ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক ডাঃ মোঃ শারফুদ্দিন আহমেদ

ওমিক্রনে ভয় নয় জরুরী সচেতনতা

প্রকাশিত: ২৩:৪০, ২৬ জানুয়ারি ২০২২

ওমিক্রনে ভয় নয় জরুরী সচেতনতা

২০১৯ সালের ১ ডিসেম্বর চীনের উহান শহরে সর্বপ্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম রোগী শনাক্ত হয়। সময়ের পরিক্রমায় বাংলাদেশেও এ ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ২০২০ সালের ৮ মার্চ। ইতোমধ্যে বিভিন্ন রূপ ধারণ করেছে ভাইরাসটি। বিশ্বে এখন দাপট দেখাচ্ছে করোনাভাইরাসের ডেল্টা কিংবা বিটা ভ্যারিয়েন্ট। এরই মধ্যে আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে এবং বিশ্বের শতাধিক দেশে শনাক্ত হয়েছে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট অতি সংক্রমক ওমিক্রন। ওমিক্রনের উৎপত্তি সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু না জানা গেলেও এটুকু জানা যায় যে, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে এই ভ্যারিয়েন্ট সম্পর্কে প্রথম জানানো হয় ২৪ নবেম্বর। বর্তমানে যেসব ভ্যারিয়েন্ট রয়েছে সেগুলোর সঙ্গে ওমিক্রনের বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে। জেনেটিক বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, এটি একেবারেই ভিন্ন একটি শাখা থেকে এসেছে। ওমিক্রন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বব্যাপী। ডেল্টার চেয়ে মৃত্যুর হার কম হলেও এটি সংক্রমণের দিক থেকে করেনাভাইরাসের আগের যে কোন ভ্যারিয়েন্ট বা ধরনকে ছাড়িয়ে গেছে। ওমিক্রন নিয়ে দুশ্চিন্তা যেমন আছে, তেমনি আছে স্বস্তির কারণও। আর সেটা হলো ওমিক্রন ডেল্টার মতো প্রাণঘাতী নয়। ডেল্টায় আক্রান্ত হলে যেখানে মৃত্যুর হার শতকরা ২ থেকে ৩ জন, সেখানে ওমিক্রনে আক্রান্তের মধ্যে মৃত্যুর হার মাত্র শতকরা ০.০৩ শতাংশ। অর্থাৎ ওমিক্রনে আক্রান্ত হলে প্রায় ৩৩০০ জনের মধ্যে মৃত্যু হয় একজনের। করোনায় আক্রান্তদের হাসপাতালে ভর্তির ক্ষেত্রেও ওমিক্রন অনেক স্বস্তিকর। কারণ, ওমিক্রনে আক্রান্তদের হাসপাতালে ভর্তির হার মাত্র ০.৩৯ শতাংশ। গত ১৮ জানুয়ারি কোভিড-১৯ এর জেনোম সিকোয়েসিং গবেষণার ফল প্রকাশ করা হয়েছে বিএসএমএমইউ থেকে। গত ৮ ডিসেম্বর থেকে গত ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত সংগৃহীত নমুনার ২০ শতাংশ ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট এবং ৮০ শতাংশ ডেল্টা ভেরিয়েন্ট পাওয়া যায়। গবেষণায় মোট ৭৬৯ কোভিড-১৯ পজেটিভ রোগীর ন্যাযো ফ্যারিন জিয়াল সোয়াব স্যাম্পল থেকে নেক্সট জেনারেশন সিকোয়েসিংয়ের মাধ্যমে করোনাভাইরাসের জেনোম সিকোয়েসিং করা হয়। গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় ৯ মাস থেকে ৯০ বছর বয়স পর্যন্ত রোগী। এর মধ্যে ২১ থেকে ৫৮ বছর বয়সের রোগীদের সংখ্যা বেশি। কোভিড আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে যাদের কো-মরডিবিটি রয়েছে, যেমন-ক্যান্সার, শ্বাসতন্ত্রের রোগ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস তাদের মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। পাশাপাশি ষাটোর্ধ বয়সের রোগীদের দ্বিতীয়বার সংক্রমণ হলে সেক্ষেত্রে মৃত্যু ঝুঁকি বেশি পরিলক্ষিত হয়। গত জুলাই ২০২১ এ কোভিড-১৯ এর জেনোম সিকোয়েসিং করেছিলাম আমরা। সেখানে মোট সংক্রমণের প্রায় ৯৮ শতাংশ পাওয়া যায় ইন্ডিয়ান বা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। ১ শতাংশ পাওয়া যায় সাউথ আফ্রিকান বা বেটা ভ্যারিয়েন্ট। ১ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে আমরা পেয়েছিলাম মরিসাস বা নাইজিরিয়ান ভ্যারিয়েন্ট। এরপর জুলাই ২০২১ থেকে ডিসেম্বর ২০২১ এর প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত জিনোম সিকোয়েসিংয়ের প্রাপ্ত ফল ছিল ৯৯.৩১% ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। সর্বশেষ ৮ ডিসেম্বর ২০২১ থেকে ৮ জানুয়ারি ২০২২ পর্যন্ত সংগৃহীত স্যাম্পলের ২০% ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট এবং ৮০% ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া যায়। এই ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট গাণিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টে অনেক বেশি রহভবপঃরড়হ ছড়াচ্ছে বলে প্রতীয়মান। ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট ভাইরাসের জেনেটিক কোড এ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে বেশি ডিলিশন মিউটেশন পাওয়া গেছে, যার বেশির ভাগ ভাইরাসটির স্পাইক প্রোটিন রয়েছে। এই স্পাইক প্রোটিনের ওপর ভিত্তি করে বেশির ভাগ ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়। স্পাইক প্রোটিন-এর বদলের জন্যই প্রচলিত ভ্যাকসিনেশনের পরেও ওমিক্রন সংক্রমণের সম্ভাবনা থেকে যায়। এই জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ে কোন কোন ওমিক্রন আক্রান্ত রোগীর দুই ডোজ ভ্যাকসিন দেয়া ছিল। তৃতীয়বারের মতো সংক্রমণ রোগী পাওয়া গেছে। হাসপাতালে ভর্তিরোগী থেকে সংগৃহীত নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স করে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে। যেহেতু ওমিক্রন সংক্রমণে মৃদু উপসর্গ হয়েছে, সেটা হাসপাতালে ভর্তি রোগীতে ওমিক্রন না পাবার কারণ হতে পারে। পাশাপাশি মৃদু উপসর্গের রোগীদের মধ্যে টেস্ট না করার প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে। তাই প্রাপ্ত ফলের চেয়েও অনেক বেশি ওমিক্রন আক্রান্ত রোগী ঁহফবঃবপঃবফ অবস্থায় আছে। প্রত্যেক করোনাভাইরাস ভ্যারিয়েন্ট বিপজ্জনক এবং তা মারাত্মক অসুস্থতা এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। পাশাপাশি ভাইরাসের নিয়মিত মিউটেশনের প্রবণতা আমাদের প্রচলিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ঝুঁকিপূর্ণ করতে পারে। তাই করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে সবাইকে। ডেল্টার চেয়ে ওমিক্রনে আক্রান্ত রোগীর অসুস্থতা তুলনামূলক কম হলেও ওমিক্রন বিপজ্জনক হতে পারে। বিশেষ করে যারা টিকা গ্রহণ করেননি তাদের জন্য। নিজেকে, পরিবারকে এবং দেশবাসীকে করোনার ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করার জন্য সরকার ঘোষিত স্বাস্থ্যবিধি অবশ্যই মেনে চলতে হবে। পাশাপাশি যে বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্ব আরোপ করতে হবে তা নিম্নরূপ- * বাসার বাইরে গেলে নিয়মিত মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। * করোনা পরীক্ষার পরিমাণ বাড়াতে হবে। * পরীক্ষার পর রোগ শনাক্ত হলে দ্রুত কোয়ারেন্টাইনে বা আইসোলেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। * টিকা গ্রহণকারীদের সংক্রমণের হার খুব কম। তাই টিকা কার্যক্রমে সবাইকে অংশগ্রহণ করতে হবে। * সকল ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অন্যান্য জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে। সর্বশেষ, সরকার ঘোষিত স্বাস্থ্যবিধি সবাইকে মেনে চলতে হবে। ওমিক্রন বা ডেল্টা যে ধরনই হোক না কেন, সবাইকে সতর্ক থাকতেই হবে। তা না হলে অনেক মূল্য দিতে হবে আমাদের সবাইকে। আগামীর সময় করোনামুক্ত হোক ধরণী, এই প্রত্যাশা আমাদের সবার। লেখক : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×