ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

দুই বন্ধু মিলেই শ্বাসরোধে হত্যা করে শিমুকে

প্রকাশিত: ২১:৪৯, ২২ জানুয়ারি ২০২২

দুই বন্ধু মিলেই শ্বাসরোধে হত্যা করে শিমুকে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ অভিনেত্রী রাইমা ইসলাম শিমুকে শুধুমাত্র তার স্বামী শাখাওয়াত আলীম নোবেল একা শ্বাসরোধ করেননি। এ সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন নোবেলের বন্ধু এস এম ওয়াই আব্দুল্লাহ ফরহাদও। হত্যাকান্ডের সময় তিনি নোবেলকে সাহায্য করেছেন। বৃহস্পতিবার ঢাকার দুই বিচারিক হাকিমের আলাদা খাস কামরায় এ তথ্য জানিয়ে নোবেল ও ফরহাদ ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন। নোবেলের স্বীকারোক্তি নেন বিচারিক মোঃ সাইফুল ইসলাম ও ফরহাদের জবানবন্দী নেন জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম মিশকাত সুকরানা। দাম্পত্য কলহের সূত্র ধরেই এ খুন, এমনটাই তাদের স্বীকারোক্তিতে উঠে এসেছে। মামলাটির তদন্তের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ফোনে কথা বলা নিয়ে নোবেল ও তার স্ত্রী অভিনেত্রী শিমুর মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হতো। শিমু কার সঙ্গে কথা বলতেন তা নিয়ে প্রতিনিয়ত সন্দেহ করতেন নোবেল। ঘটনার দিন সকালে অভিনেত্রী শিমু ফোনে কারও সঙ্গে কথা বলেছিলেন। কথা বলা শেষ করলে হঠাৎ স্ত্রীর ফোন দেখতে চান নোবেল। এ নিয়েই ঝগড়া-শুরু হয় তাদের মধ্যে। তখন বাসায় নোবেলের বন্ধু ফরহাদও উপস্থিত ছিলেন। যদিও গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নোবেল পুলিশকে জানিয়েছিলেন, তিনি একা হত্যাকান্ড ঘটিয়েছেন। আর মরদেহ গুম করতে বন্ধু ফরহাদকে ডেকে আনেন। কিন্তু জবানবন্দীতে উঠে এসেছে, নোবেল একা নয়, হত্যাকান্ডের সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন ফরহাদ। দুই বন্ধু মিলেই অভিনেত্রী শিমুকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। তদন্ত সূত্র জানায়, ঘটনার দিন সকালে নোবেলের ডাকে বাসায় আসেন ফরহাদ। ফরহাদ বাসায় ঢুকার সময় দরজা খুলে দেন শিমু নিজেই। ফরহাদ আসার পর তারা সবাই ডাইনিং টেবিলে বসে চা খান। এর ঠিক ৩০ মিনিট পর ফোনে কথা বলা নিয়ে শিমু ও নোবেলের ঝগড়া শুরু হয়ে যায়। প্রথমে ফরহাদ ঝগড়া থামানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু পরে নোবেলের ডাকে শিমুকে শ্বাসরোধ করে হত্যাকান্ডে জড়িত হোন। হত্যাকান্ডের পর দুই বন্ধু মিলে দুইটি বস্তায় অভিনেত্রীর মরদেহ ঢুকান। পরে বাসার দারোয়ানকে কাজে পাঠিয়ে দুই বন্ধু মিলে মরদেহ গাড়ির পেছনে নিয়ে বেরিয়ে যান। আরও জানা যায়, মরদেহ গুমের জন্য প্রথমে নোবেল ও ফরহাদ মিরপুরের দিকে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে উপযুক্ত জায়গা না পেয়ে তারা আবার বাসায় ফেরেন। সন্ধ্যায় আবার তারা লাশ গুম করতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর, বছিলা ব্রিজ হয়ে কেরানীগঞ্জের দিকে যান। আনুমানিক রাত সাড়ে ৯টায় কেরানীগঞ্জ মডেল থানার হযরতপুর ইউনিয়নের কদমতলী এলাকার আলীপুর ব্রিজ থেকে ৩০০ গজ দূরে সড়কের পাশে ঝোপের ভেতর মরদেহ ফেলে চলে যান তারা। পরে ১৭ জানুয়ারি সকাল ১০টার দিকে কেরানীগঞ্জ থেকে শিমুর বস্তাবন্দী মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। মরদেহ উদ্ধারের পর ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ে গ্রেফতার করা হয় শিমুর স্বামী শাখাওয়াত আলীম নোবেল (৪৮) ও তার বাল্যবন্ধু এস এম ওয়াই আব্দুল্লাহ ফরহাদকে (৪৭)। মামলার তদন্তের বিষয়ে কেরানীগঞ্জ মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আব্দুস ছালাম বলেন, এ মামলার প্রতিটি বিষয়ে আমরা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখছি। জিজ্ঞাসাবাদে আমরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছি। নোবেল ও ফরহাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে মামলার পরবর্তী তদন্ত চলছে। এজাহারে অজ্ঞাত ব্যক্তি থাকায় বিস্ময় বাদীর ॥ চিত্রনায়িকা রাইমা ইসলাম শিমু হত্যাকান্ডে তার ভাইয়ের দায়ের করা মামলার অভিযোগে দুজনের নাম উল্লেখ থাকলেও এজাহারে তা নেই। সেখানে আসামি হিসেবে কেবল ‘অজ্ঞাত’ ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বাদী হারুন অর রশীদ। তিনি বলেছেন, আমি মামলায় দুজনের নাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ করি, কিন্তু এফআইআর বা এজাহারে তাদের নাম না থাকায় বিস্মিত হয়েছি। যদিও এক্ষেত্রে পুলিশের ভাষ্য, অভিযোগে নাম থাকলেও সুনির্দিষ্টভাবে আসামিদের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ না থাকলে এফআইআরে নাম আসবে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হত্যা মামলা দায়েরের আগেই শিমুর স্বামী সাখাওয়াত আলী নোবেল ও তার বাল্যবন্ধু গাড়িচালক এস এম ওয়াই আব্দুল্লাহ ফরহাদকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের পুলিশি তদন্তে প্রাপ্ত আসামি বলা হয়েছে। এজাহারে তাদের সরাসরি আসামি করা হয়নি। আদালতে পুলিশের করা রিমান্ড আবেদনেও দুজনকে তদন্তে প্রাপ্ত আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পরে আদালত তাদের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। গত ১৮ জানুয়ারি বিকেল ৩টায় কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন শিমুর ভাই হারুন অর রশীদ। মামলায় তিনি অভিযোগ করেন, ‘আমার ছোটবোন রাহিমা আক্তার শিমু ওরফে রাইমা ইসলাম শিমু একজন চিত্রনায়িকা। খন্দকার সাখাওয়াত আলীম নোবেল তার স্বামী। তারা একসঙ্গে কলাবাগানের গ্রিন রোডের বাসায় পরিবার নিয়ে থাকতেন। গত ১৬ জানুয়ারি রাত সাড়ে ৭টার দিকে অভিনেতা জহিরুল ইসলাম ওরফে আদর ফোন করে আমার ছোটবোন ফাতিমাকে জানান, শিমুকে সকাল থেকে মোবাইল ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। তখন আমার ছোটবোন শিমুর বড় মেয়ে অজিহা আলীম রিদকে (১৭) ফোন দেয়। তার মায়ের খবর জানতে চায়। রিদ মোবাইল ফোনে ফাতিমাকে জানায়, সকাল সাড়ে ৭টা থেকে তার মা বাসায় নেই। কোথায় আছে সেও জানে না। এরপর ফাতিমা তার মোবাইল ফোন থেকে শিমুর স্বামী নোবেলকে ফোন দেয়। তখন নোবেল তাকে জানান, শিমু কোথায় আছে তা তিনি জানেন না। আমার বোনকে রাতে খোঁজাখুঁজি অব্যাহতি রাখি।’ তিনি মামলায় অভিযোগ করেন, ‘১৭ জানুয়ারি রাত আনুমানিক ৯টার দিকে পুলিশের মাধ্যমে সংবাদ পাই, কেরানীগঞ্জে এক নারীর মরদেহ পাওয়া গেছে। মরদেহটি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রয়েছে। পরিবারসহ মর্গে গিয়ে আমরা আমার বোন শিমুর মরদেহটি শনাক্ত করি। আমার বোন মিডিয়ায় কাজ করে বলে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তার স্বামীর সঙ্গে দাম্পত্য কলহ ছিল।’ নায়িকা শিমুর ভাই আরও অভিযোগ করেন, ‘বোন নিখোঁজ হওয়ার পর তার বাসায় গিয়ে নোবেলের সঙ্গে তার বাল্যবন্ধু ফরহাদকে দেখতে পাই। তারা তখন শিমুর নিখোঁজের বিষয়টি নিয়ে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলেছে। মোবাইলেও তারা এলোমেলো কথা বলেছে। তাই আমাদের ধারণা আমার বোনের স্বামী নোবেল ও তার বন্ধু এস এম ওয়াই আব্দুল্লাহ ফরহাদসহ অজ্ঞাত আরও ব্যক্তিরা শিমুকে ১৬ জানুয়ারি সকাল ৭টা থেকে ১৭ জানুয়ারি সকাল ১০টার মধ্যে খুন করে মরদেহ গুম করতে কেরানীগঞ্জে নিয়ে যায়।’ পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে নোবেল দাবি করেন, শিমুকে হত্যা করা তার পরিকল্পনা ছিল না। দুইজনের ঝগড়ার এক পর্যায়ে তিনি তাকে চড় দেন। এতে শিমুও তার ওপর চড়াও হন। ক্ষিপ্ত হয়ে গলা টিপে ধরলে স্ত্রী নিস্তেজ হয়ে পড়েন। এরপর বন্ধু ফরহাদের পরিকল্পনায় মরদেহ গুমের সিদ্ধান্ত নেন তারা। কী নিয়ে ঝগড়া হয়েছে- সেই প্রশ্নে নোবেল ফের বলেছেন, তাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি চলছিল। এ নিয়ে দাম্পত্য ও পারিবারিক কলহ চলছিল। কেরানীগঞ্জ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু সালাম মিয়া বলেন, নোবেল অকপটেই স্ত্রীকে হত্যার কথা স্বীকার করেছেন। নোবেল দাবি করেছেন, কিছু বিষয় নিয়ে তিনি স্ত্রীকে সন্দেহ করতেন। স্ত্রীও তাকে সন্দেহ করতেন। গাড়ির যন্ত্রাংশের পুরোনো ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কিছু একটা করার চাপ ছিল তার ওপর। এসব নিয়েই মূলত কলহ চলছিল। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নোবেল আর ফরহাদ মিলে শিমুর মরদেহ বাসা থেকে বের করার আগে নিরাপত্তা কর্মীকে নাস্তা আনতে পাঠিয়েছিলেন। এর আগে তারা বাড়ির সিসি ক্যামেরা অকেজো করতে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। এক পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল সুইচও বন্ধ করে দেন তারা। পরে বস্তায় ভরে শিমুর মরদেহ গাড়িতে তোলা হয়। কিন্তু এজাহার থেকে জানা যায়, পেনাল কোডের ৩০২/২০১/৩৪ ধারায় পরিকল্পিত হত্যাকা-ের অভিযোগ তোলা হলেও সব আসামি ‘অজ্ঞাত’ বলা হয়েছে। মামলা নম্বর-৩৭। এজাহারে আসামি অজ্ঞাত বলে উল্লেখের বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কেরানীগঞ্জ মডেল থানার উপ-পরিদর্শক চুন্নু মিয় বলে, অভিযোগকারীর অভিযোগে নামের পরে যদি অজ্ঞাতনামা লেখা থাকে তাহলে এফআইআরেও অজ্ঞাত কথাটি আসবে। অভিযোগে এক বা একাধিক নামের পরেও যদি অজ্ঞাত লেখা থাকে তাহলে এফআইআরেও অজ্ঞাত থাকবে। এ প্রসঙ্গে মামলার বাদী শিমুর ভাই হারুন অর রশীদ বলেন, মামলার অভিযোগে আমি আমার বোনের স্বামী নোবেল ও তার বন্ধু এস এম ওয়াই আব্দুল্লাহ ফরহাদের নাম আসামি হিসেবে উল্লেখ করি। এছাড়া আরও অজ্ঞাত আসামি বলা হয়। কিন্তু মামলার এফআইআরে আসামির নাম না থাকায় আমি বিস্মিত হয়েছি। এফআইআরটি হাতে পেয়েছি। এ বিষয়ে কেরানীগঞ্জ থানার সঙ্গে কথা বলব। জানতে চাইলে ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন সরদার বলেন, অভিযোগে নাম থাকলেও সুনির্দিষ্টভাবে আসামিদের তথ্য-প্রমাণ না থাকলে এফআইআরে নাম আসবে না। যদি সুনির্দিষ্টভাবে হত্যার তথ্যাদি নামসহ থাকত তাহলে অবশ্যই সুনির্দিষ্টভাবে আসামিদের নাম আসত।
×