ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

আমির হোসেন

সাম্যবাদ ও বিদ্রোহের অভূতপূর্ব সমন্বয়

প্রকাশিত: ০০:১৭, ২৮ জানুয়ারি ২০২২

সাম্যবাদ ও বিদ্রোহের অভূতপূর্ব সমন্বয়

কবি নজরুল ইসলামের মানবতাবোধ ও সাম্যবাদ সম্পর্কিত বিষয়ে আলোকপাত করতে গেলে মনে প্রথমেই প্রশ্নজাগে কেমন ছিলেন তিনি। বিদ্রোহাত্বক গুরুগম্ভীর কঠিন হৃদয়ের মানুষ। প্রকৃত অর্থে তা নয়। তিনি ছিলেন ঝর্ণাধারার মতো গতি চঞ্চল একজন মানুষ। তিনি ভাল বাসতেন মানুষকে। মানুষের চেয়ে বড় কিছু নেই নহে কিছু মহিয়ান। কবি বিশ^াস করতেন মানুষ তার অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকুক। জীবন সুখী হোক, সুন্দর হোক, আনন্দময় হোক- এই ছিল তার কামনা। তার সমস্ত কবি জীবনের সদাজাগ্রত সবচেয়ে দীপ্তপ্রেরণার উৎস ছিল শোষণহীন, পীড়নহীন সমাজ। যে সমাজের ন্যায্য প্রতিনিধি মানবতাবোধ সম্পন্ন মানুষ। মানুষের ভেতরই তিনি সন্ধান করেছেন সত্য ও সুন্দরের। তাঁর মানুষ কবিতার কিছু উল্লেখযোগ্য উদ্ধৃতি-তোমাতে রয়েছে সকল ধর্ম সকল যুগাবতার/তোমার হৃদয় বিশ^দেউল/সকল দেবতার/কেন খুঁজে ফেরো দেবতা ঠাকুর/মৃত পুথি কঙ্কালে?/হাসিছেন তিনি অমৃত হিয়ার/নিভৃত অন্তরালে।/বন্ধু বলিনি ঝুট/এইখানে এসে লুটাইয়া পড়ে/সকল রাজমুকুট।/ এই হৃদয়ই যেন নীলাচন, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন/বুদ্ধগয়া এ জেরুজালেম এ /মদিনা কাবাভবন/মসজিদ এই মন্দিও এই/গীর্জা এই হৃদয়/এই খানে ঈশা মুছা পেল/ সত্যের পরিচয়। প্রেম ও বিদ্রোহের এমন সমন্বয় আর কোথায় পাব? এক সঙ্গে তিনি টর্পেডো ভিম, ভাসমান মাইন এবং শ্যামের হাতের বাঁশিও। প্রকৃতপক্ষে তাঁর মাঝে ছিল প্রেম, বিরহ, বিদ্রোহ, সাম্যবাদিতার এক অদ্ভুত মেলবন্ধন। তিনি নিজেই বলেছেন-আমি শুধু সুন্দরের হাতে বীনা, পায়ে পদ্ম ফুলই দেখিনি তার চোখে চোখভরা জলও দেখেছি। শ্মশানের পথে, গোরাস্তানের পথে তাকে ক্ষুধা দীর্ণ মত্তিতে ব্যতীত পায়ে চলে যেতে দেখেছি। যুদ্ধভূমিতে দেখেছি, কারাগরের অন্ধকূপে তাকে দেখেছি। মানুষকে ভালবেসে, মানুষের জয়কীর্তন করে তিনি যেমন দুহাতে কুড়িয়েছেন মানুষের ভালবাসা তেমনি নিন্দাও তাঁকে কম শুনতে হয়নি। এ সম্পর্কে তিনি বলেছে, যারা আমার বন্ধু তারা যেমন সমস্ত হৃদয় দিয়ে ভালবাসেন, যারা বন্ধুর উল্টা তারা তেমনি চুটিয়ে বিপক্ষতা করেন। ওতে আমি সত্যি সত্যি আনন্দ উপভোগ করি। পানসে বন্ধুত্বের চেয়ে চুটিয়ে শত্রুতা ঢের ভাল। আমার বন্ধুরা যেমন পাল্লার একধারে প্রশংসার ফুল-পাতা চড়িয়েছেন, অন্য পাল্লায় অবন্ধুর দল তেমনি নিন্দার ধুলো-বালি কাদা-মাটি চড়িয়েছেন এবং এই দুই তরফের সুবিবেচনার ফলে দুই ধারের পাল্লা এমন সমভার হয়ে উঠেছে যে, মাঝখান থেকে আমি ঠিক থেকে গেছি। এতটুক্ওু টলতে হয়নি। এতদ সত্ত্বেও নিন্দা বাণী যে নজরুলকে আহত করেনি তা পুরোপুরি ঠিক নয়। তাদের মিথ্যা অভিযোগে ক্ষুদ্ধ কবি ব্যথিত কণ্ঠে বলেছেন-আমাকে বিদ্রোহী বলে খামাখা লোকের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে কেউ কেউ। এ নিরীহ জাতিটাকে আঁচড়ে কামড়ে তেড়ে নিয়ে বেড়াবার ইচ্ছা আমার কোন দিনই নেই। তাড়া যারা খেয়েছে, অনেক আগেই মৃত্যু তাদের তাড়া করে ফিরেছে। আমি তাতে একটু আধটু সাহায্য করেছি মাত্র। আমার নামে অভিযোগ করেন আমি তাদের মতো হলুম না বলে, তাদের কাছে আমার অনুরোধ-আকাশের পাখিকে, বনের ফুলকে, গানের কবিকে তারা যেন সকলের করে দেখেন। আমি এই দেশে, এই সমাজে জন্মেছি বলেই শুধু এই দেশেরই এই সমাজেরই নয়। আমি সকল দেশের, সকল মানুষের, সুন্দরের ধ্যান, তার স্তব গানই আমার উপসনা, আমার ধর্ম। যে কূলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই আমি জন্মগ্রহণ করে থাকি তা আমার দৈব। ধর্মীয় বাড়া-বাড়ির সম্পূর্ণ বৈপরীত্বে ছিল নজরুলের অবস্থান। ধর্মের নামে মানুষে মানুষে মারামারি সহিংসতা, তাঁকে ভীষণভাবে ভাবিয়ে তুলত। হিন্দু এবং মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বন্ধ করে নজরুল তাদের এক মানুষের কাতারে এনে দাঁড় করিয়ে দিতে তাঁর চেষ্টার অন্ত ছিল না। তাই তাঁর লেখায় উল্লেখ পাই-হিন্দু আর মুসলিম দুটি জাতির মধ্যে গোলাগুলি বন্ধ করে কেবল গলা-গলি করে দিতে, হেন্ডসেক করে দিতেই চেয়েছিলাম। বাঙালী মুসলমানদের ধর্মীয় গোড়ামি সম্পর্কে তিনি অত্যন্ত আফসোস করে বলেছেন-বাঙালী মুসলমানদের মধ্যে যে গোড়ামি, যে কুসংস্কার তা পৃথিবীর আর কোন দেশে আর কোন মুসলমানদের মধ্যে নেই বললে অত্যুক্তি হবে না। এই গোড়ামির প্রধান হুতাদেও স্বরূপ উন্মোচিত করতে তিনি বলেছেন, মৌলানা-মৌলভী সাহেবদের ভাল করে সইতে পারি, মোল্লাকেও সইতে পারি চক্ষু কর্ণ বুজে কিন্তু কাঠ মোল্লার অত্যাচার আমার কাছে অসহ্য হয়ে ওঠেছে। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো ক্লাসিফিকেশনের বিষয়টি। মৌলানা-মৌলভী সাহেবদের সইতে পারার দিকটিতে তাঁর কোন দ্বিমত নেই। কিন্তু অন্যান্য দুটি দল, মোল্লা কিংবা কাঠ মোল্লার ক্ষেত্রে তাঁর প্রবল আপত্তি। মূলত তিনি চেয়েছিলেন, বৃহৎ সমাজের ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়কে পৃথক দৃষ্টিতে না দেখে সম্প্রীতির মিষ্টি বাঁধনে বাঁধতে পারলে সমাজ সুন্দর হয়, চির শান্তির বাতাবরণ রচিত হয়। এ সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই কবি লেখেন-‘মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান/মুসলিম তার নয়নমনি, হিন্দু তার প্রাণ।’ তিনি ভগবান ও আল্লাহকে একই বুকে ধারণ করে বুঝাতে চেয়েছেন ভগবান-আল্লায় কোন বিভেদ নেই। রাম আর রহিম জোড়া দুটি ভাই। তাই তিনি লেখেন-‘আমাদের সব লোকে বাসিবে ভাল/আমরাও সকলেরে বাসিব ভাল,/রবে না হিংসাদ্বেষ, দেহ ও মনের ক্লেশ/মাটির পৃথিবী হবে স্বর্গ সমান। সাম্প্রদায়িক শক্তি, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ইত্যাদির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে অবস্থান করে যেমন কবি সাম্যের গান গেয়েছেন। তেমনি নারী-পুরুষের সমতার জন্য তিনি গেয়েছেন সমঅধিকার ও সাম্যের গান। তিনি লেখেছেন-‘সাম্যের গান গাই-/আমার চক্ষে পুরুষ রমণী কোন ভেদাবেদ নাই!/বিশে^ যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ সত্য সুন্দর ও কল্যাণের পূজারি ছিলেন ছিলেন তিনি। তাঁর সাধনা ছিল মানবতার কল্যাণ ও মুক্তি। তিনি যে সময়ে জন্মেছিলেন, যে সময়ে তাঁর বেড়ে ওঠা তখন সময়টা ছিল বড় বিচিত্র। প্রথম বিশ^যুদ্ধ, স্বদেশী আন্দোলন, খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন, সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন, বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী চেতনার স্ফুরণ ইত্যাদি নানাবিধ কারণে আর্থ-সামাজিক অবস্থা ছিল চরম অস্থিরতায় পূর্ণ। এসব ঘটনা-আন্দোলনের মধ্যে কবির মানসচেতনায় অসাম্প্রদায়িকতা ও সাম্যবাদী চেতনার জন্ম হয়। তাঁর গানগুলোসহ অন্যান্য লেখার মধ্যে এই দুই চিন্তার ব্যাপক প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। অবিভক্ত বাংলার সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি ‘বিদ্রোহী’ কবি এবং আধুনিক বাংলাা গানের জগতে ‘বুলবুল’ নামে খ্যাত। তাঁর ব্যতিক্রমধর্মী কবিতার জন্যই ‘ত্রিশোত্তর আধুনিক কবিতা’র সৃষ্টি সহজতর হয়েছিল বলে মনে করা হয়। নজরুল সাহিত্যকর্ম এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকা-ের মাধ্যমে অবিভক্ত বাংলার পরাধীনতা, সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ এবং দেশী-বিদেশী শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। এ কারণে ইংরেজ সরকার তাঁর কয়েকটি গ্রন্থ ও পত্রিকা নিষিদ্ধ করে এবং তাঁকে কারাদ-ে দ-িত করে। ব্রিটিশ ভারতের শ্রেণিখ-িত, ধর্মবিচ্ছিন্ন এবং সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে সমাচ্ছন্ন বহুধাবিভক্ত সমাজে জন্মগ্রহণ করেও নজরুল ছিলেন বাংলা সাহিত্যের অবিসংবাদিত অসাম্প্রদায়িক লেখক। বহু পথ ও মতে আবর্তিত হয়ে ঔচিত্যবোধের আলোকে সমাজের অনগ্রসরতা ও পশ্চাৎদতা প্রত্যক্ষ করে নজরুল ক্ষতবিক্ষত ও মর্মহত হয়েছেন এই উপলব্ধিতে স্নাত হয়েছেন যে ভারতবর্ষেও প্রকৃত মুক্তি মানবতার বিকাশের জন্য প্রয়োজন সাম্প্রদায়িকতার বিলোপ এবং হিন্দু-মুসলমানের সত্যিকার মিলন। তারই আদর্শে উজ্জীবিত তিন স্বাভাবিক জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত হিন্দু-মুসলমানের মিলনের গান গেয়েছেন। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছেন এবং তাদের ঐক্যের ব্যগ্রতায় হয়েছেন সর্বদা তৎপর ও উচ্চকিত। সাহিত্যের ক্ষেত্রে তাঁর অসাম্প্রদায়িক মৈত্রীকামী চেতনা জীবনের প্রারম্ভ থেকেই সক্রিয় ছিল। কবি নজরুল সারা জীবন প্রায় সতর্কভাবেই চেতনায় চিন্তায় কাথায় কাজে ও আচরণে এ অসাম্প্রদায়িকতা অক্ষুণœ রেখেছিলেন। নজরুলের মানস চেতনাই মূলত তাঁর ধর্মচেতনা। নানক, কবীর, দাদু, লালনের মতো নজরুল-মানসেও প্রতিবিম্বিত হয়েছে ‘শাস্ত্র না ঘেটে ডুব দাও সখা, সত্যসিন্ধু জলে’। তিনি সত্যের সন্ধানে মসজিদ-মন্দিরে ছোটাছুটি করার চেয়ে মানুষের মানবিক মূল্যবোধকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। নজরুল মনে করতেন মানুষ যদি মনুষত্বের মাহিমায় উদ্ভাসিত হতে না পারল তবে কোন উপাসনালয়ে ভ--আশ্রয়ী হয়ে তার মনুষত্বের মাহিমায় উন্নীত হওয়া সম্ভব নয়। কেননা ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই’-মধ্যযুগের কবি চন্ডিদাসের এই সর্বমানবিকবোধ নজরুল সাহিত্যে আরও বেশি উচ্চকিত হয়ে উঠেছে। তাই নজরুল চেতনায় স্বার্থান্বেষী সমাজ-ধর্মের চিত্রটি তাঁর সাহিত্যেও উপস্থাপিত হয়েছে নির্ভীকচিত্তে।
×