেয়েছে। আগের কবিতাগুলোতে ভাষার তীব্রতা বা আবেগের তীব্রতা এখানে কিছুটা কম কিন্তু মৃত্যুর একটি চিরকুট থেকে গেছে, জীবনের অন্তিমে একটি বাস্তবতা ও একটি আকাক্সক্ষা থেকে গেছে। প্রচ্ছদ এঁকেছেন ধ্রুব এষ নৈর্ব্যক্তিক সাবজেক্টে এ্যাবসার্ড ফর্ম ব্যবহার করে। বলা চলে, শেখ নজরুল তাঁর কবিতায় এবার চিরন্তর সত্যের খুব কাছে চলে এসেছেন।
×