ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আগামীর পথে মারিয়ারা

প্রকাশিত: ০১:৪৭, ১৯ জানুয়ারি ২০২২

আগামীর পথে মারিয়ারা

জিততে হলে চাই পরিকল্পনা, চেষ্টা, পরিশ্রম, ধৈর্য আর মনোবল। এই মানবিক অনুভূতির লেশমাত্র আজ থেকে দশ বছর আগেও ছিল না বাংলাদেশের জাতীয় দলের মহিলা ফুটবলারদের। একই অবস্থা ছিল বিভিন্ন বয়সভিত্তিক মহিলা দলগুলোরও। প্রতি ম্যাচেই যদি নামতা গুণে হালি হালি গোল হজম করতে হয়, তাহলে আত্মবিশ্বাস কোথায় থাকবে বলুন! হারার আগেই মানসিকভাবে হেরে যেত বাংলাদেশের মেয়েরা। অথচ কীভাবে বদলে গেছে দৃশ্যপট, মহিলা ফুটবলের শুধু জয়জয়কার। ছেলেদের আগে বাংলাদেশের মেয়েরাই যে কোন লেভেলের বিশ্বকাপ ফুটবল খেলবে, এমনটা বিশ্বাস করার লোকই বেশি। বিশ্বাস করার অনেক উপাদান আছে। গত সাত বছরের মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ের ফুটবলে বাংলার বাঘিনীদের চোখ ধাঁধাঁনো আটটি শিরোপা। আর এই সব সাফল্যের নেপথ্য কারিগর হচ্ছেন কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন। তিনিই এখন ফুটবল পাগল বাঙালীকে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন তার শিষ্যারা একদিন অনেক দূর যাবে। ছোটনের হাতে এ বছর আছে চারটি এ্যাসাইনমেন্ট। আগামী মার্চে ভারতে অনুষ্ঠিত হবে সাফ অনুর্ধ-১৮ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপ। এই আসরে বাংলাদেশ বর্তমান চ্যাম্পিয়ন। শিরোপাজয়ী বাংলাদেশ দলের আট খেলোয়াড় এবার বয়সের কারণে খেলতে পারবে না। তারপরও ছোটন আশাবাদী, শিরোপা ধরে রাখার ব্যাপারে। সাফ অনুর্ধ-১৫ নারী চ্যাম্পিয়নশিপ অনুষ্ঠিত হবে ঢাকায়। তবে দিনক্ষণ এখনও কিছু ঠিক হয়নি। সেপ্টেম্বরে চীনে অনুষ্ঠিত হবে এশিয়ান গেমস ফুটবল। এই আসরে প্রথমবারের মতো খেলবে বাংলাদেশের মেয়েরা। সিনিয়র সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ অনুষ্ঠিত হবে আগামী আগস্টে। সম্ভাব্য ভেন্যু নেপাল। এই আসরে বাংলাদেশ দল তিনবার সেমিফাইনাল খেলে, রানার্সআপ হয়েছে ২০১৬ সালে। এবার কি সেই বন্ধ্যত্ম ঘুঁচবে? এ প্রসঙ্গে ছোটন জনকণ্ঠকে বলেন, মারিয়া-মনিকারা যতই স্কিলে এগিয়ে থাকুক, শারীরিক সক্ষমতায় এখনও তারা ভারতের বালা দেবীদের চেয়ে পিছিয়ে। তাদের সঙ্গে আমাদের খেলোয়াড়দের বয়সের তফাতটা বেশি, প্রায় বছর দশেকের। ২৯-৩০ বছরের একজন খেলোয়াড়ের বিরুদ্ধে খেলতে গেলে শারীরিক কারণেই কুলিয়ে উঠতে পারবে না আমাদের ১৮-১৯ বছরের খেলোয়াড়। এ কারণেই এখনও আমরা সিনিয়র সাফে সফল হতে পারিনি। তবে আমরা প্রতিনিয়তই উন্নতি করছি। আমাদের প্লাস পয়েন্ট- দলটা একসঙ্গে খেলা শুরু করেছে সেই অনুর্ধ-১৪ থেকে, ফলে সবার মধ্যে বোঝাপড়া খুবই ভাল। মারিয়াদের বয়স যখন ২৩/২৪ হয়ে যাবে, তখন দেখবেন ঠিকই ভারতের সঙ্গে সমানতালে পাল্লা দিচ্ছে, তাদের হারিয়েও দিচ্ছে। কাজেই সেই পর্যন্ত তাদের একটু সময় দিতে হবে, এই বাস্তবতাকে মানতে হবে। নইলে এখনই তাদের কাছ থেকে সাফের শিরোপা আশা করাটা কঠিন হবে।’ সাফে বাংলাদেশের ব্যর্থতার কারণ সবারই জানা। এই দলে সিনিয়র খেলোয়াড়দের অভাব। বলতে গেলে পুরো দলটিই বয়সভিত্তিক। একমাত্র সাবিনা খাতুন সিনিয়র। এক সময় খেললেও এখন আর নেই অ¤্রাচিং মারমা, সুইন প্রু মারমা, মাইনু মারমা, আসিয়া খাতুন বিথী, মনিকা চাকমা সিনিয়র, জাহানারা আক্তার জানুসহ আরও অনেকে। তাদের জায়গায় যারা খেলছে সেই মনিকা, আঁখি, মারিয়ারা বয়সে ও অভিজ্ঞতায় অনেক পিছিয়ে। এই চারটি আসর সামনে রেখে বাফুফের আবাসিক ক্যাম্পে এখন নারী ফুটবলার আছেন ৬৭ জন, যা বিগত সময়ের চেয়ে বেশি। এ প্রসঙ্গে ছোটন জানান, ‘এই ৬৭ জনের ২২ জনই এসেছে অনুর্ধ-১৫ দল থেকে। এরা সম্পূর্ণ নতুন খেলোয়াড়। বাকিরা অনুর্ধ-১৮ ও অনুর্ধ-১৯ লেভেলের। কমলাপুর স্টেডিয়ামে সকাল সাড়ে ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে সব খেলোয়াড়রা অনুশীলন করে যাচ্ছে।’ মতিঝিলে নবনির্মিত এলিট এলিট ট্রেনিং সেন্টারে জিমে ঘাম ঝরাচ্ছে । এ নিয়ে ছোটনের ভাষ্য, ‘জিম করে মেয়েদের ফিটনেসের অনেক উন্নতি হচ্ছে। হাই ইনটেনসিটির জন্য ভাল মাসল দরকার। আর এ জন্য জিম অনেক সাহায্য করে। বাফুফের জিমে সরঞ্জাম ভালই আছে। মেয়েরা নিয়মিত জিম করে এর সুফল পাচ্ছে।’ সিনিয়র পর্যায়ে এখনও চূড়ান্ত সাফল্য না পেলেও বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টগুলোতে কিন্তু দুর্বার বাংলাদেশের জাতীয় মহিলা ফুটবল দল। তারা ৮টি শিরোপা জিতেছে এ পর্যন্ত। এগুলো হলো- এএফসি অনুর্ধ-১৪ বালিকা চ্যাম্পিয়নশিপ (আঞ্চলিক) আসরে দুবার (২০১৫ ও ২০১৬), এএফসি অনুর্ধ-১৬ আসরের (২০১৬) আঞ্চলিক বাছাইপর্বে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন একবার, সাফ অনুর্ধ-১৫ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপে (২০১৭) একবার, জকি ক্লাব গার্লস ইন্টাঃ ইয়ুথ ইনভাইটেশনাল ফুটবল টুর্নামেন্টে (২০১৮) একবার, সাফ অনুর্ধ-১৮ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপে (২০১৮) একবার, বঙ্গমাতা অনুর্ধ-১৯ ওমেন্স ইন্টারন্যাশনালে (২০১৯) একবার এবং সাফ অনুর্ধ-১৯ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে (২০২১) একবার। এ ছাড়া রানার্সআপ হয়েছে সাফ অনুর্ধ-১৫ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপে (২০১৮) এবং এএফসি অনুর্ধ-১৬ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপ বাছাইপর্বে (২০১৯)। প্রতিটি আসরেই দলের কোচ ছিলেন গোলাম রব্বানী ছোটন। বাংলার বাঘিনীদের সর্বশেষ সাফল্য গত ২২ ডিসেম্বর। কমলাপুর স্টেডিয়ামে তারা সাফ অনুর্ধ-১৯ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ভারতকে ১-০ গোলে হারিয়ে শিরোপা জেতে। এই আসরের শিরোপা বাংলাদেশ অক্ষুণœ রাখে। তাও আবার অপরাজিত শিরোপা এবং একটি গোলও হজম না করে! পুরো আসরে তারা সবচেয়ে বেশি গোল (২০) করে, হজম করেনি একটিও। বাংলাদেশ দলের ফরোয়ার্ড শাহেদা আক্তার রিপা সর্বোচ্চ গোলদাতা হন ৫ গোল করে। টুর্নামেন্টের মোস্ট ভ্যালুয়েবল প্লেয়ার তিনিই। বলা হয়ে থাকে ফুটবলে অধিনায়ক কেবল নামেই, আসলে তিনি খেটে খাওয়া শ্রমিক ছাড়া কিছুই নন! আসল অধিনায়ক যদি কাউকে বলতে হয়, তাহলে তিনি হচ্ছেন কোচ। তার দিক-নির্দেশনায়, পরিচালনায়-পরিকল্পনায় দলের জয় বা ড্র নির্ধারিত হয়। ফুটবল দলকে যদি একটা জাহাজের সঙ্গে তুলনা করা হয, তাহলে নিঃসন্দেহে সে জাহাজের ক্যাপ্টেন হচ্ছেন কোচ। শিপ ক্যাপ্টেন এবং ফুটবল কোচের মধ্যে আরেকটি মিল আছে। জাহাজডুবি হলে দায়ী করা হয় ক্যাপ্টেনকে, তেমনি দলের ভরাডুবি ঘটলে বা সাফল্য না পেলে বলির পাঁঠা বানানো হয় কোচকেই! ছোটন নিজে এক সময় ছিলেন কৃতী ফুটবলার। ১৯৮৮-২০০২ পর্যন্ত খেলেছেন আরামবাগ, ফকিরেরপুল, ওয়ারী ও বিআরটিসির হয়ে। অধিনায়কত্বও করেছেন প্রতিটি দলেরই। খেলোয়াড়ী জীবন চলাকালেই কোচিং ক্যারিয়ার শুরু করেন তিনি! গল্পটা এ রকমÑ ১৯৯৩ সালে যখন ওয়ারীর হয়ে খেলতেন, তখন থাকতেন মতিঝিলের টিএন্ডটি কলোনিতে। সেখানকার টিএন্ডটি ক্লাব সেবার প্রথমবারের মতো অংশ নেয় পাইওনিয়ার ফুটবলে। কলোনির মুরুব্বী ও বড় ভাইয়েরা চেপে ধরলেন, এলাকার ক্লাবটির কোচ হতেই হবে ছোটনকে। কি আর করা, অনুরোধে ঢেঁকি গিলতেই হলো! কোচিংয়ের কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই, অথচ ছোটনের অধীনে সে বছর টিএন্ডটি ক্লাব পাইওনিয়ার লীগে চ্যাম্পিয়ন হয়! সেই থেকে শুরু। তারপর ১৯৯৬ সালে টিএন্ডটি ক্লাবকে তিনি শিরোপা পাইয়ে দেন তৃতীয় বিভাগ ফুটবলেও। ২০০৬ সালে বাফুফে কোচ হিসেবে চাকরি হয় তার। ২০০৮ সালে মারদেকা কাপে জাতীয় ফুটবল দলের সহকারী কোচের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১০ এসএ গেমসে তাম্রপদক জেতা বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা দলেরও সহকারী কোচ ছিলেন ছোটন। মেয়েদের বয়সভিত্তিক দলগুলোর কোচ হিসেবে আছেন ২০০৯ সাল থেকে। সাফ গেমস, অলিম্পিক বাছাইপর্ব, সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ, এসএ গেমসÑ প্রতিটি আসরেই দলের সঙ্গে ছিলেন সাবেক ফুটবলার ছোটন। আগামীতে মহিলা ফুটবলকে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে নিতে ছোটন কী করেন- সেটাই এখন দেখার বিষয়।
×