ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কাওসার রহমান

নির্বাচন কমিশন আইন নিয়ে সরকারের চমক

প্রকাশিত: ২১:২৮, ২১ জানুয়ারি ২০২২

নির্বাচন কমিশন আইন নিয়ে সরকারের চমক

নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে শেষ হয়েছে রাষ্ট্রপতির সংলাপ। গত ২০ ডিসেম্বর থেকে রাষ্ট্রপতি আমন্ত্রিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করেন। জাতীয় পার্টির সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপতির শুরু হয় এই সংলাপ। ১৭ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপতির ডাকা সংলাপ শেষ হয়। বেশ কিছু দল সংলাপে অংশ নেয়। এবারের সংলাপে ৩২টি রাজনৈতিক দলকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও এতে অংশ নিয়েছে আওয়ামী লীগসহ ২৫টি দল। তবে বিএনপি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, সিপিবি, বাসদ, জেএসডিসহ (রব) সাতটি রাজনৈতিক দল নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে সংলাপে যায়নি। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে তৃতীয়বারের মতো রাষ্ট্রপতির সঙ্গে রাজনৈতিক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমবার ২০১১ সালের ২২ ডিসেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রয়াত জিল্লুর রহমান বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপে ডাকেন। তবে বিএনপি তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অনড় থাকায় ওই সংলাপ থেকে কার্যকর কোন ফল বেরিয়ে আসেনি। দ্বিতীয়বার ২০১৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের সংলাপ শুরু হয়। চলে ২০১৭ সালের ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত। বঙ্গভবনে পর্যায়ক্রমে মোট ৩১টি রাজনৈতিক দল সংলাপে অংশ নেয়। প্রথম দিন সংলাপে অংশ নিয়েছিল বিএনপি। এরপর ২০ ডিসেম্বর জাতীয় পার্টি, ২১ ডিসেম্বর এলডিপি ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, ২২ ডিসেম্বর জাসদ (ইনু) সংলাপে অংশ নেয়। ২০১৭ সালের ১১ জানুয়ারি সংলাপে অংশ নেয় আওয়ামী লীগ। এক মাসে পাঁচ দফায় এ সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। অন্যান্যবারের মতো এবারও সংলাপে অংশ নেয়া রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান দাবি ছিল একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সংবিধানে উল্লেখ থাকা আইন প্রণয়ন। বিএনপি রাষ্ট্রপতির সংলাপে অংশ না নিলেও তাদের সমমনা ক’টি দল সংলাপে অংশ নিয়ে আইন করে নির্বাচন কমিশন গঠনের পক্ষে মত দিয়েছে। আর এখন এ নিয়ে কিছু না বললেও এক সময় বিএনপিও আইন করে ইসি গঠনের কথা বলেছে। দেশের প্রধান এবং বৃহত্তম রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন আওয়ায়ী লীগও নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতির সংলাপে যে চার দফা প্রস্তাব দিয়েছে সেখানেও কমিশন গঠনে আইনের কথা বলা হয়েছে। এবার দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ১০ সদস্যের প্রতিনিধি দল নিয়ে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে অংশ নেয়। নির্বাচন কমিশন আইন নিয়ে আওয়ামী লীগের দেয়া প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৮-এর বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগদান করবেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি যেরূপ উপযুক্ত বিবেচনা করবেন সেই প্রক্রিয়ায় তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগদান করবেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের লক্ষ্যে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৮-এর বিধান সাপেক্ষে একটি উপযুক্ত আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে। বর্তমানে এই ধরনের কোন আইন না থাকায় সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের ক্ষেত্রে সংবিধান ব্যতিরেকে অন্য কোন আইন প্রতিপালনের বাধ্যবাধকতা নেই। তবে সাংবিধানিক চেতনা সমুন্নত রাখতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারের যোগ্যতা-অযোগ্যতা এবং তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া নির্ধারণের লক্ষ্যেই মূলত এই আইনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সংলাপ ছাড়াও নানা সময় বিশিষ্টজনরা ইসি গঠনে আইন প্রণয়নের বিষয়ে দাবি জানিয়ে আসছেন। তবে নাগরিক সমাজের একটি অংশ এই আইন প্রণয়নের ব্যাপারে সাম্প্রতিক সময়ে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। তারা শুধু আইন প্রণয়নের দাবি করেই ক্ষান্ত হননি, নিজেরাও আইনের একটি খসড়া তৈরি করে আইন মন্ত্রীর কাছে জমা দেন। যেন নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর চেয়ে তাদের মাথা ব্যথাটাই বেশি। অথচ দেশের প্রতি তাদের প্রায় কোন অবদান নেই। রাজনীতিবিদদের তো কিছুটা হলেও জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয়; কিন্তু তাদের কোন জবাবদিহির ব্যবস্থা নেই। এবারের সংলাপ নিয়ে অনেকেরই তেমন আগ্রহ ছিল না। প্রশ্ন ছিল, সংবিধানে তো আইন প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে। সেই আইন অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারগণ নিয়োগ লাভ করবেন। তাহলে আইন প্রণয়ন না করে বারবার কেন সংলাপ করা হচ্ছে? আর সংলাপ হলেও তো সেই একই বিষয় উঠে আসবে। নতুন কিছু পাওয়া যাবে না। এ কারণে সংলাপের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর যেমন আগ্রহ ছিল না, তেমনি সচেতন নাগরিকদেরও তেমন আগ্রহ ছিল না। আগ্রহ ছিল কেবল নাগরিক সমাজের সেই অংশের যারা সব কাজ বাদ রেখে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দিচ্ছেন এই আইনের জন্য। আমাদের অভিমত, শুধু নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সংলাপ অনুষ্ঠান আয়োজনের কোন প্রয়োজন নেই। সংলাপ অবশ্যই হতে হবে। প্রতি বছর অন্তত দুবার করে সংলাপ আয়োজন করতে পারেন রাষ্ট্রপতি। এই সংলাপে সব রাজনৈতিক দল অংশ নেবে। তারা দেশের উন্নয়ন, সমস্যা, অগ্রাধিকার ইস্যু, শাসন ব্যবস্থা প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা করবে। সেই সংলাপে সরকারী দলও অংশ নেবে। তবে কোন মন্ত্রী বা সরকারের কোন সরকারী প্রতিনিধি দলে থাকতে পারবেন না। দলের নেতৃবৃন্দ আসবেন। তারাও আলোচ্য ইস্যুগুলো নিয়ে কথা বলবেন, প্রস্তাব করবেন। রাষ্ট্রপতির কার্যালয় সেই সংলাপের একটি সারসংক্ষেপ তৈরি করে সরকার প্রধানের কাছে দেবে। এতে সংসদের বাইরে আরও একটি ফোরাম তৈরি হবে। যাদের প্রস্তাবগুলো বিবেচনায় নিয়ে সরকার আরও গতিশীল হতে পারে। দেশ আরও উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে পারে। কারণ, সংসদে সব দলের প্রতিনিধিত্ব নেই। ফলে রাষ্ট্র পরিচালনায় সব দলের একটি অংশগ্রহণ থাকবে। আর সংসদ তো সংসদের মতো করে তার ভূমিকা রাখবেইÑ এতে কোন সন্দেহ নেই। সংলাপ চলাকালে বা সংলাপের আগে আইনমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে কিছুটা আঁচ পাওয়া যাচ্ছিল যে, এবার কিছু একটা ঘটবে। আইনমন্ত্রীও বারবার বলে আসছিলেন, ‘আইন প্রণয়নে কাজ চলছে।’ তিনি দেশবাসীকে অপেক্ষা করতে বলছিলেন কিছু একটার জন্য। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘রাষ্ট্রপতি যে প্রক্রিয়ায় সার্চ কমিটি গঠন করে নির্বাচন কমিশন গঠন করছেন সেটাও আইনী প্রক্রিয়া। এতে সংবিধানের লঙ্ঘন হয় না।’ আসলে সংলাপের শেষ দিনে সেই কাজটিই হয়েছে। সরকার মন্ত্রিসভার বৈঠকে খসড়া নির্বাচন কমিশন আইনের চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েই সংলাপে অংশ নিতে গেছে। এটি ছিল রীতিমতো নাটকীয় ঘটনা। আশা করা গিয়েছিল যে, সংলাপ শেষে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের পর হয় তো আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হবে। কিন্তু সংলাপের ঠিক শেষ দিনে এসে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২’-এর চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়ে সরকার কিছুটা নাটকীয়তার সৃষ্টি করেছে। এখন বাকি রইল শুধু আইন পাসের প্রক্রিয়া। তবে আইন পাসের প্রক্রিয়া এবং আইনের বিধি তৈরি করে তা বাস্তবায়ন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়াও কিছুটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য হাতে যে ১৫ কার্যদিবস সময় আছে তাতে তা হয়ত সম্ভব নয়। স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হয়ে গেলেও নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন প্রণয়নের বিষয়ে এতদিন তেমন তৎপরতা দেখা যায়নি। বর্তমান সরকার আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েও এক পর্যায়ে নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ প্রান্তে চলে আসায় শেষ পর্যন্ত আইনটি করার বিষয়ে গতি স্লথ করে দেয়। কিন্তু বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ এবং বিদেশী কূটনীতিকদের পক্ষ থেকে আইন করে নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবি উঠলে সরকার এ বিষয়ে আবার গতি বাড়ায়। এ কারণে কিছুটা তাড়াহুড়া করেই ১৭ জানুয়ারি আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় উত্থাপন ও অনুমোদন করা হয়। অবশ্য এর আগে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যে, এত অল্প সময়ের মধ্যে নতুন একটি আইন প্রণয়ন করা সম্ভব নয়। নির্বাচন কমিশন আইন প্রণয়নে বারবার সংবিধানের প্রসঙ্গ টানা হচ্ছে। সব দলই সংবিধানের উদ্ধৃতি দিচ্ছে। আসলেই কি সংবিধানে নির্বাচন কমিশন আইন প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে? বিশেষ করে সংবিধানের ১১৮ (১) অনুচ্ছেদের উদ্ধৃতি দেয়া হচ্ছে। আসলে কি বলা হয়েছে ১১৮ (১) অনুচ্ছেদে? সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে মোট ৬টি ধারা রয়েছে। এর মধ্যে দুটি ধারায় আইনের প্রসঙ্গ টানা ও উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। এ দুটি ধারা হচ্ছে অনুচ্ছেদ ১১৮(১) ও অনুচ্ছেদ ১১৮(৪)। পাঠক, চলুন দেখে নেয়া যাক এই দুটি ধারায় কী বলা হয়েছে। ১১৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া এবং রাষ্ট্রপতি সময়ে সময়ে যেরূপ নির্দেশ করিবেন, সেইরূপ সংখ্যক অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোন আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দান করিবেন।’ অপরদিক, সংবিধানের ১১৮(৪) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবে এবং কেবল এই সংবিধান ও আইনের অধীন হইবে।’ বারবার নির্বাচন কমিশন আইন প্রণয়নের ব্যাপারে সংবিধানের উদ্ধৃতি বা প্রসঙ্গ টানার কথা এ কারণেই বলছি যে, সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে আইন প্রণয়নের কথা বলা হয়নি। এই ১১৮ অনুচ্ছেদই হচ্ছে সংবিধানের নির্বাচন কমিশন গঠন সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ। যদি সংবিধানে নির্বাচন কমিশন আইন প্রণয়নের বাধ্যবাধকতা থাকত তাহলে নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত এই অনুচ্ছেদের প্রথমেই বলা হতো, সংবিধানের বাধ্যবাধকতা পরিপালনের জন্য নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য একটি আইন প্রণয়ন করা হবে। বরং এই অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতা দিয়ে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রপতি সময়ে সময়ে যেরূপ নির্দেশ করিবেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া এবং সেইরূপ সংখ্যক অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে।’ অর্থাৎ সংবিধানের এই লাইনেই রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষমতা দেয়া হয়ে গেছে। এখন দ্বিতীয় লাইনে কেবল আইনের প্রসঙ্গ টেনে বলা হযেছে। উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোন্ আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিযোগদান করবেন? অর্থাৎ যদি কোন আইন থাকে তাহলে কেবল এই দ্বিতীয় লাইন প্রযোজ্য। এখানে আইন থাকার কোন বাধ্যবাধকতাকে বোঝায়নি। আইন থাকলেও চলে, না থাকলেও চলবে। সংবিধানের এই অস্পষ্ট নির্দেশনা নিয়ে সকলের কতই না মাতামাতি। আসলে কেউ হয়ত সংবিধানের এই অনুচ্ছেদটি ভালভাবে পড়ে দেখেননি। চিলে কান নিয়ে গেছে, সেই কানের পিছনে সবাই ছুটছেন। কেউ কানে হাত দিয়ে দেখছেন না তার কান আছে কিনা। যাহোক, বর্তমান সরকার সব দল ও নাগরিক সমাজের দাবির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে অবশেষে গত ১৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন-২০২২’-এর খসড়া অনুমোদন দিয়েছে। এখন আইন মন্ত্রণালয়ে ভোটিংয়ের পর আইন প্রণয়নের জন্য একটি বিল জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হবে। এরপর এটি অধিকতর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য আইন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে যাবে। সংসদীয় এ কমিটি বিলের ওপর একটি রিপোর্ট পেশ করবে। এরপর বিলটির ওপর বিভিন্ন যাচাই-বাছাই ও ছাঁটাই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার পর কণ্ঠভোটে তা সংসদে পাস করা হবে। রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর এটি আইন হিসেবে কার্যকর হবে। এ আইন বাস্তবায়নের জন্য বিধি করার প্রয়োজন পড়বে। অর্থাৎ আইনটি কার্যকর হতে এখনও কয়েক ধাপ বাকি। খসড়া আইনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার কারা হতে পারবেন এবং তাদের যোগ্যতা কি হবে সেক্ষেত্রে বলা হয়েছে, তাকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে। বয়স কমপক্ষে ৫০ বছর হতে হবে। কোন গুরুত্বপূর্ণ সরকারী, আধা-সরকারী বা বেসরকারী বা বিচার বিভাগীয় পদে কমপক্ষে ২০ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। তাহলেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা নির্বাচন কমিশনার হতে পারবেন। খসড়া আইনে অযোগ্যতার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, আদালতের মাধ্যমে যদি কেউ অপ্রকৃতস্থ হিসেবে ঘোষিত হন, দেউলিয়া ঘোষণার পর দেউলিয়া অবস্থা থেকে মুক্ত না হন, অন্য কোন দেশের নাগরিকত্ব অর্জন করেন বা কোন বিদেশী রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন, নৈতিক স্খলন এবং সেক্ষেত্রে যদি ফৌজদারি অপরাধে কমপক্ষে দু’বছরের কারাদ-ে দ-িত হন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে দ-িত হন, তাহলে তিনি এ কমিশনের সদস্য হতে পারবেন না। এছাড়া কেউ রাষ্ট্রীয় পদে থাকলেও প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনার হতে পারবেন না। নতুন আইনেও একটি সার্চ কমিটির কথা বলা হয়েছে। এই সার্চ কমিটিতে থাকবেন ৬ জন। এক নম্বরে থাকবেন প্রধান বিচারপতি মনোনীত সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের একজন বিচারপতি। তিনি কমিটির চেয়ারম্যান হবেন। এরপর থাকবেন প্রধান বিচারপতি মনোনীত সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক, কম্পট্রলার এ্যান্ড অডিটর জেনারেল, পিএসসির চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রপতি মনোনীত ২ জন বিশিষ্ট নাগরিক। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সার্চ কমিটির সাচিবিক দায়িত্ব পালন করবে। এবারের ইসি গঠন কী নতুন আইনেই নাকি আগের চলমান ব্যবস্থায় হবে তা নিয়ে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে। নতুন আইনে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হলে সময় একটি বিষয়। তবে সরকার চাইলে সময় কোন বিষয় নয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কথায় সেটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যেহেতু নতুন নির্বাচন কমিশন আইন অনেকটা দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো, তার মানে সেই আলোকে বিধি প্রণয়ন করে রাখলে দ্রুত আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের কাজ সহজ হবে। প্রস্তাবিত নির্বাচন কমিশন আইনে ঠিক কী কী আছে, কিভাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারগণ নির্বাচিত হবেন সে ব্যাপারে এখনও বিশদ কিছু প্রকাশিত হয়নি। আইনটি সংসদে উঠলে হয়ত তখন বিস্তারিত জানা যাবে। তবে যতটা অনুমান করা যাচ্ছে তা হলো, নির্বাচন কমিশন গঠনের বর্তমান প্রক্রিয়াই এতে রাখা হয়েছে। সার্চ কমিটি যে গঠিত হবে, তাতে সন্দেহ নেই। কাদের নিয়ে সার্চ কমিটি গঠন করা হবে সে ব্যাপারেও আইনে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কে বা কারা কমিশনার ও প্রধান নির্বাচন কমিশনার হতে পারবেন তাও কিছুটা প্রকাশিত হয়েছে। শুধু সংলাপ হবে কিনা তা এখনও জানা যায়নি। তবে সার্চ কমিটি গঠনের গাইডলাইন দেয়া থাকলে আর সংলাপের প্রয়োজন হবে না। সেক্ষেত্রে এবারের সংলাপটি হবে নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতির শেষ সংলাপ। তাই শেষ সংলাপ যাতে অর্থবহ হয় সেজন্য নিশ্চয়ই আমরা একটি দক্ষ, যোগ্য ও গতিশীল নির্বাচন কমিশন পাব বলে আশা করতে পারি। সরকার যেভাবে চমক দেখিয়ে দুর্মুখদের মুখে ছাই দিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপের শেষ দিনে খসড়া নির্বাচন কমিশন আইনের অনুমোদন দিয়েছে তাতে এই আইন দিয়েই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আর যদি সেটি করা হয় তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাসে তা মাইলফলক হয়ে থাকবে। আইনটি সংসদে বিল আকারে উত্থাপন করে তা সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে পাস করতে খুব বেশি সময়ের প্রয়োজন নেই। যতদূর জানা যায়, জানুয়ারি মাসের শেষ দিকেই আইনটি পাস করার জন্য যাবতীয় প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। আইন পাসের পর রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের মাধ্যমে এটি কার্যকর হবে আইন হিসেবে। তবে আইন কার্যকরের ক্ষেত্রে বাকি থাকবে বিধি। আইনের আলোকে আগে থেকে বিধি তৈরি করা থাকলে নতুন আইনেই এবারের নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন সম্ভব। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও জানিয়েছেন, ‘যদি এর মধ্যে আইনটি চূড়ান্ত হয়ে যায় তাহলে নতুন আইনেই কমিশন গঠন করা হবে।’ এত অল্প সময়ে আইন প্রণয়ন করা সম্ভব কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কোন কিছুই অসম্ভব নয়, অপেক্ষা করুন।’ তাহলে আশা করা যায়, এ আইনের বলেই ৬ সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করা হবে। ওই কমিটি অধিকতর যোগ্য ব্যক্তিদের অনুসন্ধান করে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের সুপারিশ করবে। এসব প্রক্রিয়া শেষ করে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তায় গঠন করা হবে নতুন নির্বাচন কমিশন। ১৪ ফেব্রয়ারি বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন নির্বাচন কমিশন পাঁচ বছরের জন্য দায়িত্ব গ্রহণ করবে। নতুন নির্বাচন কমিশন আইনের খসড়া মন্ত্রিসভার বৈঠকে চূড়ান্ত অনুমোদনের পর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপার্সনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলন প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিএনপি। ওই সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন কমিশন নিয়োগে মন্ত্রিসভায় যে আইনের খসড়া অনুমোদন হয়েছে তা ‘পর্বতের মূষিক প্রসব’ বা একটি ‘পচা কদু’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘এটা পর্বতের মূষিকের’ চেয়ে বেশি কিছু প্রসব করবে না। এতদিন ধরে যেটা প্রশাসনিক কায়দায় হয়েছে নির্বাচন কমিশন এখন সেটা হবে আইনী কায়দায়। আমরা এজন্যই বলেছি যে, ‘যেই লাউ, সেই কদু’। ১৯.০১.২০২২ লেখক : সাংবাদিক
×