ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

তাইওয়ানের তৈরি যন্ত্রাংশ হলেও স্টিকার ‘মেড ইন জাপান’ তদন্তে শিল্প মন্ত্রণালয়ের ৩ সদস্যের কমিটি

লাভজনক থেকে রুগ্ন ॥ গাজী ওয়্যারসের আধুনিকায়ন প্রকল্পে ২০ কোটি টাকা লোপাট

প্রকাশিত: ২৩:২৪, ২০ জানুয়ারি ২০২২

লাভজনক থেকে রুগ্ন ॥ গাজী ওয়্যারসের আধুনিকায়ন প্রকল্পে ২০ কোটি টাকা লোপাট

মোয়াজ্জেমুল হক ॥ দেশে বিভিন্ন পর্যায়ে উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাপকহারে পরিচালিত হচ্ছে, যা দিনের আলোর মতো দৃশ্যমান। ফলে, সরকারের ভাবমূর্তিও সর্বমহলে আলোচিত। তবে কোন কোন উন্নয়ন কার্যক্রমে দুর্নীতিবাজদের বেপরোয়া তৎপরতা সরকারের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ করছে। আর্থিক দুর্নীতির বড় একটি ঘটনা সরকারী প্রতিষ্ঠানের। চট্টগ্রামে বিএসইসির (বাংলাদেশ স্টীল এ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন) প্রতিষ্ঠিত ও নিয়ন্ত্রিত গাজী ওয়্যার্স লিমিটেডকে শক্তিশালী ও আধুনিকীকরণ প্রকল্পে বড় ধরনের কারিগরি ও আর্থিক অনিয়মের মাধ্যমে প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী প্রায় ২০ কোটি টাকা লোপাট করেছে দুর্নীতিবাজ শক্তিশালী একটি চক্র। এ ঘটনায় সংস্থার বিভিন্ন পর্যায় থেকে অভিযোগের পর শিল্প মন্ত্রণালয় ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করেছে, যার প্রধান হলেন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোঃ জাফর উল্লাহ। তদন্ত শেষে অর্থ লোপাটের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত ৬ জানুয়ারি তদন্ত কমিটি চট্টগ্রামে এসে সরেজমিনে তদন্ত শুরু করার কথা ছিল। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তা শুরু হয়নি। অর্থ লোপাটের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের এ ঘটনা ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, দুদকসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে সংস্থার শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের বিভিন্ন পর্যায় থেকে। দুদকের একটি সূত্র বলেছে, তারা এ সংক্রান্তে একটি অভিযাগ পেয়েছেন। তবে অনুসন্ধানের এখনও চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বিএসইসির এ প্রতিষ্ঠানটি বরাবরই লাভজনক একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত। এই গাজী ওয়্যার্সকে আরও শক্তিশালী এবং আধুনিকীকরণে সরকার সুদবিহীন ৬৯ কোটি টাকা প্রদান করেছে, যা পাঁচ বছর পর সংস্থাটিকে ফেরত দিতে হবে। একনেকে সুদমুক্ত এ ঋণ অনুমোদিত অর্থাৎ এডিপি (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী) হতে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। উল্লেখ্য, চট্টগ্রামের কালুরঘাটে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রায়ত্ত্ব এ শিল্প প্রতিষ্ঠানটি প্রধানত বিভিন্ন সাইজের তামার তার উৎপাদন করে; যা বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মার, ফ্যানসহ বিভিন্ন ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসে ব্যবহৃত হয়। ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত বেসরকারী এ প্রতিষ্ঠানটি ১৯৭২ সালে সরকারী নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। আধুনিকীকরণের এই প্রকল্পে সরকার প্রদত্ত প্রাক্কলিত ৬৯ কোটি টাকা ব্যয়ে আধুনিক মেশিনারিজ ক্রয় ও ফ্যাক্টরি ভবন নির্মাণ কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, মেশিনারিজ ক্রয়ের ক্ষেত্রে টেন্ডার ডকুমেন্ট প্রস্তুত থেকে মেশিনারিজ আমদানির পর স্থাপন পর্যন্ত সর্বস্তরে অত্যন্ত কৌশলে দুর্নীতির মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে লোকাল এজেন্ট নির্দিষ্ট করে রেখে ওই এজেন্টের ব্যাংক এ্যাকাউন্টে লুটে নেয়া অর্থ গচ্ছিত রাখা হয়; যার পরিমাণ ১২ কোটি টাকা। অনিয়মের বড় ঘটনাটি হয়েছে জাপানী মেশিনারিজ সরবরাহ দেয়ার শর্ত উপেক্ষা করে তাইওয়ানে নির্মিত যন্ত্রপাতি জাহাজীকরণ করে আনা। বাণিজ্যিক অডিট অধিদফতর চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয় তাদের রিপোর্টে উল্লেখ করেছে ‘গাজী ওয়্যার্সের এ প্রকল্পে ২০১৯-২০২০ এবং ২০২০-২০২১ অর্থবছরের হিসাব নিরীক্ষায় সুনির্দিষ্ট তথ্য মিলেছে যে, জাপানের তৈরি মেশিনারিজ ও ইক্যুইপমেন্টের পরিবর্তে তাইওয়ানে প্রস্তুতকৃত মেশিনারিজ ও ইক্যুইপমেন্ট ক্রয় করে অনিয়মিত ব্যয় হয়েছে ৪৫ কোটি টাকার বেশি। নিরীক্ষা রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, এ প্রকল্পের জন্য ২০১৯ সালে দরপত্র আহ্বান করা হলে তিনটি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। কারিগরি সাব মূল্যায়ন কমিটির সভায় মেসার্স সিকমে ইটালিয়া ইম্পিয়ানটি ভায়া টরিনো, ইতালি এবং মেসার্স ডায়মন্ড প্রজেক্ট কলি জাপানের দরপত্র কারিগরি বিবেচনায় বিবেচিত হয়। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি কারিগরি মূল্যায়নে গ্রহণযোগ্য ও সর্বনি¤œ দরদাতা প্রতিষ্ঠান মেসার্স ডায়মন্ড প্রজেক্ট কলি জাপান, ম্যানুফেকচারার কোম্পানি মেসার্স পুরুকুয়া বুশন কলি, জাপান এবং হোকোয়েটসু ইন্ডাস্ট্রিজ কলি জাপানকে ক্রয়াদেশ দেয়ার সুপারিশ করা হয়। কমিটির সুপারিশক্রমে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের ১৯৪তম কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ওই প্রতিষ্ঠানসমূহকে ক্রয়াদেশ দেয়ার সিদ্ধান্ত প্রদান করা হয়। সূত্র জানায়, কারিগরি সাব মূল্যায়ন কমিটি দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশ ও কোম্পানির বোর্ড সভায় উল্লেখিত প্রতিষ্ঠানসমূহকে ক্রয়াদেশ দিলেও আদেশের একটি শর্তে কান্ট্রি অব অরিজিন হিসেবে জাপান ও তাইওয়ানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে কৌশলে। এর পর প্যাকেজ-১ ও প্যাকেজ-২’র আওতায় ৯টি মেশিনারি ও ইক্যুইপমেন্ট আমদানির জন্য ডায়মন্ড প্রজেক্ট কলি জাপানের অনুকূলে ২০২০ সালের ৫ মার্চ এলসি খোলা হয়। এর মধ্যে ৬টি মেশিনারিজ ও ইক্যুইপমেন্ট তাইওয়ান থেকে জাহাজীকরণ করা হয়। ফলে জাপানের পরিবর্তে তাইওয়ান প্রস্তুতকৃত মেশিনারিজ ও ইক্যুইপমেন্ট ক্রয় করায় অনিয়মিত ব্যয় করা হয়েছে ৪৫ কোটি টাকার বেশি। সূত্র জানায়, সুবিধাভোগীরা অত্যন্ত কৌশলে পিপিআর-২০০৮ও ভঙ্গ করে টেন্ডার ডকুমেন্ট প্রস্তুত এবং সিপিটিইউ জারিকৃত স্টান্ডার্ড টেন্ডার ডকুমেন্টে অপ্রয়োজনীয় শর্ত লোকাল এজেন্ট কোয়ালিফিকেশন ক্রাইটেরিয়াতে বাধ্যতামূলক করা হয় এবং স্পেসিফিকেশন তৈরিতে জাপান, জার্মানি, ইইউভুক্ত দেশ, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র স্টান্ডার্ড লেখা হয়। অথচ, পূর্ব নির্ধারিত লোকাল এজেন্ট এবং এর সহযোগী জাপানী ঠিকাদারের মাধ্যমে তাইওয়ানে প্রস্তুতকৃত নি¤œমানের স্বল্পমূল্যের মেশিনারিজ আমদানি করে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে এই কারখানায়। কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর ইতোমধ্যে ৯০ শতাংশ অর্থ প্রদান করা হয়েছে। অথচ প্রকল্প কাজ শেষে দেখা যায়, নি¤œমানের মেশিনারিজগুলো কখনও চালু হয় আবার পরক্ষণেই বন্ধ হয়ে যায়। যে কারণে গত প্রায় দুমাস যাবত নতুন প্রকল্পটিতে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।
×