ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পন্ডিত বিরজু মহারাজ নৃত্যালোক ছেড়ে অনন্তলোকে

প্রকাশিত: ২২:০৩, ১৮ জানুয়ারি ২০২২

পন্ডিত বিরজু মহারাজ নৃত্যালোক ছেড়ে অনন্তলোকে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও শিল্প সৃজনে মত্ত ছিলেন। নৃত্যকে বেছে নিয়েছিলেন জীবনসঙ্গী হিসেবে। একাধারে নাচ, তবলা এবং কণ্ঠসঙ্গীতে ছিলেন সমান পারদর্শী। ছবিও আঁকতেন। বলতেন, হৃদয়ের কম্পনই তো নাচ! সেই হৃদস্পন্দন, সেই নাচ থেমে গেল চিরতরে। নৃত্যালোক ছেড়ে পাড়ি জমালেন অনন্তলোকে। উপমহাদেশের কিংবদন্তী নৃত্যগুরু বিরজু মহারাজ আর নেই। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, রবিবার রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চিরবিদায় নিয়েছেন কত্থকের এই মহারাজা। তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দিল্লীর বাড়িতে নাতির সঙ্গে খেলার সময় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন বিরজু মহারাজ। দ্রুত দিল্লীর সাকেত হাসপাতালে নেয়া হলেও বাঁচানো যায়নি। বেশ কিছুদিন ধরেই কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন পণ্ডিত বিরজু মহারাজ। এমনকি কিডনি ডায়ালাইসিসও করা হয়েছিল। তার নাতনি রাগিনি মহারাজ ভারতীয় সংবাদ সংস্থা এএনআইকে বলেছেন, গেল প্রায় এক মাস ধরেই তার চিকিৎসা চলছিল। গত রাতে সোয়া ১২টা থেকে সাড়ে ১২টার দিকে হঠাৎ শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন তিনি। এর ১০ মিনিটের মধ্যেই তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়, কিন্তু তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। উপমহাদেশের কত্থক কিংবদন্তি ঈশ্বরী প্রসাদের এ বংশধর জন্ম নেন ১৯৩৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। বাবা পতি অচ্ছন মহারাজের কাছে তেহাই আর টুকরা আবৃত্তি দিয়ে শুরু। মাত্র আট বছর বয়সেই নাচ, গান আর বাদনে তুখোড় হয়ে ওঠেন তিনি। নয় বছর বয়সে শিক্ষক বাবাকে হারিয়ে ছন্দপতন। নিরুপায় হয়ে ভিটেবাড়ি বিক্রি করতে হলেও সঙ্গীত আর নৃত্যসাধনা থেকে একচুল বিচ্যুত হননি দুঃখহরণ নাথ। শৈশবে এ নামেই পরিচিত ছিলেন বিরজু মহারাজ। কিশোর বয়সেই বিরজু হয়ে ওঠেন নৃত্যগুরু। প্রথমে সঙ্গীতভারতী, পরে ভারতীয় কলাকেন্দ্র, কত্থককেন্দ্র ও নিজের প্রতিষ্ঠিত কলাশ্রমে তালিম দিয়েছেন ৪৬ বছর বয়সে ‘পদ্মবিভূষণ’ পাওয়া এ কিংবদন্তী। নিজস্ব শিল্পরীতিতে বিশ্ব নৃত্যান্দোলনের মূল ধারায় নিজেকে অনন্য অবস্থানে নিয়ে যাওয়া বিরজু মহারাজ কত্থকের একাধিক বিন্যাসপর্ব নির্মাণ করেছেন। আন্দাজ, আমদ, ঠাঁট বা নিকাষ, গৎ, গৎভাও, বোলপরম ও ঠাঁট তার নৃত্যের এমন সুচারু, প্রাণবন্ত, উদ্দাম, গতিশীল উপস্থাপনা কত্থক নৃত্যে যোগ করেছে ভিন্ন যোজনা। কত্থকের কৌশল, ব্যাকরণিক বিন্যাস, উপস্থাপন রীতিতে তিনি যুক্ত করেছেন অভিনব রুচি ও নান্দনিক শৃঙ্খলা। ভারতীয় পুরাণ, ইতিহাস ও ঐতিহ্যনির্ভর ১৭টি নৃত্যনাট্য নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। ঠুমরি, দাদরা, ভজন, গজল গায়ক হিসেবেও কুড়িয়েছেন খ্যাতি। সেতার, সরোদ, বেহালা, সারেঙ্গি, তবলাসহ একাধিক যন্ত্রবাদনে তিনি পারদর্শী। তিনি একাধারে কবি, লেখক। ১৯৭৭ সালে সত্যজিৎ রায়ের ‘সতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ চলচ্চিত্রে দুটো নৃত্যের পরিচালক ছিলেন বিরজু মহারাজ। ‘দে আশকিয়া’, ‘দিল তো পাগল হ্যায়’, ‘গাদ্দার’, ‘দেবদাস’, ‘বাজিরাও মাস্তানি’র মতো ব্যবসাসফল চলচ্চিত্রের নৃত্যপরিচালকও তিনি। ‘বাজিরাও মাস্তানি’ চলচ্চিত্রের জন্য ২০১৬ সালে শ্রেষ্ঠ কোরিওগ্রাফার হিসেবে ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। পেয়েছেন সঙ্গীত ও নাটক আকাদেমি এ্যাওয়ার্ড, কালিদাস সম্মাননা, নৃত্যচূড়ামণি পুরস্কারসহ আরও অসংখ্য পদক ও পুরস্কার। বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, খাইরাগারাহ বিশ্ববিদ্যালয় তাকে দিয়েছে সম্মানসূচক ডিগ্রী। বাংলাদেশের জনপ্রিয় নৃত্যশিল্পী শিবলী মুহম্মদ, মুনমুন আহমেদ; এমনকি বলিউডের অনেক নামকরা অভিনেত্রীও এই নৃত্যগুরুর কাছে তালিম নিয়েছেন। শিল্পসাধনা ছিল বিরজু মহারাজের প্রথম ও শেষ আরাধনা, মঞ্চই ছিল তার মন্দির। নেচে নেচে বিশ্ব মাতানো এই কিংবদন্তী খ্যাতি মাড়িয়ে আটপৌরে জীবনাচরণকেই সঙ্গী করেছেন সবসময়। বিরজু মহারাজ ২০১৬ সালের ডিসেম্বরেও এসেছিলেন বাংলাদেশে, ছায়ানটে কত্থক নৃত্য উৎসবের মঞ্চে শুনিয়েছিলেন নিজের কর্মময় জীবনের গল্প, নাচ নিয়ে একান্ত ভাবনার কথা। তিনি বলেছিলেন, সারা দুনিয়াই নাচছে! এই দেখুন না, বাতাস নাচছে, চাঁদ নাচছে, পৃথিবী নাচছে, পাতা নাচে, ফুল নাচে। কৃষ্ণ বাঁশি বাঁজায়, শিব ডমরু বাঁজায়, নাচে তো বটেই। ভগবান আসলে আমাদের সবার মধ্যে কেমন এক অদ্ভুত ছন্দ দিয়েছেন। আমি বলি কি, হৃদয়ের কম্পনই তো নাচ। এই নাচ কেউ খুঁজে পায়, কেউ পায় না।
×