ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

চলতি বাজেটে ব্যবসাবান্ধব পলিসিই মূল কারণ বারভিডায় প্রশাসক প্রত্যহারে আপিল আবেদনের শুনানি

গাড়ি আমদানিতে খাতে রেকর্ড রাজস্ব আদায়ের সম্ভাবনা

প্রকাশিত: ২০:১১, ২৫ জানুয়ারি ২০২২

গাড়ি আমদানিতে খাতে রেকর্ড রাজস্ব আদায়ের সম্ভাবনা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ব্যবসা বান্ধব পলিসির কারণে করোনার মধ্যেও দেশে জাপানি ব্যবহৃত গাড়ি আমদানির ব্যবসা এখন জমজমাট। গাড়ি ব্যবহার বাড়ায় বৃদ্ধি পেয়েছে আমদানি, একই সঙ্গে সরকারের রাজস্ব আদায়ের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। চলতি বাজেটে ব্যবসাবান্ধব পলিসির কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে বলে জানা গেছে। আশা করা হচ্ছে, মহামারী করোনার এই সময়ে চলতি অর্থবছর শেষে শুধু জাপানি ব্যবহৃত গাড়ি থেকে সরকারের রাজস্ব আদায় হবে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। ব্যবহৃত গাড়ি আমদানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিক্যালস ইম্পোর্টার্স এন্ড ডিলার্স এসোসিয়েশন (বারভিডা) থেকেও পরিবেশবান্ধব জাপানি গাড়ি আমদানি এবং সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইতোমধ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এরই ধারবাহিকতায় সরকার এ খাতের জন্য একটি ইতিবাচব ব্যবসা-বান্ধব পলিসি গ্রহণ করতে সমর্থ্য হয়েছে। এদিকে আগামী বৃহস্পতিবার বারভিডায় প্রশাসক নিয়োগ প্রত্যহার চেয়ে আপিল আবেদনের শুনানি করতে যাচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাজেট সামনে রেখে এনবিআরের সঙ্গে এ্যাডভোকেসি ও আলোচনার সুবিধার্থে প্রশাসক প্রত্যাহার করে বর্তমান কমিটি কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করা হবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন। জানা গেছে, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে গত ২০২০ সালে গাড়ি বিক্রি কমে যায় প্রায় ২৬-৩০ শতাংশ। শতাংশ। তবে সেই ধাক্কা সামলে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করায় গত জানুয়ারি মাস থেকে গাড়ি বিক্রি বাড়তে থাকে। গত নয় মাসে রেকর্ড পরিমাণ গাড়ি আমদানি হয়েছে। মোংলা সমুদ্র বন্দর কাস্টমস, বিআরএটিএ এবং গাড়ি আমদানিকারকদের সংগঠন বারভিডা সূত্রে জানা গেছে, শুধু মোংলা বন্দর দিয়ে জানুয়ারি থেকে ১৫ নভেম্বর মাস পর্যন্ত ১৬ হাজার ১৩৭ ইউনিট গাড়ি আমদানি হয়েছে। গত বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৩ হাজার ৬৯ ইউনিট গাড়ি আমদানি হয়েছিল। অর্থাৎ ৩ হাজারেরও বেশি গাড়ি আমদানি হয়েছে। বছর শেষে এই আমদানি পরিমাণ সাড়ে ১৮ হাজার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। একই অবস্থা দেশের অন্যতম ও বড় ও প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রামে। এই বন্দর দিয়েও গাড়ি আমদানি বেড়েছে বলে জানা গেছে। গত বছর বিভিন্ন বন্দর দিয়ে সারাবছরে ২৩ হাজার গাড়ি আমদানি হয়েছিল, এবার সেই সংখ্যা দেড়গুন বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। গাড়ি আমদানি বাড়ায় সরকারের রাজস্ব আয়ও বেড়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিক্যালস ইম্পোর্টার্স এন্ড ডিলার্স এসোসিয়েশনের (বারভিডা) সভাপতি আবদুল হক বলেন, বর্তমান সরকারের রাজস্ব বান্ধব পলিসির কারণে গাড়ির বাজার সম্প্রসারণ হচ্ছে। দাম কমে যাওয়ার ফলে ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ায় বেড়েছে গাড়ি আমদানি। এতে করে সরকারের রাজস্ব আয় বেড়েছে। এ বছর ব্যবসা ভাল হয়েছে গাড়ি ব্যবসায়ীদের। তিনি বলেন, বাজেটে হাইব্রিড কার, জিপ ও মাইক্রোবাসের শুল্ক পূণর্বিন্যাস করায় এসব গাড়ির ক্রেতারা ২ থেকে ৩ লাখ টাকার ছাড় পাচ্ছেন। ফলে মধ্যবিত্তরা সহজে গাড়ি কিনতে পারছেন। সবার জন্য এটি একটি উইন উইন সিচুয়েশন বলা যায়। সড়ক দুর্ঘটনারোধে নসিমন ও করিমনের মতো গাড়ির ব্যবহার বন্ধে মাইক্রোবাসকে গণপরিবহন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এটিও একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। তবে, জাপানি রিকন্ডিশন্ড প্রাইভেটকার প্রিমো, এ্যালিয়ন, এক্সিও এবং প্রবক্সের মতো বহুল প্রচলিত গাড়ির দাম কমেনি। দেশে বেশি ব্যবহার হয় জাপানি ব্যবহৃত গাড়ির অবচয় সুবিধা দেয়া হয়নি। আগামী বাজেটে এই সুবিধা দেয়া গেলে সরকারের রাজস্ব আয় আরও বৃদ্ধি পাবে। জাপান সরকারের করা ইয়োলো বুক অনুযায়ী ব্যবহৃত গাড়ির দাম নির্ধারণে একটি কমপ্রেহেনসিভ পলিসি করা উচিত। এটা করা গেলে করে গাড়ির শুল্ক নির্ধারণ নিয়ে কোন জটিলতা থাকবে না। মোংলা ও চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্র জানিয়েছে, করোনা মহামারির মধ্যেও গাড়ি আমদানি বেড়েছে। বছর শেষে গত অর্থবছরের তুলনায় এ খাত থেকে রাজস্ব আদায় বাড়বে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। সম্প্রতি পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআরআই) আয়োজিত এক সেমিনারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারী শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, উচ্চ সিসির গাড়িতে আমদানি শুল্ক কমানো হলে রাজস্ব আয় বাড়বে। বর্তমানে গাড়ি আমদানির ক্ষেত্রে ১২৮ শতাংশ থেকে ৮২৭ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক কাঠামো রয়েছে, যা অত্যন্ত বেশি। ওই একই সেমিনারে পিআরআই এর চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশে সৌর এবং জ্বালানিভিত্তিক মোটরগাড়ি নির্মাণ শিল্প স্থাপন করতে হবে। এদেশে গাড়ি নির্মাণ শিল্পকে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে বলেন নতুন প্রযুক্তির গাড়ি নির্মাণের দিকে এগিয়ে যেতে পারি। প্রশাসক নিয়োগের প্রত্যাহারে আপিল আবেদন ॥ প্রশাসক নিয়োগ প্রত্যাহার চেয়ে আপিল আবেদন করেছেন বারভিডার সভাপতি আব্দুল হক। তবে সেই আবেদন ওপর আগামী বৃহস্পতিবার আপিল আবেদনের ওপর শুনানি করতে যাচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাজেট সামনে রেখে বারভিডা থেকে প্রশাসক প্রত্যাহার করে বর্তমান কমিটির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করা হবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন। জাতীয় অর্থনীতিতে এ খাতের গুরুত্ব দিনদিন বাড়ছে। এলডিসি গ্রাজুয়েশনে উত্তীর্ণ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্ন পূরণে বারভিডা থেকেও নতুন কৌশল নির্ধারণ, এখাতের জন্য নীতি প্রণয়ন এবং গাড়ির বাজার সম্প্রসারণে কাজ শুরু করা হয়েছে। এলক্ষ্যে বারভিডাকেও একটি কার্যকরী, যুগোপযোগী এবং আন্তর্জাতিক মানের বাণিজ্য সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চান এ খাতের নীতিনির্ধারকরা। কিন্তু নানা ধরনের অপপ্রচার, স্বার্থান্বেষী মহল কর্তৃক সংগঠনকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়া এবং ষড়যন্ত্রের মুখে বারভিডাকে বিতর্কিত করা হচ্ছে। ঝিঁমিয়ে পড়ছে বারভিডার মূল কার্যক্রম। এ প্রসঙ্গে বারভিডার প্রতিষ্ঠাকালীন এক সদস্য জানান, মূলত প্রশাসক নিয়োগের ফলে বারভিডার কার্যক্রম নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। অথচ বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ বারভিডাকে একটি বিশ্বমানের বাণিজ্য সংগঠন হিসেবে দাঁড় করাতে কাজ শুরু করেছিল। বারভিডার নিজস্ব ভবন, গবেষণাগার এমনকি দক্ষ জনবল নিয়োগের মতো আর্থিক সঙ্গতি নেই। এসব দিক বিবেচনায় নিয়েই আব্দুল হক নেতৃত্বাধীন পরিচালনা পরিষদ বারভিডার তহবিল বৃদ্ধির লক্ষ্যে গাড়ি প্রতি ১ হাজার টাকা লেভি আদায়ের প্রচলন শুরু করেছিলো। যা সর্বসম্মতিক্রমে বার্ষিক সাধারণ সভায় গৃহিত হয়। এই অর্থ বারভিডার আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, নিয়মিত গবেষণামূলক কার্যক্রম চালু রাখা, সদস্যদের মৃত্যুজনিত কারণে আর্থিক সহযোগিতা, নিজস্ব ভবন নির্মাণ এবং সামাজিক কল্যাণে ব্যয় হচ্ছে। অথচ পুরো বিষয়টিকে বিতর্কিত করে পরিচালনা পর্ষদকে হেয় ও ব্যক্তিগতভাবেও আক্রমণ করে কুৎসা রটানো হচ্ছে। যা সম্পূর্ণ অনাকাঙ্খিত এবং অনভিপ্রেত। তিনি জানান, দেশের অন্যান্য বাণিজ্য সংগঠনও নিজস্ব তহবিল বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন নামে সার্ভিস চার্জ আদায় করে থাকে। যেমন পোশাকখাতের সংগঠন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ইউডি চার্জ, বাংলাদেশ ফ্রুটস ভেজিটেবল এ্যাসোসিয়েশনসহ প্রায় সংগঠনই সার্ভিস চার্জ আদায় করছে। আদায়কৃত এই অর্থ সংগঠনের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ব্যয় করা হয়। কিন্তু এসব বিষয় সামনে এনেই বারভিডার নির্বাচন স্থগিতসহ প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আপিল শুনানিতে প্রশাসক নিয়োগ প্রত্যাহার হবে-এমনটাই আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, বারভিডার কার্যক্রমকে বিতর্কিত করতে একটি পক্ষ সংগঠনটির তহবিল তছরুপের অভিযোগ এনে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ দিয়েছে। এই অভিযোগের কারণে বারভিডার আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধির মতো এই উদ্যোগটি এখন ভেস্তে যেতে বসেছে। যদি তাই হয়, তাহলে এই সংগঠনটির পক্ষে গবেষণামূলক কাজসহ কোন কর্মকান্ডই ভবিষ্যতে আর সম্ভব নয়। সড়ক দুর্ঘটনা বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি হয়। হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয় প্রতিবছর। লাখ লাখ মানুষ আহত হউন সড়ক দুর্ঘটনায়। এ এক বড় ধরনের সামাজিক অবক্ষয়ের নাম। এর পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব গাড়ি ব্যবহার হচ্ছে কিনা সেটাও একটি জরুরি বিষয়। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের উচ্চ ঝুঁকির মুখে এখন বাংলাদেশের নাম। এ অবস্থায় গাড়িখাতে বেশি বেশি গবেষণা হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করা হচ্ছে। এর সঙ্গে দক্ষ চালক গড়ে তোলা. রোড সেফটি নিশ্চিত করা, আইনকানুন সম্পর্কে জ্ঞান রাখার মতো বিষয় রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বারভিডার সভাপতি আব্দুল হক বলেন, সংগঠনকে এগিয়ে নিতে তথ্য, পরিসংখ্যান এবং গবেষণার ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া প্রয়োজন। দেশের জাপানি ব্যবহৃত গাড়ি খাত সংশ্লিষ্ট বিধিবিধানে বৈষম্য ও অসঙ্গতি এবং এ খাতের চ্যালেজ্ঞ ও সম্ভাবনা এবং জাতীয় অর্থনীতিতে বারভিডার অবদান সম্পর্কে নিয়মিত গবেষণা করতে একটি কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বারভিডার উদ্যোগে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআরআই) এর মাধ্যমে ২০১৯ সালে একটি গবেষণা করা হয়। সেই গবেষণায় রোড সেফটি এবং পরিবেশবান্ধব গাড়ি নিশ্চিত করতে বেশকিছু সুপারিশ পাওয়া যায়। কিন্তু এ ধরনের কার্যক্রম নিয়মিত করতে হলে বারভিডার আর্থিক সক্ষমতা থাকতে হবে। এসবদিক বিবেচনায় নিয়েই সদস্যসদের সর্বসম্মতি মতামত গ্রহণ করে গাড়ি প্রতি ১ হাজার টাকা লেভি আদায় করা হচ্ছে। এই অর্থ জমা হয় বারভিডার নিজস্ব হিসেবে। যেখানে প্রতিবছর অডিট হয়ে থাকে। সদস্যদের জানার বাইরে এই তহবিলের একটি টাকাও খরচ করার কোন সুযোগ নেই। অথচ এই রকম একটি ভাল উদ্যোগ থামিয়ে দেয়ার জন্য পুরো বিষয়টিকে বিতর্কিত করা হচ্ছে। এটা নোংরামি ছাড়া আর কিছুই নয়। এদিকে, বারভিডার দুটি বার্ষিক সাধারণ সভায় সর্বোচ্চ ফোরাম সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত এবং সংগঠনের সংঘবিধি অনুসরণ কওে ২০২০ সালের ৫ নভেম্বও মোংলা বন্দওে লেভি আদায় কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। মোংলা বন্দও কর্তৃপক্ষের সাথে বারভিডার যৌথ সমঝোতা অনুযায়ী লেভি আদায় শুরু হয়। চলতি বছর জুলাই থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ৪ মাসে ৫২ লাখ ৬১ হাজার লেভি আদায় হয়েছে। লেভি আদায়ের এই অর্থ থেকে বারভিডার নামে প্রথমবারের মতো ৫০ লাখ টাকার এফডিআর করা হয়েছে।
×