ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘সুর সপ্তক’ ঘিরে কৌতূহল বাড়ছেই

শুধু পথচারী পারাপার নয়, যেন ভূগর্ভস্থ গ্যালারি

প্রকাশিত: ২৩:৪১, ২৫ জানুয়ারি ২০২২

শুধু পথচারী পারাপার নয়, যেন ভূগর্ভস্থ গ্যালারি

মোরসালিন মিজান ॥ পথচারী পারাপারের জন্য যে আন্ডারপাস সেটিও এত দৃষ্টিনন্দন হতে পারে! অন্তত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এমনটি কেউ আশা করতে যাবেন না। তবে কিছু ব্যতিক্রমও ঘটে। বিমান বন্দর সড়কে সম্প্রতি চালু হওয়া আন্ডারপাসটি সেই সব ব্যতিক্রমের খাতায় নাম লিখিয়েছে। এর বাইরের কাঠামোটি দৃশ্যমান হওয়ার পর থেকেই সবাই কৌতূহলী চোখে তাকাচ্ছিলেন। আর উদ্বোধনের পর থেকে তো দারুণ আলোচনায়। মূল সড়কের নিচ দিয়ে নিরাপদে রাস্তা পারাপার। পাশাপাশি সুসজ্জিত গ্যালারি ঘুরে দেখার অনুভূতি। আন্ডারপাসটির দেয়াল, হ্যাঁ, নানা ছবি ও চিত্রকর্ম দিয়ে সাজানো। দেখতে দেখতে যাওয়া যায়। ছোটখাটো কিন্তু আনন্দঘন একটা পরিভ্রম। বেশ লাগে। বিমানবন্দর সড়কের এই জায়গাটিতে আগে কোন ফুটওভারব্রিজ ছিল না। একটিমাত্র জেব্রাক্রসিং ব্যবহার করে চলত পথচারী পারাপার। শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল এ্যান্ড কলেজের ছাত্রছাত্রী এবং কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা রোগীদের তীব্র ঝুঁকি নিয়ে মহাসড়ক পার হতে হতো। নতুন আন্ডারপাস নির্মাণের পেছনে রয়েছে একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনার গল্প। দুর্ঘটনাটি সে সময় ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছিল। অনেকেরই মনে থাকার কথা, ২০১৯ সালের ২৯ জুলাই এ রাস্তা পার হতে গিয়ে মৃত্যু হয়েছিল শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল এ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থীর। দিয়া খানম ও আবদুল করিম রাজীবের নির্মম মৃত্যুর ঘটনায় রাজধানীজুড়ে বিপুল প্রতিবাদ গড়ে ওঠে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শুরু হয় অভূতপূর্ব এক আন্দোলন। তখনই সেখানে একটি আন্ডারপাস নির্মাণের সিদ্ধান্তের কথা জানান মেয়র আতিকুল ইসলাম। পরবর্তীতে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের অধীনে আন্ডারপাসটি নির্মাণের দায়িত্ব দেয়া হয় সেনাবাহিনীকে। বক্সপুশিং প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কাজটি তারা সম্পন্ন করে। এ আন্ডারপাস নির্মিত হওয়ার ফলে শিক্ষার্থীদের দাবির বিষয়টি যে সরকার গুরুত্ব দিয়ে ভেবেছে তা অনুমান করা যায়। একই কারণে প্রধানমন্ত্রী নিজেই এটি উদ্বোধন করেন। বর্তমানে প্রতিদিন বহু মানুষ আন্ডারপাসটি ব্যবহার করছেন। এটি নির্মাণের ফলে শিক্ষার্থী ও পথচারীদের সড়ক পারাপার নিরাপদ হওয়ার পাশাপাশি এয়ারপোর্ট মহাসড়কের বড় একটি অংশ যানজট মুক্ত রাখতে ভূমিকা রাখছে। অত্যাধুনিক আন্ডারপাসে চলাচলের জন্য আছে ৩২০ মিটার র‌্যাম্প। পায়ে হাঁটার পথ ছাড়াও রয়েছে চলন্ত সিঁড়ি। তার চেয়েও বিস্ময়কর যে, লিফটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আছে হুইল চেয়ারও। দৃষ্টিনন্দন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ডর্ম আছে। আর দেয়াল সাজানো হয়েছে গ্যালারির মতো করে। আন্ডারপাসটির নামকরণ করা হয়েছে ‘সুরসপ্তক।’ এমন নামকরণের মধ্যে এক ধরনের শিল্পরুচির প্রকাশ ঘটে। সেইসঙ্গে গুরুত্ব পায় ইতিহাস চেতনা। ‘সপ্তক’ মানে ৭। এর মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ইতিহাসটি স্মরণ করা হয়েছে। একইসঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে ৭ বীর শ্রেষ্ঠ’র বীরত্বগাথা। দেয়ালচিত্রে ১৯৭১ সালে রেসকোর্স ময়দানে দেয়া মহান নেতার ভাষণ। পাশেই ৭ বীরশ্রেষ্ঠ’র প্রতিকৃতি। এভাবে শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বান এবং বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার ইতিহাসটি তুলে ধরার চেষ্টা। পাশাপাশি দেয়ালচিত্রে স্থান পেয়েছে শহীদ মিনার ও জাতীয় স্মৃতিসৌধ। সুরসপ্তকের দেয়ালজুড়ে আছে বিশালাকার আলোকচিত্র। এসব আলোকচিত্রে প্রচীন ঢাকার উপস্থাপনা। শত শত বছর আগে এই নগরী কেমন ছিল, বিবর্তনে কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে, অল্প করে হলেও ফিরে দেখার সুযোগ হয়। আবার আবহমান গ্রামবাংলার ছবিও এখানে রাখা হয়েছে। ফেলে আসা নদী নৌকা জল ফ্রেমে বাঁধানো আছে। এসব ছবি শেকড়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। আন্ডারপাসের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে স্থাপন করা হয়েছে ফ্লাওয়ার ভাসও। ফুল দিয়ে সাজানো রাস্তা তারকা হোটেলের লবির মতো মনে হয়। সব মিলিয়ে এটি আর আন্ডারপাস নয় শুধু, দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন বহু মানুষ কৌতূহল বশত দেখতে আসছেন। আর ছবি তোলার কথা তো বলাই বাহুল্য। দেয়ালচিত্রের সামনে দাঁড়িয়ে সারক্ষণই মোবাইল ফোনে ছবি তুলতে দেখা যাচ্ছে পথচারীদের। শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল এ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরাও নিয়মিত যাতায়াত করছেন। তাদের একজন শিহাব বলছিল, আন্ডারপাসটি হওয়ায় আমাদের সবচেয়ে বেশি সুবিধা হয়েছে। নিরাপদে রাস্তা পার হতে পারছি। আর এটি এত দৃষ্টিনন্দন যে, দেখার জন্যও এদিক দিয়ে অনেকে আসা যাওয়া করেন। আরেক পথচারী কবির আহমেদ বলছিলেন, আন্ডারপাসটি দিয়ে যাওয়া আসার সময় দেয়ালের দিকে আপনি চোখ চলে যায়। এত ঝকঝকে তকতকে আন্ডারপাস, এত সুন্দর করে সাজানো, খুব ভাল লাগে। এদিকে, এই সুন্দরকে সুন্দর রাখতে সবার সহযোগিতা চেয়েছেন মেয়র আতিকুল ইসলাম। এ প্রসঙ্গে মেয়র বলছিলেন, প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করেই আন্ডারপাসটি নির্মাণ করা হয়েছে। আধুনিক সব সুযোগ সুবিধা এখানে রাখা হয়েছে। দেয়াল সাজানো হয়েছে গ্যালারির মতো করে। ভবিষ্যতে এই গ্যালারি আরও সমৃদ্ধ করা হবে। তবে এই সৌন্দর্য অটুট রাখতে পথচারীদের দায়িত্বশীল হতে হবে। সবাইকে পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি খেয়াল রাখার আহ্বান জানান তিনি। বলেন, এখানে সফল হলে শহরে এমন আরও আন্ডারপাস হতে পারে।
×