ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আবু সাইদ কামাল

গল্প ॥ ওড়নায় বাঁধা দুটি হাত

প্রকাশিত: ২২:১৭, ২১ জানুয়ারি ২০২২

গল্প ॥ ওড়নায় বাঁধা দুটি হাত

নিবারণ চৌধুরী বাসা থেকে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অনুমান সকাল সাড়ে আটটা বাজে। শহরের রাস্তায় লোক চলাচল আশঙ্কাজনকভাবে কম। চুপিচুপি পলায়নপর মানুষ বাসা ছেড়ে পালাচ্ছে। গুছিয়ে নেয়া টাকাগুলো প্রথমে ব্যাংকে জমা দিয়ে পরে অফিসে যাবে নিবারণ। তখনি কারা যেন গেটে কড়া নাড়ে। নিবারণভাবে, এমন সময়ে তো কারও আসার কথা নয়। তা হলে কি কোন লুটেরা এসেছে? তার কাছে যে নগদ তিন লাখ টাকা, সেই টাকাটা লুট করে নেয়ার জন্যই কি কেউ আসল...! দুর্ভাবনায় আঁতকে উঠে নিবারণ চৌধুরী। ফের যখন কড়া নাড়ে সাড়া দিয়ে বলেন, কে? আমরা। অপরিচিত কণ্ঠ। ভাবে, তাহলে কি তাঁর অনুমানই ঠিক! তড়িঘড়ি টাকাগুলো লুকিয়ে ফেলে। তৃতীয়বার কড়ানাড়ার শব্দ হলে গেটের কাছে গিয়ে বলে, কে আপনারা? আপনি চিনবেন না। গেট খুলেন। ওদের কণ্ঠে রুক্ষতা। ভয়ে ভয়ে সে গেটের দরজা খুলে। অমনি ষোড়শী একটি মেয়েকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে ত্রিশোর্ধ দুটি লোক। ওদের গায়ে রক্তের দাগ। সঙ্গে চটের থলের ভেতরে লুকানো মামুলি অস্ত্র। মেয়েটির বুক পূর্ণ বিকশিত। বুকের ওড়না দিয়ে তার হাত দুটো পেছনের দিকে বাঁধা। ওদিকে একবার তাকিয়েই নিবারণ চৌধুরী দু’চোখ নিচে নামায়। লোক দুটির দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে বলে, কী ব্যাপার...? মেয়েটা বিহারি কলোনির। মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন সব গত রাইতে শেষ করা হইছে। ওর কাছে সন্দেহজনক কিছু আছে। আমি তো কিছই বুঝতেছি না। ওরে তল্লাশি করণ লাগব। এই জন্য আপনের বাড়ির একটা ঘর দরকার। মেয়েটিকে নিয়ে আসা লোক দুটির প্রথম জনকে সমর্থন করে দ্বিতীয় লোকটি বলে। নিবারণ চৌধুরী ভাবনায় পড়ে। সে খেয়াল করে দেখল, ওড়না দিয়ে দু’হাতে বাঁধা মেয়েটির গায়ের কোথাও সন্দেহজনক কিছু লুকানোর অবকাশ নেই। অথচ ওরা চায় নির্জন ঘর। কিসের জন্য? আদিম উল্লাসে মেতে ওঠার জন্য নয় কি...! নিজের মনে প্রশ্ন করে। তার মেয়ের সমবয়সী মেয়েটা। নিজের মেয়েদের নিরাপত্তার কথা ভেবে গতকাল গাঁয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। মনে মনে বলে, আমার মেয়ের মতোই একটি নিষ্কলুষ মেয়ে দুর্বৃত্তের কবলে পড়ে কিনা আমারই আশ্রয়ে সম্ভ্রম হারাবে? না, তা কিছুতেই হতে পারে না! মনের দৃঢ়তা দু’হাতের মুঠিতে বিকশিত হয়। অথচ বাসায় সে একা। অন্যদিকে লোক দুটি সশস্ত্র। তবুও বিচলিত হয়নি নিবারণ। বিবেকের প্রশ্রয় আর ভেতরের চেতনায় ওই মুহূর্তে সে অসম সাহসী হয়। প্রতিবাদমুখর হয়ে বলে, ওর কাছে এমন কী আছে যে, নির্জন কক্ষে নিয়ে তল্লাশি চালাতে হবে? ঠিক আছে, আমি জিজ্ঞেস করে দেখি! দেখেন! ভেতরের কুমতলব চেপে লোক দুটির একজন বলে। তখন নিবারণ চৌধুরী মেয়েটাকে একটু দূরেÑ উঠোনের এক পাশে ডেকে নিয়ে বলে, বলো তো মা কী ব্যাপার? চোখের সামনে মা-বাবা-ভাই-বোন সবাইকে মাইরা ফেলাইছে। অথচ আমারে বাঁচাইয়া রাখছে...। কেন? নিজে বুঝতেছেন না? কিসের জন্য নির্জন ঘর চায়! তাই নাকি! কত কইরা কইলাম, আমাকেও মাইরা ফেলেন। কিন্তু, শকুন দুইটা আমার কোন কথাই শুনতেছে না। তাইলে তোমার কাছে গোপন কিছু নাই? কী থাকবে আবার! দেখেন না, বুকের ওড়নাটা নিয়া হাত দুটা বাইন্ধা রাখছে। ওদের মতলব তো একটাই। আপনি আমার বাবার বয়সী। আমার জীবন যায় যাক। মা-বাপ-আত্মীয়স্বজন হারাইয়া আমি বাঁচতে চাই না। জীবনের বিনিময়ে হইলেও আমার ইজ্জত বাঁচাইতে চাই। আপনি দয়া করে আমাকে সাহায্য করেন। আচ্ছা দেখি কী করণ যায়। অতি শোকে পাথর এবং মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ানো নির্বিকার মেয়েটির মুখ থেকে কথাগুলো শুনে নিবারণ চৌধুরী তার হাতের বাঁধন খুলে দেয়। ততক্ষণে ওড়নাটা নিয়ে মেয়ে তার আব্রু ঢাকে। নিবারণ চৌধুরী তখন ভয়কে জয় করে ওদের মুখোমুখি হয়। বলে, আমি তো ওর মাঝে সন্দেহজনক কিছু পাই নাই। তা হলে... আপনি ঘর দিবেন না ? না। এত বড় সাহস আপনাদের! এই শহরের কোন্ নেতার ছায়ায় আছেন অপনারা? বলেন, আমি তার কাছে যাব। শহরের সবচেয়ে বড় নেতা যে, তার সঙ্গে ওঠাবসা আমার। চলেন মেয়েটাকে নিয়ে যাই তার কাছে। না। তার দরকার অইব না। মেয়েটারে আপনার হাওলায় রাইখ্যা গেলাম। বিকেলে আইসা নিয়া যামু। এই বলে কুমতলব চরিতার্থ করতে না পারার ক্ষোভে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করতে করতে ওরা চলে যায়। নিবারণ চৌধুরী স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। কিন্তু, এ আর কতক্ষণ! ওরা তো বলে গেল বিকেলেই মেয়েটাকে নিতে আসবে। তাহলে এ মুহূর্তে কী করা যায়! মেয়েটাকে ঘরে ডেকে নিয়ে বসতে দেয় সে। অতঃপর বাইরে এসে পাঁয়চারি করতে থাকে। নিরুপায় হয়ে একবার গেট খুলে বাইরে আসে, আবার ঘরে যায়। স্থির সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। ভাবে, শত্রুপক্ষের হলেও কী করে মেয়েটিকে ওই হায়েনা দুটোর হাত থেকে বাঁচানো যায়। -হায়েনা? -ৈহ্যাঁ-হ্যাঁ, হায়েনাই তো। নিজেই নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করে। মনে মনে বলে, গতকাল পাকিস্তানী বিমান হামলা হওয়ার জবাবেই কি বিহারি কলোনিতে গতরাতে হত্যাযজ্ঞ হয়েছে। জাতিগত এ হত্যাযজ্ঞে এদেশের মুক্তিকামী মানুষই অংশ নিয়েছে কী...? না কি দুর্বৃত্ত ও লুটেরা ওরা! এ দু’জন তবে ওসব দুর্বৃত্তদের সদস্য। মুক্তিকামীদের কেউ নয়। এসব ভেবে ভেবে ফের সে গেটের বাইরে বের হয়। একটু দূরে তাকিয়ে দেখতে পায় মিনার মাকে। ব্রহ্মপুত্রের ওপারের হরিজন পল্লির মিনার মা। শহরে ঝাড়ুদারের কাজ করে। কী যেন ভেবে সে মিনার মাকে ডাকে। বলে, ওই মিনার মা, এদিকে আস তো! মিনার মাও বিহারি। ওরাও বিহারি। পার্থক্য শুধু ধর্মের। তবে ভাষা প্রায় এক। মিনার মা কাছে এলে তাকে নিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে। মেয়েটাকে স্ত্রীর একটা শাড়ি পরতে দেয়। অতঃপর মিনার মায়ের হাতে সঁপে দিয়ে বলে, মিনার মা! ওকে তোমার মিনার মতো দেখবে। ওর মান-সম্মান-ইজ্জত তুমি জীবন দিয়ে হলেও রক্ষা করবে। এই বলে মিনার মায়ের সঙ্গে শাড়ি পরিয়ে মেয়েটিকে বিদায় করে দেয়। তারপর দ্রুত তিনি প্রস্তুতি নেয়। অল্প সময়ের ব্যবধানে বাইসাইকেলটা নিয়ে বের হয়। গেটে তালা ঝুলিয়ে খানিক দাঁড়িয়ে দেখে বাসাটা। তারপর একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বাইসাইকেলে ওঠে। প্রথমে, ব্যাংকে গিয়ে কোম্পানির টাকাগুলো জমা দেয়। ২৭ মার্চ খাগডহর ইপিআর ক্যাম্প বাঙালীদের আয়ত্তে আসার পর শহরের বিভিন্ন স্থানে নানা শ্রেণীর মানুষ সামরিক প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল। নিবারণ চৌধুরী তখন বার্মা ইস্টার্ন কম্পানিতে কর্মরত। সপরিবারে বসবাস করে শহরের একটি আবাসিক এলাকায়। ছেলে ইমন চৌধুরী স্কুলের ছাত্র হলেও স্বাধীনতা আন্দোলনের সক্রিয় এক ক্ষুদে কর্মী। সেও তখন সরকারী কলেজ মাঠে সামরিক প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল। দুটি মেয়ে গীতা চৌধুরী এবং সীতা চৌধুরী। দু’জনই দশম শ্রেণীর ছাত্রী। ইমন তখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। বয়সে ছোট হলেও স্কাউটের গ্রুপ লিডার হওয়ায় বেশ চৌকস হয়ে ওঠে। এদিকে ১৭ এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনী ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জ ও চরপাড়ায় ব্যাপক বোমা বর্ষণ করে। চালানো হয় বিমান দুটি থেকে নির্বিচারে মেশিনগানের গুলি। শম্ভুগঞ্জ খেয়াঘাটে তখন পারাপাররত বহুলোক গুলিবিদ্ধ হয়। শহরে বিমান হামলার পর দৃশ্যপট যায় পাল্টে। অশান্ত শহরে থমথমে অবস্থা। সবার চোখমুখে আতঙ্কের ছায়া। পাক বাহিনীর বিমান হামলার পর শহরে একটা গুজব রটে। বলা হয়, সানকিপাড়ার বিহারি কলোনিতে বিহারিরা লাল নিশান উড়িয়ে শহর চিনিয়ে দিয়েছে। গুজবের সত্যতা যাচাই না করে কিছু সুযোগ সন্ধানী দুবৃত্ত, গু-া, দাঙ্গাবাজ ও লুটেরা বিহারি কলোনিতে হামলা চালায়। ১৮ এপ্রিল ওরা রেলওয়ে কলোনি, রামকৃষ্ণ মিশন রোড ও পাটগুদাম এলাকায় হামলা চালিয়ে শতাধিক বিহারিকে হত্যা করে। চালানো হয় লুটতরাজ। এতে শহরের পরিবেশ আরও আতঙ্কগ্রস্ত হয়। সেই রাতের পর ভোর থেকে আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ শহর ছাড়তে থাকে। নিবারণ চৌধুরীও ছেলে ইমনকে দিয়ে পাঁচ সদস্যের পরিবারটি গাঁয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। পেশাগত কারণে পরিবারের সঙ্গে শহর ছাড়তে পারেনি সে। তার হাতে তখন কোম্পানির অনেক টাকা। সেদিন ছিল সাপ্তাহিক ছুটি। ব্যাংক ছিল বন্ধ। পরদিন অফিস খুললে কোম্পানির টাকাগুলো ব্যাংকে জমা দিয়ে শহর ছাড়বে। এমন ইচ্ছে তার। এর মাঝেই ঘটনাটি ঘটে। অফিসে টাকা জমার রসিদ রেখে বের হতে হতে বিকেল হয়। আর বাসায় ফিরেনি নিবারণ। শম্ভুগঞ্জ ঘাট দিয়ে দুরু দুরু বুকে নদীটা পার হবে। বিকেলে ওদের আসার কথা। কাছেই তো তাদের বাসা। ঘাটের কাছে এসে দুর্বৃত্ত দুটোর ভয়ে বারবার বাসার দিকে তাকায়। ভাবে, দেখে ফেলেনি তো ওরা! নদী পার হয়ে ওপাড়ে উঠেই সাইকেলে শ্বশুরালয়ের উদ্দেশে নেত্রকোনায় ছুটবে। পরের গন্তব্য হয়ত বা শরণার্থী শিবির।
×