ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ড. সাঈদা আঞ্জু

সড়ক দুর্ঘটনা ॥ বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ও বীমা সুরক্ষা আবশ্যক

প্রকাশিত: ২৩:৪১, ২৬ জানুয়ারি ২০২২

সড়ক দুর্ঘটনা ॥ বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ও বীমা সুরক্ষা আবশ্যক

মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা প্রায় প্রতিদিন প্রত্রিকার শিরোনাম হচ্ছে। মুহূর্তে নিভে যাচ্ছে প্রাণ। দুর্ঘটনার কারণ কি ছিল, কে বা কারা, কিভাবে দায়ী তা নিয়ে চলে তদন্ত রিপোর্ট প্রস্তুতের কার্যক্রম। এর বাইরে বিদ্যমান আইন প্রয়োগের আর কোন পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। সড়কে গাড়ি নামানোর পূর্বশর্ত হিসেবে রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট, ফিটনেস সার্টিফিকেট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, ক›ডাক্টরদের লাইসেন্স, ড্রাইভারের শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ বিভিন্ন নিয়ম লঙ্ঘনে দোষসূচক পয়েন্ট সংবলিত নতুন আইন দেশে ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ নামে প্রণয়ন করা হয়। আইনটি ১ নবেম্বর, ২০১৯ হতে কার্যকর হয়। এর মাধ্যমে ১৯৮৩ সালের ‘মটরযান অধ্যাদেশ-১৯৮৩’ বিলুপ্ত হয়। নতুন আইন বিভিন্ন অপরাধের শাস্তির মাত্রা ভিন্নভাবে নির্ধারণ করে। কিন্তু ১৯৮৩ সালের অধ্যাদেশে যে স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের ব্যবস্থা ছিল তা নতুন আইনে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। উল্লেখ্য, মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার মিশুক মুনীর ও তারেক মাসুদের মৃত্যুর ঘটনায় ক্যাথরিন মাসুদ মানিকগঞ্জের মোটর দুর্ঘটনা দাবি সংক্রান্ত বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বাসের ড্রাইভারের বিরুদ্ধে অনিয়ন্ত্রিত ড্রাইভিং-এর মামলা করেন, যেখানে গাড়ির মালিকসহ বীমা কোম্পানিকেও অভিযুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে মামলাটি হাইকোর্টে ট্রান্সফার করে আনা হয়। মামলায় দেশের উচ্চ আদালত ইমোশনাল ইনজুরির জন্য বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন অঙ্কের ক্ষতিপূরণ অনুমোদন করে, যার পরিমাণ চার কোটি টাকার বেশি এবং পরোক্ষ দায়ী হিসেবে চালকের পাশাপাশি পরিবহনের মালিককে শাস্তি প্রদানের নির্দেশ দেয়া হয়। এরই মধ্যে দেশে নতুন আইন অনুমোদন করা হয়। ফিটনেসবিহীন যানবাহন সড়কে নামানো হলে মালিক সম্প্রদায়ের দায় কতটুকু তা অবশ্য এই আইনে স্পষ্ট করা হয়নি। দুর্ঘটনা হলে নতুন আইনে শুধু ড্রাইভারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাা নেয়া যাবে। তাও আবার স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে নয়, দেশের প্রচলিত ফৌজদারি আইনে। সেখানেও কিছুটা সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে। সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ অনুযায়ী ড্রাইভার তার যোগ্যতা বিবেচনায় ড্রাইভিং করতে যোগ্য হবেন ও বিভিন্ন দোষসূচক পয়েন্ট বিবেচনায় ড্রাইভার তার ড্রাইভিং লাইসেন্স খোয়াতে পারেন। তবে প্রশ্ন হচ্ছে কে বা কারা এই দোষসূচক পয়েন্ট কাটবেন? আদৌ কি এরকম কোন পদক্ষেপ গ্রহণ শুরু হয়েছে? আমাদের দেশে কি ডিজিটাল ট্রাফিক সেন্সর বোর্ড সে পর্যন্ত সক্ষম করা হয়েছে যে, এ ধরনের দোষ সূচকের সূচক নির্ধারণ করবে? আর কত দুর্ঘটনা হলে দেশে সড়ক পরিবহনের বিদ্যমান আইন প্রয়োগ করা হবে?- এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া দুষ্কর। অন্যদিকে বর্তমানে বাংলাদেশে কোন পরিবহন সড়কে নামানোর জন্য বাধ্যতামূলক বীমার প্রয়োজন নেই। ১৯৮৩ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী বিধান ছিলÑ বীমা না করে কোন পরিবহন সড়কে নামানো যাবে না এবং এ বিধান অমান্য করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বিধায় আইন মান্য করা তথা শাস্তির ভয়ে গাড়ির মালিক অবশ্যই বীমা করতেন। ন্যূনতম বীমাটি বাধ্যকরী বীমা হিসেবে পরিচিত ছিল। এমনকি মোটরসাইকেলের জন্য ২৩০ টাকার একটি বাধ্যকরী বীমা অবশ্যই প্রয়োজন ছিল। নতুন আইনে পরিবহন বীমা করা বা না করা মালিকের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করবে। তাই বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথোরিটি (বিআরটিএ) দেশের সার্জেন্টদের নির্দেশ দিয়েছে- বীমা না থাকলে জরিমানা করা যাবে না। একইভাবে বীমা নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ (ইডরা) বীমা কোম্পানিগুলোকে ‘আইন বাধ্যতামূলক’ কোন বীমা না করতে নির্দেশ দিয়েছে। ২০২১ সালের জানুয়ারি মাস হতে সড়কে গাড়ি নামানোর জন্য বাধ্যতামূলক বীমার প্রয়োজন নেই। তবে মালিকগণ ইচ্ছা করলে তার গাড়ির বীমা করে রাখতে পারেন, যেটি দুর্ঘটনায় তার মোটরযানের কোন ক্ষতি হলে ক্ষতিপূরণের ঝুঁকি মোকাবেলা করতে সাহায্য করবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পরিবহন ক্ষতিগ্রস্ত হবার পাশাপাশি যাত্রী, পথচারী তথা আগন্তুকসহ অন্য পরিবহনের যাত্রী দুর্ঘটনায় আহত/নিহত হচ্ছেন। এদের ক্ষতিপূরণের বিষয়টি কি হবে? নতুন আইনে বিধান আছে- দুর্ঘটনার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা তার পরিবার বা মনোনীত ব্যক্তি আর্থিক সহায়তা তহবিল হতে ট্রাস্টি বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত ক্ষতিপূরণ বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে চিকিৎসার খরচ পাবার অধিকারী হবেন। মোটরযানের মালিক বা প্রতিষ্ঠানের নিকট হতে প্রাপ্ত চাঁদা ও অন্যান্য অনুদান দ্বারা এ তহবিল গঠিত হবে, যার বিস্তারিত বিধি দ্বারা ঠিক করা হবে। এ পর্যন্ত আইনের বিধি তৈরি হয়নি। এ ধরনের তহবিল কি তৈরি হয়েছে? দেশে সড়ক দুর্ঘটনার খবর যেভাবে পত্রিকাগুলোর শিরোনাম হয় বা হচ্ছে কখনও কি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যে, কোন এক সড়ক দুর্ঘটায় ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষ কোন ধরনের ক্ষতিপূরণ কোন তহবিল হতে গ্রহণ করেছেন? কাজেই দুর্বোধ্য এই তহবিল যদি গঠিতও হয় মানুষ তা কতটা জানে তা বোঝা যাচ্ছে না। মানুষ যে চিকিৎসার খরচ পাবার অধিকারী তা জানানোর ব্যবস্থা করতে হবে। আর্থিক সহায়তা তহবিল গঠন একটি ভাল পদক্ষেপ। কিন্তু তা বিচারিক ফোরামের বিকল্প হতে পারে না। পরিবহনের ড্রাইভারসহ মালিকপক্ষকে জবাবদিহি করার একটি পৃথক বিশেষ আইনী ফোরাম থাকতে হবে। জবাবদিহিতা না থাকলে স্বাভাবিকভাবে দক্ষ ড্রাইভার নিয়োগ বিষয়ে তারা উদাসীন হবেন। মালিকপক্ষকে বীমা করতেইবা কেন নিরুৎসাহিত করা হলো। বরং উপযুক্ত প্রিমিয়াম দিয়ে পরিবহনের যাত্রীসহ তৃতীয় পক্ষের জন্য বীমা নিশ্চিত করার বিধান বাধ্যতামূলক করার প্রয়োজন ছিল। বীমা ছাড়া পরিবহন চলাচল অনুমোদন- বিষয়টি একটি জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে তার নাগরিকদের সড়কে নিরাপত্তার বিষয়টি অনেকটা কম গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে প্রতীয়মান। সড়ক দুর্ঘটনা যেন প্রতিহত করা যায় এ বিষয়ে যেমন সকলকে সচেষ্ট থাকতে হবে, তেমনি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলে সম্ভাব্য ক্ষতির ঝুঁকি মোকাবেলার ব্যবস্থা করে সকলের জন্য নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করার বিষয়ে প্রচলিত আইনে জুডিসিয়াল ফোরাম ও বীমাকরণ এ দুটি বিষয় নিয়ে পুনরায় ভাবার অবকাশ রয়েছে। দেশে আইন তৈরি হয়েছে। এখন প্রয়োজন কার্যকর করার এক শক্তিশালী ফোরাম। লেখক : অধ্যাপক, আইন বিভাগ রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়
×