ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঋণ শ্রেণীকরণ সুবিধার মেয়াদ না বাড়ালে ৫০ শতাংশ ব্যবসায়ী খেলাপি---এফবিসিসিআই সভাপতি জেলা পর্যায়েও ওয়ানস্টপ সার্ভিস চালু করতে হবে এফবিসিসিআইয়ের উদ্যোগে কাউন্সিল অব চেম্বার প্রেসিডেন্টসের-এর মতবিনিময় সভা

ভ্যাট ও টাক্স আদায়ে হয়রানি বন্ধের দাবি তৃণমূল ব্যবসায়ীদের

প্রকাশিত: ২০:৩৬, ২২ জানুয়ারি ২০২২

ভ্যাট ও টাক্স আদায়ে হয়রানি বন্ধের দাবি তৃণমূল ব্যবসায়ীদের

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ভ্যাট ও টাক্স আদায়ের ক্ষেত্রে রাজস্ব কর্মকর্তাদের হয়রানি বন্ধ করার জন্য সরকারের প্রতি জোরালো দাবি জানিয়েছেন ঢাকা ও জেলা পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা। তাঁরা অভিযোগ করে বলেছেন, ভ্যাট ও আয়কর কর্মকর্তারা কোভিড-১৯ এর মধ্যেই কর আদায়ের জন্য চাপ দিচ্ছেন। হয়রানি বন্ধে দ্রুত এফবিসিসিআইকেও করণীয় নির্ধারণে তাগিদ দিয়েছেন তৃণমূল পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত এসএমই খাতের জন্য প্রণোদনার অর্থ দ্রুত ছাড়করণ, ব্যাংক খাতে ঋণ পরিশোধের মেয়াদ আরও ৬ মাস বাড়ানো, সরকারী পর্যায়ে নীতিনির্ধারণী বৈঠকে বেসরকারী খাতের প্রতিনিধি রাখা এবং এফবিসিসিআইয়ের সভাপতিকে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা প্রদানসহ বিনিয়োগ-বান্ধব পরিবেশ তৈরির উপর উদ্যোক্তারা জোর দিয়েছেন। শনিবার কাউন্সিল অব চেম্বার প্রেসিডেন্টস-২০২২-এর মতবিনিময় সভায় ঢাকা ও জেলা পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা এসব কথা বলেন। কাউন্সিল অব চেম্বার প্রেসিডেন্টসের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবুর সভাপতিত্বে ওই মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন। ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) এই কাউন্সিল সভার আয়োজন করে। সভায় তৃণমূল পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা বিশেষ করে জেলা পর্যায়ের ব্যবসায়ী, চেম্বার সভাপতি, বিভিন্ন নারী উদ্যোক্তাগণ অংশগ্রহণ করেন। মোঃ জসিম উদ্দিন বলেন, সচেতনতা বাড়াতে এবং ব্যবসায়ীদের হয়রানি বন্ধে এফবিসিসিআই শীঘ্রই আট বিভাগীয় শহরে ব্যবসায়ী ও এনবিআর কর্মকর্তাদের নিয়ে আটটি সেমিনার করবে। তিনি বলেন, দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে ৮২ শতাংশ অবদান রাখছেন বেসরকারীখাতের ব্যবসায়ীরা। অথচ ট্যাক্স ও ভ্যাট আদায়ের ক্ষেত্রে এনবিআর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে হয়রানির অভিযোগ রয়েছে। এসব বিষয়ের দ্রুত সমাধান হওয়া উচিত। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ঋণ শ্রেণীকরণ সুবিধার মেয়াদ না বাড়ালে ৫০ শতাংশ ব্যবসায়ী খেলাপি হয়ে যাবেন। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে আগে ব্যবসায়ীদের বাঁচাতে হবে। তাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য করার পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। অন্যথায় দেশের অর্থনীতিতে গতি আসবে না। পুরোদমে অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ চালু করতে হলে বেসরকারীখাতের দিকে সরকারের সবচেয়ে বেশি নজর দেয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, এফবিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে জেলা পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের সমস্যা, দাবি ও অভিযোগগুলো সরকারের কাছে তুলে ধরা হবে। এফবিসিসিআই সব সময় তৃণমূল পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ছিল এবং থাকবে। ঋণ শ্রেণীকরণ সুবিধার মেয়াদ জুন পর্যন্ত বৃদ্ধির দাবি সারাদেশের ব্যবসায়ীদের। তিনি বলেন, সময় না বাড়ালে ৫০ শতাংশ ব্যবসায়ী খেলাপি হবেন। করোনা মহামারির মধ্যে এখনো দেশের ব্যবসা বাণিজ্য ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এমন অবস্থায় ঋণের কিস্তি পরিশোধে অন্তত জুন পর্যন্ত সময় চেয়েছেন সারাদেশের ব্যবসায়ী নেতারা। এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণে সরকারের নির্দেশে যেসব খাতের ব্যবসায়ীক কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছিলো সেখাতগুলোই এখনো প্রণোদনার ঋণ পায়নি। মহামারিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা। কিন্তু অন্যান্য প্রণোদনা তহবিলের অর্থ প্রায় শতভাগ ছাড় হলেও, এসএমই প্রণোদনার বড় অংশ বিতরণ হয়নি। ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতে ছোট আকারের ঋণ দিতে ব্যাংকগুলোর অনীহা আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ব্যাংকগুলো মনে করে ছোট আকারের ঋণ দেয়া লাভজনক নয়। বড় ব্যবসা খাতে ঋণ দিলে ব্যাংকের জনবল ও খরচ কম হয়। কিন্তু এ ধারণা ভুল, বরং এতে মন্দ ঋণের ঝুঁকি বাড়ে। এসএমই খাতে খেলাপি ঋণ নেই বললেই চলে। ওয়ানস্টপ সার্ভিস চান চেম্বার নেতারা ॥ আলোচনায় ৬৪ জেলা চেস্বার সভাপতিসহ বিভিন্ন জয়েন্ট চেম্বারের প্রতিনিধিরা বক্তব্য রাখেন। তারা বলেন, জেলা পর্যায়েও কারখানা স্থাপনে ৩৩টি লাইসেন্সের দরকার হয়। এসব সনদ নিতে বিপুল পরিমাণ ভোগান্তির শিকার হতে হয় উদ্যোক্তাদের। এই সমস্যা সমাধানে ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালুর দাবি জানান ব্যবসায়ীরা। একই সঙ্গে লাভ ক্ষতি নির্বিশেষে টার্নওভার ট্যাক্সের বিধান বাতিল করে শুধু আয়ের ওপর কর আরোপের দাবি জানান তারা। চেম্বার নেতারা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, মহামারী করোনার এই সময় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কুটির, ক্ষুদ্র এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি মানের উদ্যোক্তারা। অথচ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত প্রণোদনা থেকে ২০ ভাগ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীও কোন ঋণ সহায়তা পায়নি। এ কারণে দ্রুত ঋণ ছাড়করণের তাগিদ দেয়া হয়েছে। তারা বলছেন, নতুন করে করোনা আবার ছড়িয়ে পড়ছে। ইতোমধ্যে সরকার চলাফেরার উপর বিধিনিষেধ দিয়েছে। এ অবস্থায় ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বাভাবিক গতি বজায় থাকবে কি না সেটা নিয়ে নতুন শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ব্যবসায়ীদের এই সঙ্কট থেকে টিকিয়ে রাখতে হলে দ্রুত প্রণোদনার অর্থ বিতরণ করতে হবে। করোনার ২য় ধাক্কার পর এখন অমিক্রণ ধরনের সংক্রমণে আবারো ব্যবসা বাণিজ্যে নাজুক পরিস্থিত তৈরি হয়েছে। এমন অবস্থায় অনেক ব্যবসায়ীর ঋনের কিস্তি দেয়ার সক্ষমতা নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক সময় না বাড়ালে ঋণগ্রহীতাদের অনেকেই খেলাপি হবেন, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর হবে। সভায় মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন দেশে এখনো শুল্ক-কর ও ভ্যাট আদায়ে হয়রানির শিকার হচ্ছে ব্যবসায়ীরা। কোম্পানি আইন, আমদানি ও রপ্তানি আইন নতুন করে হচ্ছে। এসব আইন যেন ব্যবসা বান্ধব হয় সেজন্য এফবিসিসিআই কাজ করে যাচ্ছে। এফবিসিসিআই সভাপতিকে প্রতিমন্ত্রীর সমমর্যাদা দেয়ার দাবি জানান সারা দেশ থেকে আসা বিভিন্ন চেম্বারের সভাপতি ও সহ-সভাপতিবৃন্দ। তারা বলেন, সরকারি কর্মকর্তারা বাস্তবতা না বুঝে নিজেদের মতো করে নীতি প্রণয়ন করে। ফলে অনেক সময় এসব নীতি বাস্তবায়নযোগ্য হয়না। ব্যবসা বান্ধব পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে নীতি নির্ধারণী সভায় এফবিসিসিআই’র মতামত দেয়ার সুযোগ থাকতে হবে। এসময় ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, করোনা মহমারিতে বিপর্যস্ত ব্যবসা বাণিজ্যের মধ্যেও রাজস্ব আদায় করতে নানাভাবে তাদেরকে নানাভাবে হয়রানি ও ভীতির পরিবেশ তৈরি করছেন রাজস্ব কর্মকর্তারা। স্থানীয় পর্যায়ে চাঁদাবাজিরও শিকার হচ্ছেন। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরেও জেলা পর্যায়ের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা সরকার ঘোষিত প্রণোদনা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেন। এ কারণে প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের পক্ষের মহামারি পরবর্তী উত্তরণ কঠিন হয়ে পড়ছে। এ ছাড়াও অডিটে সিঙ্গেল অ্যাকাউন্ট বাস্তবায়ন হলে তা পুরো অর্থনীতিতে বিপর্যয় আনবে বলে মত দেন ব্যবসায়ীরা। মতবিনিময় সভায় বক্তব্য রাখেন কিশোরগঞ্জ চেম্বারের সভাপতি মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান বেলাল, রাজশাহী ওমেন চেম্বারের সহ-সভাপতি তাহেরা হাসেন, সাতক্ষীরা চেম্বারের সভাপতি নাসিম ফারুক খান মিঠু, রংপুর মেট্রোপলিটন চেম্বারের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ড মোহাম্মদ গোলার জাকারিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া চেম্বারের সভাপতি আলহ্বাজ আজিজুল হক, চাঁপাইনবাবগঞ্জ চেম্বারের সভাপতি মো. এরফান আলী, পটুয়াখালী ওমেন চেম্বারের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ইসমত জেরিন খান, বাগেরহাট চেম্বারের সভাপতি এস.কে লিয়াকত হোসেইন, ফিকির সভাপতি নাসের এজাজ বিজয়, নীলফামারি চেম্বারের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. ফারহানুল হক, লালমনিরহাট চেম্বারের সিনিয়র সহ-সভাপতি মোড়ল হুমায়ুন কবির, খুলনা চেম্বারের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট শরীফ আতিয়ার রহমান, নরসিংদী চেম্বারের সভাপতি ও এফবিসিসিআই পরিচালক আলী হোসেইন শিশির, গোপালগঞ্জ চেম্বারের সিনিয়র সহ-সভাপতি মো. মোশাররফ হোসেন, দিনাজপুর চেম্বারের সভাপতি রেজা হুমায়ুন ফারুক শামীম, বান্দরবান চেম্বারের সহ-সভাপতি লক্ষীপদ রায়, ঝিনাইদহ চেম্বারের সহ-সভাপতি মো. নাসিম উদ্দিন, দিনাজপুর উইমেন চেম্বারের সভাপতি জান্নাতুস সাফা শাহীনুর, লক্ষীপুর চেম্বারের এম. আর. মাছুদ, সিরাজগঞ্জ চেম্বারের সিনিয়র সহ-সভাপতি মোঃ ইসহাক। এছাড়া এফবিসিসিআই’র পরিচালকদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন মোঃ রেজউল করিম রেজনু, তাহমিন আহমেদ, প্রীতি চক্রবর্তী, মো. নিজাম উদ্দিন, আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ। মতবিনিময় সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন এফবিসিসিআই’র সহ-সভাপতি মো. আমিনুল হক শামীম, মো. আমিন হেলালী, সালাহউদ্দীন আলমগীর, হাবীব উল্লাহ ডন,ও এম.এ. রাজ্জাক খান রাজ প্রমুখ।
×