ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মধ্য ফেব্রুয়ারির আগে করোনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে পারে

প্রকাশিত: ২৩:১৯, ২৫ জানুয়ারি ২০২২

মধ্য ফেব্রুয়ারির আগে করোনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে পারে

অপূর্ব কুমার ॥ দেশে এখন চলছে ওমিক্রন ঝড়। শুরুতেই এই নতুন ঝড় প্রতিহত করতে না পারলে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ল-ভ- হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। মাত্র সাত দিনের ব্যবধানে করোনা শনাক্তের হার বেড়েছে ১১ শতাংশ। রোগী শনাক্ত ও সংক্রমণের হারের দিক থেকে ডেল্টাকে স্পর্শ করছে ওমিক্রন। গত বছর শাটডাউনের সময়ে করোনা সংক্রমণের হার যা ছিল সোমবার সেই হারকেও ছাড়িয়েছে। তাই লকডাউন বা শাটডাউনের ঘোষণা করা এখন সময়ের দাবি। সরকারের জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন জানিয়েছেন, আগামী এক সপ্তাহ পর করোনার (কোভিড ১৯) সংক্রমণ পরিস্থিতি দেখে চলমান বিধিনিষেধের বিষয়ে পরবর্তী নির্দেশনা দেয়া হবে। মন্ত্রী বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য সবাই মাস্ক পরুক। এই সময়টা আমরা অতিক্রম করতে চাই। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, আগামী ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সংক্রমণের হার বাড়তেই থাকবে। তবে নতুন ধরনের সংক্রমণ ক্ষমতা এতটাই যে, মধ্য ফেব্রুয়ারির আগেই দেশে করোনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। জনগণকে সচেতন হতে হবে। আমরা চাই, এই তৃতীয় ঢেউ থেকে যত তাড়াতাড়ি উত্তরণ করতে পারি। সেজন্য সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে তৃতীয় ঢেউ মোকাবেলা করতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরে প্রথম দিনে দেশে ৩৭০ নতুন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছিল। সেদিন নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ছিল দুই দশমিক ৪৩ শতাংশ। একই সময়ে চার জনের মৃত্যুর কথাও জানানো হয়। আর তিন সপ্তাহ শেষে রবিবার অধিদফতর জানিয়েছে, আগের ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে করোনা শনাক্ত হয়েছেন ১০ হাজার ৯০৬ জনের। এ সময়ে শনাক্তের হার ৩১ দশমিক ২৯ শতাংশ। আর এ সময়ে ভাইরাসটিতে সংক্রমিত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ১৪ জনের। গত সাতদিনে করোনা শনাক্তের সংখ্যা যথাক্রমে ১০৯০৬ ৯৬১৪, ১১৪৩৪, ১০৮৮৮, ৯৫০০, ৮৪০৭ ও ৬৬৭৬ রোগী শনাক্ত হয়েছে। একইভাবে নমুনা সংগ্রহের বিপরীতে করোনা শনাক্তের হার ৩১ দশমিক ২৯ শতাংশ, ২৮ দশমিক ০২, ২৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ, ২৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ, ২৫ দশমিক ১১ শতাংশ, ২৩ দশমিক ৯৮ ও ২০ দশমিক ৮৮ শতাংশ। অর্থাৎ মাত্র সাতদিনের ব্যবধানে দেশে করোনা শনাক্তের হার বেড়েছে ১১ শতাংশ। যা আশঙ্কাজনক ও ভীতিকর। চলতি বছরের জানুয়ারির প্রথম দিনে ৪৪ জেলায় নতুন রোগী শনাক্ত ছিল না। বাকি জেলাগুলোর মধ্যে কেবলমাত্র ঢাকা জেলা ছাড়া বাকিগুলোতে রোগী ছিল এক অঙ্কের সংখ্যায়। আর গত রবিবারে ৬৪ জেলার মধ্যে মাত্র পাঁচ জেলায় এক অঙ্কের ঘরে রোগী শনাক্ত হয়েছে। বাকি জেলাগুলোর মধ্যে চার অঙ্কের সংখ্যক রোগী শনাক্ত হয়েছে দুই জেলায় আর তিন অঙ্কের সংখ্যক রোগী শনাক্ত হয়েছে আট জেলায়। বাকি জেলাগুলোতে রোগী সংখ্যা দুই অঙ্কের ঘরে। ২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে করোনা শনাক্ত হয়। আর ১৮ মার্চ প্রথম করোনাতে মৃত্যু ঘটে। প্রথম ঢেউ সফলভাবে মোকাবেলার পর গত বছর ডেল্টার কারণে জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। তবে সরকার ডেল্টা মোকাবেলায় টিকাকরণের ওপর জোর দেয়। টিকাকরণের পরিধি বাড়ানোয় ডেল্টাও সামলেছে সরকার ভালভাবে। ডেল্টার কারণে একদিনে সর্বোচ্চ রোগী আর সর্বোচ্চ মৃত্যু দেখেছে। একদিনে সর্বোচ্চ ২৬৪ জনের মৃত্যু ঘটে। তবে আগস্টের শেষদিকে এসে সংক্রমণ কমতে শুরু করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। শনাক্তের হার কমে আসে ১ শতাংশের কাছাকাছি। কিন্ত করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের কারণে জনগণের স্বস্তি খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তীব্র গতিতে নতুন ধরনটি ছড়াতে থাকে। এখন বাংলাদেশে ওমিক্রন ডেল্টার জায়গা দখল করেছে। বর্তমানে জানুয়ারি ১০ তারিখের পর থেকেই সংক্রমণ ফের উর্ধমুখী। গত কয়েকদিন ধরেই পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। দেশে একদিনে সর্বোচ্চ রোগী শনাক্ত হয় গত বছরের ভয়ঙ্কর ডেল্টা ধরনের সংক্রমণকালীন। গত ২৪ জুলাই করোনাতে রোগী শনাক্তের হার ৩২ দশমিক ৫৫ শতাংশ। যা কিনা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। আর রবিবার গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার ৩১ দশমিক ২৯ শতাংশ। এখন পর্যন্ত এটিই দ্বিতীয় সর্র্বোচ্চ। সেই হিসেবে ওমিক্রন বর্তমানে ডেল্টার চূড়াকে স্পর্শ করেছে। ঢাকায় ওমিক্রনের তিনটি উপধরন ॥ এদিকে রাজধানী ঢাকাতে করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের অন্তত তিনটি উপধরন (সাবটাইপ) পাওয়া গেছে বলে সম্পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্স গবেষণায় জানা গেছে। সোমবার আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা যায়। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা শহরে যে তিনটি উপধরন আছে সেগুলো আফ্রিকান, ইউরো-আমেরিকান এবং এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ওমিক্রন ধরনের সঙ্গে মিলে যায়। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দেশে ডেল্টা ধরনের জায়গা নিচ্ছে ওমিক্রন। অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম বলেন, দেশে এখনও করোনার ডেল্টা ধরনের প্রাধান্য বেশি, তবে আস্তে আস্তে সে জায়গাটা ওমিক্রন দখল করে নিচ্ছে। দেশে ওমিক্রনের সামাজিক সংক্রমণ বা কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়েছে জানিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওমিক্রন আগের সব রেকর্ড ভাঙ্গবে। আর গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার এখনই চলে এসেছে ডেল্টার চূড়ার কাছাকাছি। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডাঃ মুশতাক হোসেন বলেন, বর্তমানে করোনায় মৃত্যু হচ্ছে আগের করোনার প্রভাবে, কমপক্ষে তিন সপ্তাহ আগে যারা আক্রান্ত হয়ে জটিল অবস্থায় গিয়েছে, সেসব রোগীর মৃত্যু হচ্ছে। আর বর্তমান সময়ে যেসব রোগীর অবস্থা জটিল অবস্থায় গিয়েছে তাদের মৃত্যুর অবস্থা দেখা যাবে আগামী তিন সপ্তাহ পর। আগামীতে মৃত্যু হলে ওমিক্রনে সংক্রমিত হয়েই হয়েছে বলে ধরে নিতে হবে জানিয়ে মহামারী বিশেষজ্ঞ ডাঃ মুশতাক হোসেন বলেন, যদি দেখা যায় শনাক্তের হারের তুলনায় মৃত্যু কম হচ্ছে তাহলেই কেবল বলা যাবে ওমিক্রনে মৃত্যু। তিনি বলেন, করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকারী ১১ দফা নির্দেশনা ঠিক আছে। কারণ সবকিছু বন্ধ করে দেয়া সমাধান নয়, সবকিছু বন্ধ করে দেয়া একদম শেষ ব্যবস্থা। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পাবলিক হেলথ এ্যাডভাইজরি কমিটির সদস্য ও জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল বলেন, করোনা সংক্রমণ আশঙ্কাজনক হারে বাড়লেও বর্তমানে হাসপাতালে শয্যা ফাঁকা আছে। এই হারে সংক্রমণ বাড়লে আগামী এক মাসে হাসপাতালগুলোতে শয্যা কতটা ফাঁকা থাকবে, সেটা অত্যন্ত চিন্তার বিষয়। সংক্রমণের এই পরিস্থিতিতে বাণিজ্যমেলা, শপিংমল খোলা রাখাকে কিছুটা শৃঙ্খলার বাইরে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এখানে সমন্বিত এবং চিন্তা করে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে আমার মনে হয় না।
×