ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সম্ভাবনা আর শঙ্কায় নারীর এগিয়ে চলা

প্রকাশিত: ২২:৩০, ১৮ জানুয়ারি ২০২২

সম্ভাবনা আর শঙ্কায় নারীর এগিয়ে চলা

বাংলাদেশের উন্নয়নের অগ্রগামিতায় সিংহভাগ মানুষের অংশগ্রহণ একটি অপরিহার্য বিষয়। সেখানে অর্ধাংশ নারীর ভূমিকা আরও গৌণ এবং প্রাসঙ্গিক। অপেক্ষাকৃত দুর্বল এবং পিছিয়ে পড়া নারীরা আজ বিভিন্নভাবে সামনের দিকে চলে আসাটা এক পরম স্বস্তির ব্যাপার। শ্রেণি বিভক্ত সমাজে শুধু বিত্ত কিংবা মর্যাদার ফারাক নয় বরং নারী- পুরুষের ভেদাভেদও এক অবধারিত দুর্ভোগ। বাংলাদেশের নারীরা এখনও পশ্চাৎপদ সামাজিক অপসংস্কারে নিজেদের চলার পথকে সেভাবে নিঃসংশয় এবং নির্বিঘ্ন করতে পারেনি। যুগ যুগ ধরে চলে আসা সামাজিক অভিশাপ ও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। সব বাধা বিঘ্নকে পেছনে ফেলে নারীরা এগিয়েও যায় সাবলীল গতি এবং নিজেদের অসম সাহসিকতায়। নারী শিক্ষার হার বেড়ে যাওয়ার প্রাসঙ্গিক কর্মযোগে সংশ্লিষ্টরা ঘর থেকে বের হয়ে আসার জগতও তৈরি হতে থাকে। এরপর নারীদের ক্রমশই এগিয়ে যাওয়ার দৃশ্য বিমুগ্ধ হওয়ারই মতো। আগে শিক্ষকতা ও চিকিৎসক হিসেবে মেয়েরা কর্মজীবন শুরু করতে অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করত। কিন্তু সময়ের অনিবার্য চাহিদায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদমর্যাদায় তাদের অভিষিক্ত হওয়াও এক অভাবনীয় নির্দেশনা। এখন সরকারী প্রতিষ্ঠানের সচিব মর্যাদায় নিজেদের অংশীদারিত্ব প্রমাণ করতে তারা আর কিছুমাত্র ভাবছে না। বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে উচ্চ পদে আসীন হতেও তারা কোন বাধাবিঘ্ন ছাড়াই এগিয়ে যাচ্ছে। আর উদ্যোক্তা তৈরিতে নারীর অপার সম্ভাবনা দৃষ্টিনন্দন। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তার ভূমিকায় নামতে তারা এখন সরকারী-বেসরকারী ঋণ সুবিধা পেতেও সমস্যায় পড়ছে না। ব্যবসায়িক ঝুঁকিতে নারীদের অনিচ্ছা এবং অস্বস্তি এখন আর সেভাবে কাজ করছে না। নিজের প্রবল ইচ্ছা আর অনন্য মনোশক্তিতে যে কোন ব্যবসায়িক কাজকর্মকে তারা সাবলীলভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আর তথ্যপ্রযুিক্তর আলোকিত ভুবনে দেশের নারীরা যেভাবে নিজেদের দক্ষতা ও পারদর্শিতা প্রদর্শন করে যাচ্ছে সেখানেও তাদের জোরালো ভূমিকা অনন্য বাংলাদেশ তৈরির মহাকর্মযজ্ঞ, যা অর্থনীতির সমৃদ্ধ খাতকে প্রতিনিয়ত এগিয়ে দিচ্ছে। রফতানি শিল্পে বাংলাদেশের নারীদের অংশগ্রহণ বিশ্বে নজরকাড়া। পোশাক শিল্প খাতে বাংলাদেশে রফতানি আয়ের সিংহভাগ অর্জিত হয়। পোশাক শিল্পে নারী শ্রমিকের সংখ্যাই বেশি- সেটা সবারই জানা। কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে ভূমির উৎপাদন ব্যবস্থায় নারীদের অংশগ্রহণ এক অপরিহার্য বিষয়। ধানের বীজ রোপা থেকে জমির পরিচর্যা ছাড়াও ফসল ঘরে তোলা পর্যন্ত নারীদের সমান অংশীদারিত্ব সত্যিই দেশের জন্য অপার সম্ভাবনা। প্রচলিত সমাজের স্বাভাবিক জীবন ধারায় নারীরা সব সময় নিরবচ্ছিন্ন গতিতে এগিয়ে যায় তাও কিন্তু নয়। পুরনো ঐতিহ্যিক সমাজ আধুনিক সময়কে সেভাবে অবারিত হতে দেয় না। বাধা, প্রতিবন্ধকতা সামলে নিয়ে নারীদের এগিয়ে চলা তাও এক কঠিন যাত্রাপথ। পুরনো সংস্কারের ভিত্তিকে অত সহজে নাড়ানো যায় না। তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ সম্প্রসারণে যান্ত্রিক সভ্যতাকে আয়ত্বে আনা গেলেও মানস সংস্কৃতিকে পাল্টানো তত সহজ নয়। কারণ দীর্ঘদিনের বিশ্বাস, মূল্যবোধ, জীবনাচরণ শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। তাকে ডিঙাতে গেলে অপেক্ষার অন্ত থাকে না। ততদিনে যা হওয়ার তাই ঘটে যায়। সমাজ সমস্যা কবলিত হয়, নারী নির্যাতন তার মাত্রাকে ছাড়ায় তার চেয়ে বেশি মানবিক মল্যবোধগুলোও বিপন্নতার আবর্তে পড়ে। আর সব কিছুর মাশুল গুনতে হয় পিছিয়ে পড়া নারীদের। ছেলেমেয়ের বৈষম্য শুরু হয় নিজেদের পরিবার থেকেই। বাবা-মাই পুত্র এবং কন্যা সন্তানের মধ্যে এক ব্যবধান তৈরি করে দেয়। এক সমীক্ষায় ওঠে আসে একজন কন্যা সন্তান প্রথম বৈষম্যের আবর্তে পড়ে বাবা- মায়ের কাছেই। ছেলেটি বড় হয় নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মহান লক্ষ্য নিয়ে। আর অবোধ বালিকাটি অপেক্ষায় থাকে কখন তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হবে। তেমন দৃষ্টিকটু অসম ব্যবস্থা এখন আর আগের মতো নেই। তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ সম্প্রসারণের যুগে মানস সংস্কৃতিও অনেকটাই পরিবর্তনমুখী। সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে গেলে প্রযুক্তির ব্যবহার যেমন অনিবার্য পাশাপাশি মানসিক চেতনাকেও এগিয়ে নেয়া অত্যন্ত জরুরী। তা না হলে আধুনিকতার সঙ্গে পুরনো জীর্ণ সংস্কারের দ্বন্দ্ব-বিরোধ সম্মুখ সমরে পরিণত হয়। সঙ্গত কারণে এখন মেয়েরা অনেকটা নিজেদের মতো করে তৈরি হতে পারছে। লেখাপড়া শিখে পছন্দমতো যে কোন পেশায় যুক্ত হতে একেবারে ভাবছেও না। ঝুঁকিপূর্ণ পোশাকেও মেনে নিতে খুব বেশি আপত্তি থাকছে না। সঙ্গত কারণে বাংলাদেশের মেয়েরা বৈচিত্র্যিক পেশায় এখন সাবলীলভাবে নিজেদের তৈরি করতে এগিয়ে যাচ্ছে। তার পরও বিপর্যয় পিছু ছাড়ছে না। এখনও পথ-ঘাটে, নির্জন স্থানে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা মেয়েদের সংখ্যা হাতেগোনার অবস্থায় নেই। নিরাপত্তার বেষ্টনীতে নিজেদের সর্বক্ষণ আগলে রাখাও কঠিন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও নারীদের হেয়প্র্রতিপন্ন করতে হরেক রকম জাল বিস্তার করা হয়। অসহায় এই নিরপরাধ মেয়েরা অতি সহজেই তেমন দুর্ভেদ্য জালে আটকে পড়ে। সর্বনাশের চরম পর্যায়ে নামতেও সময় লাগে না। এমন সব সামাজিক আবর্জনা এখনও নারীদের সামনে চলার পথকে কণ্টকাকীর্ণ করে রেখেছে। সেখান থেকে বের হয়ে আসতে সব মানুষের মানবিক ও মানসিক শুদ্ধতা অত্যন্ত দরকার। মানুষের মর্যাদায় নারী-পুরুষের বিভাজনের ওপর আঁচড় বসাতে হবে। শুধু নারী নয়, মানুষ হিসেবে তার প্রাপ্ত সম্মান তাকে দিতে হবে। সমাজের অর্ধাংশ হয়ে তারা পুরো সমাজ ব্যবস্থায় সেভাবে সম্পৃক্ত থাকে সেখানে সচেতন দায়বদ্ধতায় তাদের প্রাপ্য অধিকার দেয়াও অত্যন্ত জরুরী।
×