ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বগুড়ার রূপা কাহিনী, টক অব দ্য টাউন

প্রকাশিত: ২৩:৩৬, ২৫ জানুয়ারি ২০২২

বগুড়ার রূপা কাহিনী, টক অব দ্য টাউন

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ আওয়ামী লীগের নেতা ও উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান হওয়ার পরও তিনি এলাকায় থাকেন না। উপজেলার বেশিরভাগ লোক তাকে চেনে না। হাতে গোনা যারা চেনেন তাদের কাছে তিনি দম্ভ অহঙ্কারের এক নারী। দলের ওপর মহলের বড় নেতাদের সঙ্গে তার সম্পর্ক থাকায় স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা তাকে সমীহ করে চলেন। এই নারী নেত্রীর নাম মাহবুবা নাসরিন রূপা। তিনি বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলা পরিষদের নারী ভাইস চেয়ারম্যান। প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগে তিনিসহ দশজনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। দুপচাঁচিয়া এলাকার যারা তাকে চিনতেন তারা বিস্মিত হন। ঘটনাটি এক কান থেকে চার কান হয়ে মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে বগুড়ায়। বিষয়টি এখন টক অব দ্য জেলা থেকে টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বন্ধুবান্ধব ফোন করে জানতে চাইছে রূপার বগুড়ার কাহিনী। তবে তারা উত্তর পাচ্ছে রূপার বাড়ি বগুড়া হলেও সে থাকে ঢাকায়। দু’তিন দিন আগেও বগুড়ার অনেক লোকই জানতেন না তিনি বগুড়ার একজন নারী ভাইস চেয়ারম্যান এবং আওয়ামী লীগের নেত্রী। টেলিভিশনে পত্র-পত্রিকায় ছবি দেখেও তাকে চিনতে কষ্ট হচ্ছিল। প্রশ্ন ফাঁস চক্রের অন্যতম সদস্য বিষয়টি জেনে অনেক প্রবীণকে বলতে শোনা যায়-বগুড়ার মানসম্মান গেল রসাতলে। কৌতূহলী লোকজন এই নারীর প্রকৃত পরিচয় ও ঠিকুজি উদ্ধারে মাঠে নামে। মাঠ পর্যায় ও ঢাকা থেকে যে কথাগুলো শোনা যায় তা মোটেও সুখকর নয়। এই নারী নিজে তো মানসম্মান খুইয়েছেন বগুড়ায় দলের অবস্থান খাটো করেছেন। এই বিষয়ে বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবর রহমান মজনু সোমবার দুপুরে এই প্রতিবেদককে বলেন, ঘটনাটি দুঃখজনক। তিনি ভাবতেই পারেননি ইডেন কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়া উচ্চশিক্ষিত নারী এমন কাজ করতে পারেন। ঘটনাটি নিন্দনীয় হওয়ায় এবং দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করায় মাহবুবা নাসরিন রূপাকে আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সদস্য পদ থেকে রবিবার রাতে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। তাকে দল থেকে বহিষ্কারের সুপারিশ করা হয়েছে। যে ঘটনায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে, অভিযোগ প্রমাণ সাপেক্ষে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তার ভাইস চেয়ারম্যান পদ রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। পত্রিকায় নাম না ছাপানোর অনুরোধ জানিয়ে স্থানীয় এক নেতা বলেন, রূপার সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের অনেকের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় সে (রূপা) নিজেকে অনেক বড় মাপের মনে করত। দাম্ভিকতা ও অহমিকা পেয়ে বসেছিল। কে এই রূপা! ॥ সুন্দর কণ্ঠের অধিকারী ও সুদর্শন রূপার বাড়ি বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার গোবিন্দপুর ইউনিয়নের ভুঁইপুর গ্রামে। তার বাবা আতাউর রহমান আজিমপুর গার্লস স্কুলের নৈশপ্রহরী ছিলেন। আতাউর রহমানের দুই মেয়ে এক ছেলের মধ্যে রূপা বড়। স্কুল জীবন শেষ করে বাবার চাকরির সুবাদে ঢাকায় যান। ইডেন কলেজে ভর্তি হন ২০০৮-০৯ সেশনে। ভর্তির পরই তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। থাকতেন রাজিয়া হলে। শুরু হয় তার উচ্ছৃঙ্খল জীবন। লেখাপড়ার চেয়ে ভর্তি বাণিজ্য ও ইডেনের হল বাণিজ্যের প্রতি নজর থাকে বেশি। একাধিক হলের নির্দিষ্ট সংখ্যার আসন (সিট) নিজের দখলে রেখে তা চড়া মূল্যে বিক্রি করতেন ইডেনে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের নিকট। ছাত্রলীগের বিভিন্ন কর্মকা-ে নিজেকে বড় করে দেখাতে পাড়ায় এক পর্যায়ে ইডেন মহিলা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের ছাত্রী বিষয়ক সম্পাদক হন। তারপর পর্যায়ক্রমে যুগ্ম আহ্বায়ক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে দ্রুত পরিচয় হয়। এবং ‘ইলমোটিভে’ কেন্দ্রীয় নেতাদের নাম ভাঙ্গিয়ে সরকারী বিভিন্ন দফতরে তদবির কাজে নেমে পড়েন। সচিবালয়ে প্রবেশ করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে গিয়ে নানাভাবে কাজ বাগিয়ে আনেন। পরিচিতি পান সফল তদবিরবাজ হিসেবে। বাজপাখির মতো ছোঁ মেরে কাজ আনতে তিনি ছিলেন মহাপরিক্রমশীল। অর্থ ও প্রাচুর্যের মোহে এক সময় জড়িয়ে পড়েন সরকারী নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস চক্রে। গত কয়েক বছর ধরে তিনি একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। এই সিন্ডিকেটের সদস্য সংখ্যা কত সেই হিসাব কষছে গোয়েন্দা পুলিশ। এর আগের ঘটনা ॥ বগুড়ায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে প্রবেশ ২০১৮ সালে। ওই বছরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বগুড়া-৩ আসনে ১৪ দলের পক্ষের প্রার্থীর প্রচার কাজে ঢাকা থেকে ৬/৭ জন তরুণীকে নিয়ে মাঠে নামেন। এভাবেই যাত্রা শুরু। এরপর কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ের কয়েকজনের আশীর্বাদ নিয়ে ২০১৯ সালের মার্চে দুপচাঁচিয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নারী ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী হন। নির্বাচনের দিন কয়েক আগেও স্থানীয় লোকজন তাকে চিনত না। প্রভাব খাটিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের তার পক্ষে নির্বাচনী কাজে লাগান। ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর আরও ওপরে উঠতে চান। প্রভাব খাটিয়ে উপজেলা পরিষদে প্যানেল চেয়ারম্যান পদটিও হাতে পান। এলাকায় তাকে খুব দেখা যায় না। মাঝেমধ্যে এসে ছোট ভাই রকিকে নিয়ে পালিমহেশপুর গ্রামে চাচা দেলোয়ার হোসেনের বাড়িতে থাকতেন। রূপার ঘটনা শোনার পর দেলোয়ার হোসেন এখন লজ্জা পাচ্ছেন। দুপচাঁচিয়ার ভুঁইপুর গ্রামের লোকজন বলেন রূপাকে চিনতেন না। নির্বাচনের সময় তারা জানতে পারেন রূপা ওই গ্রামের মেয়ে। গোবিন্দপুর ইউনিয়ন পরিষদের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান সাখাওয়াত হোসেন মল্লিক বলেন নির্বাচনের আগে রূপা ফোন করেছিলেন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দরকার কিনা। তিনি বলেছিলেন স্বতন্ত্র প্রাথী হয়েই নির্বাচন করতে চান। নির্বাচনে তিনি জিতেছেন। গোবিন্দপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বলেন, দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে রূপার যে যোগাযোগ ছিল তা তিনি (রূপা) অহঙ্কার করে বলতেন। নির্বাচনের পরপরই তিনি বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও পদাধিকার বলে দুপচাঁচিয়া আওয়ামী লীগের সদস্য হন। দলীয় কর্মকা-ে নিয়মিত অংশ নিতেন না। বগুড়ায় না থাকার পরও রূপা কি ভাবে জেলা আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সদস্যপদ পেলেন এমন প্রশ্নে একজন নেতা বলেন ‘এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব নয়।’ সরকার দলীয় প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে ছবি তুলে তা প্রদর্শন করে দেনদরবারে রূপা ছিলেন পারদর্শী। রাজনৈতিক পরিচয় প্রভাব এবং অপরাধচক্রে জড়িয়ে দ্রুত মাল্টিমিলিয়নিয়ার হতে চেয়েছেন রূপা। দুপচাঁচিয়ায় গ্রামের বাড়িতে রূপার কোন জমিজমা নেই। মা ও বাবা দু’জনই গত হয়েছেন। উপজেলা পরিষদের ক্যাম্পাসে নারী ভাইস চেয়ারম্যানের এয়ার মার্ক বাড়িতে রূপা থাকেন না। বগুড়ায় এবং নিজ এলাকার সঙ্গে রূপার সম্পৃক্ততা নেই।
×