ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইনের খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন মন্ত্রিসভার

ইসি গঠনে আইন হচ্ছে ॥ সরকারের যুগান্তকারী পদক্ষেপ

প্রকাশিত: ২২:০০, ১৮ জানুয়ারি ২০২২

ইসি গঠনে আইন হচ্ছে ॥ সরকারের যুগান্তকারী পদক্ষেপ

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এই লক্ষ্যে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২’-এর খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠকে এ অনুমোদন দেয়া হয়। এছাড়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিকারে ‘বৈষম্যবিরোধী আইন, ২০২২’ এর খসড়ায়ও চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। পাশাপাশি করোনা সংক্রমণের বর্তমান পরিস্থিতি দুই তিনদিন পর্যবেক্ষণের পর স্বাস্থ্যবিধি মানাতে সরকার কঠোর অবস্থানে যাবে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব। এদিকে চলমান বিধি অনুযায়ী ইসি গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে প্রায় সকল রাজনৈতিক দলের সংলাপ শেষ হয়েছে। আগামী মাসেই সরকারকে নতুন ইসি গঠন করতে হবে। তাই স্বল্প সময়ে নতুন এই আইনের বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। গতকাল মন্ত্রিপরিষদ খসড়া আইনটিতে চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে। এর পর আইন মন্ত্রণালয়ে ভোটিংয়ের পর অনুমোদনের জন্য এটি জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হবে। সেখানে পাস হলে এটি পূর্ণাঙ্গ আইনে রূপ পাবে। এর পর এটি বাস্তবায়নের জন্য বিধি করার প্রয়োজন পড়বে। বিধি করাটা কিছুটা সময়সাপেক্ষ বিষয়। সে ক্ষেত্রে এবারের নির্বাচন কমিশন গঠন হবে চলমান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। আইনটা করার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠেছিল। বিভিন্ন মহলের দাবি এবং সরকারের সদিচ্ছার কারণে যুগান্তকারী এই আইনটি মন্ত্রিপরিষদে অনুমোদন পেল। বৈঠক শেষে সচিবালয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম খসড়া আইনটি অনুমোদনের কথা জানান। খসড়া আইন অনুযায়ী, প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিতে একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হবে বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব। সংবিধান অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশন গঠনের দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির। সংবিধানে এ বিষয়ে আইন করার কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু কোন সরকারই আইন করেনি। এতদিন রাষ্ট্রপতি সরাসরি নির্বাচন কমিশন গঠন করে দিতেন। রাষ্ট্রপতি বিগত দুটি কমিশন গঠন করেছেন সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে সাচিবিক দায়িত্ব পালন করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘সংবিধানের ১১৮(১)-এ বিধান আছে, রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দিতে পারেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এই আইনটি নিয়ে আসা হয়েছে। খুব বেশি বড় আইন না এটি। এ জাতীয় আইন যেহেতু আমরা নিয়ন্ত্রণ করে আসছি, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন আছে। মোটামুটি সেই অনুযায়ী এটা করা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ দিতে একটা অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হবে। অন্যান্য আইনে যেভাবে আছে ঠিক সেভাবেই। একটি অনুসন্ধান কমিটিও করা হবে, সেটাও রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিয়ে। অনুসন্ধান কমিটি যোগ্য প্রার্থীদের নাম সুপারিশ করবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার কারা হতে পারবেন আর কারা হতে পারবেন না তা খসড়া আইনে উল্লেখ করা হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, যোগ্যতার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, তাকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে। বয়স কমপক্ষে ৫০ বছর হতে হবে। কোন গুরুত্বপূর্ণ সরকারী, আধা-সরকারী বা বেসরকারী বা বিচার বিভাগীয় পদে কমপক্ষে ২০ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। তাহলেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা নির্বাচন কমিশনার হতে পারবেন। খসড়া আইনে অযোগ্যতার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, আদালতের মাধ্যমে যদি কেউ অপ্রকৃতস্থ হিসেবে ঘোষিত হন, দেউলিয়া ঘোষণার পর দেউলিয়া অবস্থা থেকে মুক্ত না হন, অন্য কোন দেশের নাগরিকত্ব অর্জন করেন বা কোন বিদেশী রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন, নৈতিক স্খলন এবং সেক্ষেত্রে যদি ফৌজদারি অপরাধে কমপক্ষে দু’বছর কারাদ-ে দ-িত হন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে দ-িত হলে, রাষ্ট্রীয় পদে থাকলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনার হতে পারবেন না। আগামী নির্বাচন কমিশন কী এই আইনের অধীনে হবে- জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, যদি এর মধ্যে হয়ে যায় তাহলে হবে। আজকে অনুমোদন দেয়া হলো, হয়তো কাল-পরশু দুদিন লাগবে আইন মন্ত্রণালয়ের। তারপর যদি তারা সংসদে পাঠান, সংসদেও তো কয়েকদিন লাগবে। স্ট্যান্ডিং কমিটিতে যাবে, তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন। হয়তো হয়ে যাবে, অসুবিধা তো নেই। আমরা আশা করছি, আইনটি চূড়ান্ত করতে খুব বেশি সময় লাগবে না। আইনের অধীনে বিস্তারিত উল্লেখ করে একটি বিধি করে দেয়া হবে জানিয়ে তিনি বলেন, যাতে প্রক্রিয়াগত বিষয়ে বার বার আইন সংশোধন করতে না হয়। তিনি বলেন, আরেকটা জিনিস হলো এর আগে যেসব নির্বাচন কমিশন হয়েছে সেগুলোকে হেফাজত দেয়া হয়েছে এই আইনে। যেহেতু এর আগে আইন ছিল না, রাষ্ট্রপতি যেসব নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন, তা এই আইনের অধীনে করেছেন বলে ধরে সেগুলোকে হেফাজত করা হয়েছে। আইন ভাঙলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের অপসারণ কিভাবে হবে- জানতে চাইলে খন্দকার আনোয়ারুল বলেন, আমার তো যতদূর মনে পড়ে, যেভাবে সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিরা অপসারণ হন, একই পদ্ধতি প্রযোজ্য হবে। বাকিগুলো হয়তো বিধিতে উল্লেখ করে দেয়া হবে। অনুসন্ধান কমিটির বিষয়ে আইনে কী বলা হয়েছে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, অনুসন্ধান কমিটিতে এক নম্বরে থাকবেন প্রধান বিচারপতি মনোনীত সুপ্রিমকোর্টের আপীল বিভাগের একজন বিচারপতি, তিনি কমিটির চেয়ারম্যান হবেন। এরপর থাকবেন প্রধান বিচারপতি মনোনীত সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক, কম্পট্রলার এ্যান্ড অডিটর জেনারেল, পিএসসির চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রপতি মনোনীত দু’জন বিশিষ্ট নাগরিক। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা দেবে। অনুসন্ধান কমিটি ৬ সদস্যবিশিষ্ট। কিন্তু আগের অনুসন্ধান কমিটিগুলো ছিল বেজোড় সংখ্যার, যা মতামতের ক্ষেত্রে সুবিধাজনক- এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, এটা আমরা আইন মন্ত্রণালয়কে বলব- কমিটির সদস্য সংখ্যা জোড় রাখা হবে, নাকি বেজোড় রাখলে সুবিধা হবে। কোন বিষয়ে মত দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনজন তিনজন হলে তো সমস্যা হয়ে যাবে। স্বাস্থ্যবিধি মানাতে কঠোর অবস্থানে যাবে সরকার ॥ করোনা সংক্রমণের বর্তমান পরিস্থিতি দু-তিনদিন পর্যবেক্ষণের পর স্বাস্থ্যবিধি মানাতে সরকার কঠোর অবস্থানে যাবে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব। তিনি বলেন, করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে ১১ জানুয়ারি থেকে বিধিনিষেধ দেয়া হয়েছে। কিন্তু মানুষ তা মানছে না। প্রশাসনের অবস্থানও কঠোর নয়। সংক্রমণ প্রতিদিনই বাড়ছে- এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, আমরা এরই মধ্যে বলে দিয়েছি, দু-তিনদিন একটু পর্যবেক্ষণ করব, তারপর কিছু কিছু ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থানে যাব। আমরা প্রথম থেকেই কঠোর হতে চাই না। আগে একটু দেখতে চাচ্ছি, মানুষ মানে কি না। এরই মধ্যে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তদারকি করতে বলছি। তারপর আমরা কাল-পরশুর মধ্যে পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনে কঠোর হব। তিনি বলেন, বর্তমান সংক্রমণকে আমরা কিন্তু ওমিক্রন মনে করছি। তবে আমাদের কিন্তু ৮০ ভাগের বেশি ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। আমরা সবাইকে বিশেষভাবে অনুরোধ জানাব, তারা যেন একটু সচেষ্ট হন। সর্বশেষ পর্যবেক্ষণ করেছে আইইডিসিআর, সেটাতে ৮৭ শতাংশ ছিল ডেল্টা আর ১৩ শতাংশ ছিল ওমিক্রন। এখন হয়তো ওমিক্রন একটু বেড়ে ১৮ থেকে ২০ শতাংশে এসেছে। একটা বড় প্রশ্ন কিন্তু ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। সতর্ক যদি না থাকি তাহলে কিন্তু একটা ডিজাস্টার সামনে। ইতোমধ্যে সংক্রমণ ১৭ শতাংশের বেশি হয়ে গেছে। আগেরবার কিন্তু এক মাসে গিয়ে ৩০ শতাংশ হয়েছে। এখন ১৫ দিনে ১৮ শতাংশ হয়ে গেছে। সচেতন ও সতর্ক না হলে এবং মাস্ক না পরলে কোনভাবেই এটা ঠেকানো সম্ভব না। এটা মানুষকে বুঝতে হবে। নতুন কোন বিধিনিষেধ দেওয়া হবে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেখি। আমরা আগে একটু কঠোর হয়ে দেখি কি অবস্থা দাঁড়ায়। পরিস্থিতি বুঝে পরে ব্যবস্থা নেয়া হবে। বৈষম্যবিরোধী আইন অনুমোদন পেল মন্ত্রিসভায় ॥ মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিকারে ‘বৈষম্যবিরোধী আইন, ২০২২ এর খসড়ায়ও চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। বৈঠক শেষে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, অনেক আন্তর্জাতিক কনভেনশনের মাধ্যমে সারা বিশ্বে সব রকমের বৈষম্য নিরসন করা হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বৈষম্য দূরীকরণের বিষয়গুলো সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করে দেয়া হয়েছে। সেই আলোকে এই আইন নিয়ে আসা হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, আইনের আলোকে একটি মনিটরিং কমিটি গঠন করা হবে। কমিটি বিভিন্ন পর্যায়ে যেমন- জাতীয়, বিভাগীয় এবং জেলা বা যে পর্যায় পর্যন্ত সরকার চায়। তারা মনিটর করবে হিউম্যান রাইটসের কোন ভায়োলেশন (মানবাধিকার লঙ্ঘন) হচ্ছে কিনা। এখানে একজন সভাপতি থাকবেন। আইনমন্ত্রী কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করবেন এবং লেজিসলেটিং বিভাগের একজন যুগ্মসচিব সেটার সদস্য সচিব হবেন। এভাবে নিচের দিকে যতগুলো প্রশাসনিক ইউনিট আছে সেখানে সরকার যে রকম প্রয়োজন মনে করবে সে রকম কমিটি করে দেবে। বিভিন্ন সময়ে সভাপতি সময় নির্দিষ্ট করে মনিটরিং মিটিং করবেন। বৈষম্যবিরোধী একটা সেল গঠন করা হবে। যে সেল বৈষম্যবিরোধী কার্যাবলী প্রতিরোধ এবং তাৎক্ষণিক প্রতিকার দেয়ার জন্য বৈষম্যবিরোধী জাতীয়, বিভাগীয়, জেলা কমিটিসহ অন্যান্য কমিটি গঠন করবে। জনগণের মধ্যে একটা সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে যে, কোনভাবেই কোন রকমের বৈষম্য করা যাবে না। তিনি আরও বলেন, যদি কেউ কোন অভিযোগ দায়ের করে তাহলে ৩০ দিনের মধ্যে জেলা কমিটি ঘটনা তদন্ত করবে। জেলা কমিটি প্রতিকার দিতে ব্যর্থ হলে অভিযোগকারী বিভাগীয় কমিটির কাছে অভিযোগ দায়েরের ৩০ দিনের মধ্যে তদন্ত করবে। বিভাগীয় কমিটি ব্যর্থ হলে ৪৫ দিন পরে জাতীয় কমিটি তদন্ত করে এ্যাকশন নেবে। সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি উপযুক্ত আদালতে মামলা দায়ের করলে ৯০ দিনের মধ্যে মামলা ডিসপোজাল করতে হবে। যদি ৯০ দিনের মধ্যে না পারে তাহলে সর্বোচ্চ ১৫ দিন বৃদ্ধি করে সেই মামলা শেষ করে দিতে হবে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, আইনে একটি বিধি করার কথা বলা হয়েছে। সেই বিধি অনুযায়ী বৈষম্যের বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করা হবে।
×