ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ সফর বা বাড়ি থাকা অবস্থায় যিনি ছিলেন নবীজীর একান্ত কাছে

প্রকাশিত: ২২:৫৬, ২৮ জানুয়ারি ২০২২

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ সফর বা বাড়ি থাকা অবস্থায় যিনি ছিলেন নবীজীর একান্ত কাছে

মহানবী হযরত মুহাম্মদের (সা) নবুওয়াত প্রাপ্তির দ্বিতীয় বছরে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমারের (রা) জন্ম। নবুওয়াতের ষষ্ঠ বছরে তার পিতা হযরত উমার (রা) যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখন আবদুল্লাহর বয়স প্রায় পাঁচ। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই আবদুল্লাহ নিজের বাড়িটি ইসলামের আলোকে আলোকিত দেখতে পান। ইসলামী পরিবেশেই তিনি বেড়ে ওঠেন। হযরত উমার (রা) কাফিরদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পরিবার-পরিজনসহ মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন। পিতার সঙ্গে আবদুলল্লাহও মদিনায় চলে যান। হিজরতের পর সত্য-মিথ্যার প্রথম সংঘর্ষ হয় বদর প্রান্তরে। ইবনে উমার তখন তের বছরের কিশোর। তিনি জিহাদে যোগদানের আবেদন জানালেন। জিহাদের বয়স না হওয়ায় রাসূলুল্লাহ (সা) তার আবেদন প্রত্যাখ্যান করলেন। এক বছর পর আবার সামনে এলো উহুদের যুদ্ধ। এবারও তিনি নাম লেখালেন। একই কারণে এবারও রাসূলুল্লাহর (সা) অনুমতি লাভে ব্যর্থ হলেন। এর দুই বছর পর হিজরী পঞ্চম সনে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। আবদুল্লাহর বয়স তখন পনেরো। এই প্রথম তিনি জিহাদে গমনের জন্য রাসূলুল্লাহর (সা) অনুমতি লাভ করেন। এর পর থেকে ক্রমেই তিনি নবীজীর দরবারে আদরে-শাসনে বড় হতে থাকেন। জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সতর্ক এবং নিভৃতচারী। পিতার ওফাতের পর সর্বপ্রথম ইবনে উমারকে খলিফা নির্বাচনের মজলিসে দেখা যায়। হযরত উমার অসিয়াত করে যান যে, পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের ব্যাপারে আবদুল্লাহ শুধু পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করবে। তাকে খলিফা বানানো চলবে না। প্রশাসনকে আত্মীয়তার বেড়াজাল ও অপবাদ থেকে মুক্ত রাখার তার একি সুচিন্তিত প্রয়াস! আজকে আমাদের সমাজ দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির যে নিকৃষ্ট উদাহরণে পরিণত হয়েছে হযরত উমারের মতো মহানুভব শাসককে অনুসরণ করলে আদর্শহীন মেধাহীন পরিবারতন্ত্রের নিগঢ়ে আবদ্ধ হয়ে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস হতো না। সে যা হোক, খলিফা উসমান (রা) স্বীয় শাসনামলে তার পূর্বেকার খলিফার সুযোগ্য সন্তান আবদুল্লাহকে কাজীর পদ গ্রহণের প্রস্তাব দেন। তিনি প্রত্যাখ্যান করেন এই বলে যে, আমি দুই ব্যক্তির মাঝে না ফয়সালা করে থাকি, না দুই ব্যক্তির ইমামতি করে থাকি। কারণ রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: ‘কাজী তিন শ্রেণীর। এক, জাহিল। তাদের ঠিকানা জাহান্নাম। দুই, দুনিয়াদার আলিম। তারাও জাহান্নামী। তিন, যারা ইজতিহাদ করে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। তাদের জন্য না শাস্তি, না পুরস্কার।’ খলিফা বললেন, ‘তোমার পিতাও তো ফয়সালা করতেন।’ বললেন: হ্যাঁ, এ কথা সত্য। তবে কোন সমস্যায় পড়লে রাসূলুল্লাহর (সা) কাছে যেতেন। রাসূলও (সা) যখন সিদ্ধান্ত গ্রহণে অপারগ হতেন তখন জিবরাঈলের শরণাপন্ন হতেন। কিন্তু আমি এখন কার কাছে যাব? আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে অব্যাহতি দিন। খলিফা তাকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন। তবে তার কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে, এ কথা তিনি অন্য কারও নিকট প্রকাশ করবেন না। কারণ, খলিফা জানতেন, লোকেরা যদি জানতে পারে ইবনে উমার কাজীর পদ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছে তাহলে এ পদের জন্য আর কোন সত্যনিষ্ঠ মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। খিলাফতের দায়িত্ব থেকে দূরে থাকলেও জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ থেকে কখনও দূরে থাকেননি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর। ইসলামী অভিযানের ডাক যখন এসেছে, সাড়া দিয়েছেন। হিজরী ৭৪ সনে ৮৩ অথবা ৮৪ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। হজের সময় এক ব্যক্তির বিষাক্ত বর্শার ফলা তার পায়ে বিঁধে যায়। এই বিষেই তার শেষ পর্যন্ত মৃত্যু হয়। সাধারণভাবে ধারণা করা হয় যে, শুধু ঘটনাক্রমে এমনটি হয়নি, বরং এর পেছনে তৎকালীন জালিম শাসক হাজ্জাজের ইঙ্গিত ছিল। কারণ, ক্ষমতায় টিকি থাকার জন্য পবিত্র কা’বায় মহান মুজাহিদ আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইরের ওপর আক্রমণ চালানোর ব্যাপারে ইবনে উমার হাজ্জাজকে ভীষণ তিরস্কার করেছিলেন। এতে হাজ্জাজ ক্ষুব্ধ হন এবং সুযোগ বুঝে প্রতিশোাধ নেন। সফর ও ইকামাত বা বাড়ি এবং বাড়ির বাইরে ভ্রমণে থাকা- সর্বাবস্থায় রাসূলুল্লাহর (সা) সাহচর্য, হযরত ফারুকে আযম উমারের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, সর্বোপরি তার নিজের অনুসন্ধিৎসা তাকে ইসলামী জ্ঞানের সমুদ্রে পরিণত করেছিল। কোরান, হাদিস, ফিকাহ ইত্যাদি শাস্ত্রে তিনি ছিলেন অগাধ জ্ঞানের অধিকারী। সেকালে মদিনার যে সকল মনীষীকে বলা হতো ইলম ও আমলের ‘মাজমাউল বাহরাইন’ বা দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থল, ইবনে উমার ছিলেন তাদের অন্যতম। হযরত ইবনে উমারের মাধ্যমে ইলমে হাদিসের বিস্তর অংশ প্রচারিত হয়েছে। তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) ওফাতের পর (৬০) বছরের বেশি সময় জীবিত ছিলেন। এ দীর্ঘ সময় তিনি একাগ্রচিত্তে ইলমে দ্বীনের চর্চা করেছেন। ইবনে শিহাব জুহরী বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা) ও তাঁর সাহাবীদের কোন বিষয় ইবনে উমারের অজানা ছিল না।’ জ্ঞানের ঐ চর্চা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়ে কোন সরকারী দায়িত্ব তিনি তখনও গ্রহণ করেননি। তার স্থায়ী ‘হালকায়ে দরস’ বা শিক্ষার আসর ছিল মদিনায়। হজের মৌসুমে ফাতওয়া দিতেন। মানুষের বাড়িতে গিয়েও তিনি হাদিস শুনাতেন। বর্ণিত আছে, একদিন তিনি আবদুল্লাহ ইবনে মুতীর বাড়িতে যান। আবদুল্লাহ তাকে বসতে দিলেন। বসার পর উমার বললেন, তোমাকে একটি হাদিস শোনানোর জন্য আমি এ সময় তোমার এখানে এসেছি। আর তা হলো রাসূল (সা) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমিরের আনুগত্য থেকে দূরে থাকবে কিয়ামতের দিন সে এমন অবস্থায় উঠবে যে, তার কাছে কোন প্রমাণ থাকবে না। আর যে ব্যক্তি একতাবদ্ধ ভ্রাতৃময় দল থেকে পৃথক হয়ে মৃত্যুবরণ করল সে যেন জাহিলিয়াতের মৃত্যুবরণ করল। এখন আরবী জমাদিউস সানি মাস চলছে। এ মাসের ১১ তারিখ তার ওফাত সংঘটিত হয়েছিল। আজ আমরা তাকে স্মরণ করি, শ্রদ্ধা জানাই। বর্তমান সমাজের প্রেক্ষাপটে তাদের মতো আদর্শ পুরুষের শূন্যতা আমাদের দারুণভাবে পীড়িত করে। একজন বিখ্যাত ও বিশুদ্ধ হাদিস বর্ণনাকারী রাবী হিসেবে ইবনে উমার দুনিয়াজুড়ে মুহাদ্দেসীনে কেরামের একটি প্রিয় নাম। আজ এখানে তার বর্ণিত ২/১টি হাদিস উদ্ধৃত করছি। যেমন, তিরমিজি শরীফের ২৬৫৭ হাদিস, ইবনে উমার (রা) থেকে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি নবী (সা) পেশাবরত অবস্থায় তাঁকে সালাম দিল। কিন্তু নবী (সা) তার সালামের জবাব দেননি। অর্থাৎ এ ধরনের সময়ে সালাম বিনিময় হুজুরের (সা) পছন্দ ছিল না। বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে। আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি : একদা আমি নিদ্রিত ছিলাম, এ সময় আমার কাছে এক পেয়ালা দুধ আনা হলো। আমি তা থেকে পান করলাম এবং অবশিষ্টাংশ উমারকে দিলাম। লোকেরা জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এর কি তাবীর (ব্যাখ্যা) করেন? তিনি বলেন, ইলম বা জ্ঞান। অন্যত্র আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : যে ব্যক্তি স্বপ্নে আমাকে দেখল সে আমাকেই দেখল। কেননা শয়তান আমার রূপ (সাদৃশ্য) ধারণ করতে পারে না (ইবনে মাজাহ)। তিনি আরও বলতেন, তুমি জ্ঞানী অথবা শুভাকাক্সক্ষী ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারও কাছে স্বপ্নের কথা ব্যক্ত করবে না (বুখারী, মুসলিম)। হযরত ইবনে উমার (রা) থেকে আরও বর্ণিত হয়েছে। এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! কিসে হজ ওয়াজিব হয়? তিনি বললেন : পাথেয় ও বাহন (থাকলে)। প্রিয় হযরত (সা) তার সাহাবী সহচরদের আকাশের তারার সঙ্গে তুলনা করেছেন। আমরা নবীজীর এ জ্ঞানী সাহাবার জীবন অনুসরণ করব, আর অধ্যয়ন করব তার বর্ণিত বিশাল হাদিস ভা-ার। লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব [email protected]
×