ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শামীম আহমেদ

টরেন্টোর চিঠি ॥ ভেবেছিলাম মেঘ ভেঙ্গে বৃষ্টি হবে

প্রকাশিত: ২৩:৩৬, ২৬ জানুয়ারি ২০২২

টরেন্টোর চিঠি ॥ ভেবেছিলাম মেঘ ভেঙ্গে বৃষ্টি হবে

কবি সৌরভ মাহমুদ এক বিষণœ দিনে বিদায় নিলেন পৃথিবী থেকে। এই যে অভিমান, মাটির থেকে শিকড়ের উত্থান, তারপর নিভৃতে ডানা মেলে উড়ে চলা মায়ার টানে ওপারে, এই ঘনঘটা চলছে বেশ কিছুদিন ধরেই। তারুণ্য জ্বলজ্বলে, তবু কোথাও থেকে মৃত্যুর অমোঘ নিনাদ বেজে ওঠে। সেই ডাকে সাড়া না দিয়ে পারা যায় না। মৃত্যুর আগে শেষবারের মতো প্রতিধ্বনি করেছিলেন আল মাহমুদের কবিতা, ‘আর আসবো না বলে, দুধের ওপরে ভাসা সর চামচে নিংড়ে নিয়ে চেয়ে আছি। বাইরে বৃষ্টির ধোঁয়া যেন সাদা স্বপ্নের চাদর বিছিয়েছে পৃথিবীতে।’ উৎপল কুমার বসুর শাণিত বাণী যার কর্ণকুহরে, মৃত্যু তাকে হাতছানি দেয় কোন বাসনায় কে জানে! কবি সৌরভ যাবার সময় মনে করিয়ে দিলেন আসার কথা। তার প্রিয় কবি জহর সেন মজুমদারের ভাষায়, ‘আসলে আমি এই নাগরিক যন্ত্রজীবনের অর্থহীন প্রতিযোগিতা এবং অর্থহীন কোলাহলের কেউ নই; একদিন গ্রাম থেকে এই যক্ষপুরীর গহ্বরে এসে ঢুকে পড়েছিলাম...তারপর আর বেরোতেই পারলাম না।’ সব কবির অন্তরাত্মাকে যেন একটি লাইনে বেঁধে ফেলেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, ‘অনেক জন্ম অভিশপ্ত গেলে পরে এক জন্মে কবি হওয়া যায়।’ এমন উদাসী সন্ধ্যায় বহুদিন পর কবিতা লিখছিলাম। কবিতা হচ্ছিল কিনা কে জানে, কিন্তু মনের গহীন থেকে আবেগেরা উঁকি দেয় নির্দ্বিধায়। ‘সূর্য উঠলে ইদানীং বিষণœ লাগে, মনে হয়, সবকিছু দেখে ফেলছে সবাই, হৃদয়ের ভেতর যতœ করে লুকিয়ে রাখা কষ্টগুলো পর্দা সরিয়ে বের করে আনছে সবাই। অথচ অন্ধকারে ভাল থাকা হয় বেশ। কষ্টগুলো শীতের কম্বল সরিয়ে পাশে এসে বসে।’ চাইলেও কি আর শীতের কম্বল সরিয়ে রাখা যায়? বহু বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তুষারপাতে যখন চাদর মুড়ি দিয়েছে টরোন্টো, তখন সেই শীতকে কম্বলে জড়ানো না গেলেও নিজেকে আপাদমস্তক ঢেকে ফেলতে হয় অস্তিত্ব রক্ষার্থে। এদিকে গত দু’বছরে করোনাভাইরাসের আলফা, ডেলটা সব ভ্যারিয়েন্ট সামনে চলা মানুষগুলোও ওমিক্রনের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। আমার ছয়তলা ওপরে থাকা নেপালী-কানাডিয়ান ছাত্র রমেশ লামসাল ও তার পরিবারের সব সদস্য একযোগে আক্রান্ত হলো বছরের শেষে। এখানে কেউ কারও খুব ঘনিষ্ঠ না হলে বা আগ বাড়িয়ে আলাপ করার মতো সম্পর্ক না থাকলে ব্যক্তিগত বিষয় জানা যায় খুব কম। নতুন বছরে ঢিমেতালে রমেশ জানান দিল ওমিক্রনে আক্রান্ত হবার কথা। আমি স্বভাবসুলভ অভিনন্দন জানিয়ে মশকরা করার পর জানালো প্রথমে দু’বছরের শিশু সন্তান আক্রান্ত হয়, পরীক্ষা করলে জানা গেল সবাই আক্রান্ত। ওমিক্রন ছাড়ছে না কাউকেই। বিজ্ঞানীরা অবশ্য মনে করছেন ওমিক্রন এত সংক্রামক যে, সেটি বেশিরভাগ মানুষকেই আক্রান্ত করবে এবং হয়ত এর মধ্য দিয়ে করোনাভাইরাসের বিপক্ষে একটি প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা গড়ে উঠবে পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষের। সঙ্গে দুই-তিন ডোজ ভ্যাক্সিন এই প্রতিরক্ষাকে শক্তিশালী করবে বহুগুণ এবং বছর শেষে আমরা হয়ত করোনামুক্তির দিশা খুঁজে পাব। জানুয়ারির ৩১ তারিখ থেকে বিধি-নিষেধ শিথিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্টারিও প্রাদেশিক সরকার। বন্ধ থাকা রেস্তরাঁগুলো আবার খুলে যাবে। ধারণক্ষমতার অর্ধেক অতিথিকে আপ্যায়ন করতে পারবে তারা। অন্যান্য নিয়মনীতির বেড়াজালও কমানো হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন বিশেষজ্ঞরা তাদের দ্রুত ক্যাম্পাসে ফিরানোর কথা বলছেন। প্রায় আড়াই বছর ঘর থেকে ক্লাস করার পর ফেব্রুয়ারিতে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা ক্লাস করবে ক্যাম্পাসে বসে। যদিও সংক্রমণের ঝুঁকি আছে, কিন্তু তার চাইতে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ঝুঁকি বেশি বিপজ্জনক মনে করছেন অনেকেই। বরফ শীতল দিনগুলোতে কেন যেন বারবার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাসের কথা মনে পড়ে। সুনীল তার পূর্ব-পশ্চিম উপন্যাসে জীবন্ত বর্ণনা দিচ্ছিলেন ঠিক এভাবে, ‘ভোরবেলা থেকে পেঁজা তুলোর মতন তুষার দুলতে দুলতে নামছে। বৃষ্টির শব্দ থাকে, কিন্তু তুষারপাত একেবারে নিঃশব্দ।’ আমার প্রথম তুষারপাতের অভিজ্ঞতা জেনেভায়। জাতিসংঘের একটা উচ্চপর্যায়ের কমিটিতে বিশেষজ্ঞ মতামত দেবার জন্য গিয়েছিলাম সেখানে, ২০১২ সালে। খুবই কালো কালো বিষণœ এক রাতে পৌঁছুলাম জেনেভা বিমানবন্দরে। সেখানে এয়ারপোর্ট থেকে ট্রেনে করে হোটেলে পৌঁছে নিজ কামরায় প্রবেশের আগ পর্যন্ত শান্তি নেই। তার ওপর আবার প্রচন্ড শীতে বাইরের দিকে তাকালে চলমান জীবনযাত্রায় তুষারপাতের আগ্রাসী মনোভাব। সে যাত্রায় তুষারপাত যে খুব উপভোগ করেছি এমনটা নয়। তবে ওখানে এক চমৎকার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ওই মিটিং-এ যারা সারাবিশ্ব থেকে আমন্ত্রিত ছিলাম, টেনেটুনে ১২-১৫ জন, তাদের মধ্যে আমি ছিলাম সবচেয়ে তরুণ। মিটিং-এর শেষ দিন জাতিসংঘের ওই ভবন থেকে বারান্দার দরজা খুলে দেয়া হলো। সুস্বাদু পেস্ট্রি খেতে খেতে গরম কফিতে চুমুক দিয়ে দরজার এপাশ থেকে সবাই তুষারপাত দেখছিল। আমি দরজা পেরিয়ে বারান্দায় চলে গেলাম। তিনতলার সেই বারান্দাও বিশাল। বরফ মাড়ানোর মতো জুতো ছিল না আমার পায়ে। তবুও গিয়ে আনমনে মেঝেতে জমে থাকা তুষারে হাত বুলাচ্ছিলাম। তখন পাশ থেকে আমেরিকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা এসে জিজ্ঞেস করলেন, এটাই আমার প্রথম তুষারপাত দেখা কিনা! আমি সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়তেই তিনি চিৎকারসহকারে হুল্লোড় করে উঠলেন। বললেন, আমরা ছোটকাল থেকে তুষারপাতের সময় বরফের বল বানিয়ে একজন আরেকজনের দিকে ছুঁড়ে খেলতাম আমেরিকায়। আজকে তোমার প্রথম তুষারপাত, আমি তোমার শরীরও তুষারের বল বানিয়ে ছুঁড়ব। বলেই তিনি বড় বড় তুষারে বল ছুঁড়ে মারা শুরু করলেন আমার দিকে। তার উচ্ছ্বাস দেখে অন্য অনেকেও বারান্দায় নেমে আসলেন এবং বাচ্চাদের মতো আনন্দে মেতে উঠলেন। আমি যেদিন প্রথম টরোন্টো আসি সেদিন মৃদু তুষারপাত হচ্ছিল। তার কিছুদিন পরেই ব্যাপক তুষারপাত হয়। বৃষ্টিপ্রেমিক মানুষ হিসেবে কানাডায় আমি এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করি। এখানে বৃষ্টি হবার সময়ও আকাশ ঘনঘোর অন্ধকার হয় না, কেমন একটা ফ্যাকাসে সাদা রঙের আকাশ নিয়ে টুকটাক বৃষ্টি হয়। সেই বৃষ্টি রাস্তা ভেজায়, কিন্তু আমার মন ভেজাতে পারে না। বৃষ্টির অভাব, কালবোশেখীর উত্তেজনা এখানে কিছুটা হলেও তুষারপাতের দিনগুলো ফিরিয়ে দেয়। শুধু অভাববোধ করি সুষমার। হাঁটু সমান বরফ মাড়িয়ে যখন উপত্যকার শেষপ্রান্তে পৌঁছে যাই তখন কালপুরুষের কবিতার মতো বলতে ইচ্ছে করে, ‘আমি তোমার নাম বরফ দিয়ে লিখেছি, তুমি আমার নাম আগুন দিয়ে লেখ।’ অথচ বলা হয় না। হিমাঙ্কের বহু নিচে জমে যাওয়া বাতাস যখন ফুসফুসটাকে ভরে দেয়, তখন ভালবাসাগুলো আর্তনাদ করে অসম্ভব কোন প্রাপ্তিতে। শূন্যতার মধ্যে যে বেঁচে থাকা, তার মধ্যে যে হাহাকার, সেই হাহাকারকে যদি একবার মরূদ্যান বানিয়ে ফেলা যায় এই বরফের দেশে, তবে সেখানে ভরা জোছনায় কৃষ্ণচূড়ার ডালে নীলকণ্ঠী নারীর বুকে অচেনা স্বপ্নজাল বুনতে দেরি কেন? গভীর রাতে যে ঘুম না আসার ক্লান্তি তাকে ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখতে জানতে হয়; তবেই না সুষমার সাজিয়ে রাখা ভেজা কাঁসায় প্রেম প্রেম গন্ধে হারিয়ে যাওয়া যায় সবকিছু ডুবিয়ে দেয়া এই শফেদ শহরে। ২৪ জানুয়ারি ২০২২ টরেন্টো, কানাডা
×