ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষার্থীদের টিকা

প্রকাশিত: ২১:১০, ১৮ জানুয়ারি ২০২২

শিক্ষার্থীদের টিকা

করোনার নৃশংস ছোবলে বাংলাদেশের উন্নয়নের নানা সূচক থমকে দাঁড়ায়। সবচেয়ে বিপর্যস্ত অবস্থার সম্মুখীন হয় জাতির মেরুদন্ড শিক্ষা কার্যক্রম। ২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকে শুরু হওয়া এই সংক্রমণ এখনও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ২০২০ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের মাহেন্দ্রক্ষণে সবার আগে বন্ধ করে দেয়া হয় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম। ২০২০ সালে শুধু মাধ্যমিক বোর্ড পরীক্ষা নিতে পারাটাও ছিল সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের জন্য এক সুবর্ণ সুযোগ। পরবর্তী দেড় বছরে আর কোন পরীক্ষা অনুষ্ঠিত করা সম্ভবই হয়নি। সর্বশেষ বিশ্ববিদ্যালয় অনুপ্রবেশের প্রাতিষ্ঠানিক মান যাচাইও অবরুদ্ধতার জালে আটকে থাকে। তবে বাংলাদেশের জলবায়ু, ভৌগোলিক অবস্থান, প্রাকৃতিক পরিবেশ-পরিস্থিতি মিলিয়ে করোনার সংক্রমণ বিশ্বের অন্যান্য স্থান থেকে আলাদা মাত্রায় দৃশ্যমান হতে থাকে। যেমন শীতপ্রধান অঞ্চল ইউরোপ-আমেরিকায় করোনার প্রকোপ মাথাচাড়া দেয় মূলত হিমেল ঠান্ডা বরফাচ্ছাদিত দেশগুলোতে। আর আমরা নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় শীতকালেই করোনা থেকে অপেক্ষাকৃত দূরে থেকেছি। এবার ২০২২ সাল দেখার অপেক্ষায়। করোনা শনাক্ত ও মৃত্যুর হার ইতোমধ্যে উর্ধগামী হতে শুরু করেছে। এখন জানুয়ারির মধ্যভাগ। শীতও তেমন জেঁকে বসেনি। ঠান্ডার আমেজ, শীতল বাতাস একেবারে নেই তাও বলা যাচ্ছে না। করোনার নতুন সংক্রমণ যেভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে তাতে বোধ হয় মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না। যাই হোক সঙ্কটের আবর্তে পড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তার গতি ফিরে পাওয়ার সময়ে করোনার তৃতীয় ঢেউ মাথাচাড়া দেয়ার চেষ্টা করছে। এটি মোটেও শুভ সঙ্কেত নয়। ১২ সেপ্টেম্বর স্কুল-কলেজ খুলে দেয়ার মাত্র চার মাস অতিবাহিত হতে না হতেই করোনা সংক্রমণ আবারও বাড়তে শুরু করেছে। এই পরিস্থিতি কিভাবে মোকাবেলা করতে হবে তাও বিবেচনাধীন। তবে আশার কথা হলো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার পরপরই ১২-১৮ বছরের শিক্ষার্থীদের টিকা কার্যক্রমের আওতায় আনা হচ্ছে। করোনা দুর্যোগের মধ্যেও বর্তমান সরকারের অনেক সফলতা রয়েছে। অর্থনীতির চাকা সচল রাখা, অবকাঠামো উন্নয়নের গতি চালু রাখা এবং সারাদেশের টিকা কর্মসূচী সম্প্রসারিত করা সরকারপ্রধানের মহৎ ও ব্যাপক মহাপ্রকল্প। এক সময় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের বয়স বিবেচনায় পিছিয়ে রাখা হলেও ১ নবেম্বর থেকে তাদের টিকার আওতায় আনার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। তবে খুলে যাওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করার পক্ষে নয় সরকারসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। উদীয়মান প্রজন্মকে বিন্দুমাত্র ঝুঁকির আবর্তেও ফেলা যাবে না। শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠানে যাবে পুরোপুরি স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো সকলকে টিকাদান কর্মপ্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা। তাও আবার ৩১ জানুয়ারির মধ্যে। সোয়া কোটি শিক্ষার্থীর মধ্যে ৬০ লাখ শিশু-কিশোর এখনও ভ্যাকসিন দিতে পারেনি। বাকি ৫৫ লাখ ছাত্র-ছাত্রী এর আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। আর মাত্র ১০/১৫ দিনের মধ্যে কিভাবে বাকিদের টিকা দেয়া সম্ভব হবে সেটাও আলোচনার মধ্যেই থেকে যাচ্ছে। কারণ গত আড়াই মাসে অর্ধেকেরও কম শিক্ষার্থী টিকা নিতে পেরেছে। তাও আবার প্রথম ডোজ। বাকিরা অল্প দিনের মধ্যে কিভাবে পারবে তা বলা যাচ্ছে না। তবে সরকার শিক্ষার্থীদের টিকা প্রদান কর্মসূচীকে আরও অবারিত করতে ইতোমধ্যে কিছু পদক্ষেপও নিয়েছে। সেখানেও হরেকরকম বিপত্তি সংশ্লিষ্ট অভিভাবকদের চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে। যেমন টিকা কেন্দ্রগুলোতে এখন মাত্রাতিরিক্ত ভিড়। সঙ্গত কারণে পরিবেশ পরিস্থিতি সংক্রমণের মাত্রায় বিপজ্জনক হয়ে ওঠা অস্বাভাবিক কিছু নয়। টিকা প্রদান কার্যক্রমের জেলাভিত্তিক তারতম্যও এক প্রকার অশনি সঙ্কেত। এখনও সব জেলায় সমানভাবে শিক্ষার্থীরা টিকার আওতায় আসছে না। শুধু তাই নয়, একসঙ্গে সব জেলায় টিকা প্রদান শুরুও সম্ভব হয়নি। প্রথম থেকে টিকার জন্য যে শর্ত জুড়ে দেয়া হয় বর্তমানে তা শিথিলও করা হয়েছে। বাবা-মায়ের জন্মনিবন্ধন সনদ এবং মুঠোফোনের বার্তা ছাড়া পরিচয়পত্রই হবে টিকা নেয়ার মূল বিধি। শর্ত শিথিল সাপেক্ষে ভিড় বাড়ছে অত্যধিক, যা করোনা সংক্রমণকে বাড়িয়ে দিতে যথেষ্ট। যেখানে সামাজিক দূরত্ব কিংবা স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিধিনিষেধ মানা সম্ভবই নয়। তারপরও সময়ই বলে দেবে টিকা দেয়া কতখানি সম্ভবপর হবে। নাকি পুনরায় জীবন ও স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দেয়া যাবে। সরকার মোটেও চাচ্ছে না এই মুহূর্তে আবারও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর অবরুদ্ধতার জাল বিস্তৃত হোক। আবার সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা ভাবছেন ক্ষুদে প্রজন্মকে স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে ফেলাটাও বিবেচনার কাজ হবে না। তবে বলা হচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা শিশু-কিশোরদের টিকা নিয়ে নির্দিষ্ট কোন নির্দেশনা দেয়নি। তাই নিয়মিত ক্লাস চালু রাখতেও কোন সমস্যা না হওয়ারই সম্ভাবনা। শিক্ষার্থীদের প্রাতিষ্ঠানিক পাঠক্রম বন্ধ না করতে টিকাদান কর্মসূচী আরও অবারিত, নিরপেক্ষ এবং সর্বজনীন করা জরুরী বলে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। নতুন ভ্যারিয়েন্ট যেভাবে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে তাতে অভিভাবকরাও স্বস্তিতে নেই। সন্তানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাতে তাদের অনেকেরই অনীহা প্রকাশ পাচ্ছে। তবে সংক্রমণ বাড়তে থাকলে বিধিনিষেধও ক্রমান্বয়ে বাড়ানো হবে। কিন্তু তা লকডাউন পর্যায়ে যাবে কিনা সেটা নির্ধারণ করা এখনই সম্ভব নয় বলে সরকার থেকে বলা হয়েছে। তবে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মানাকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। এর অন্যথা হলে জেল-জরিমানার বিষয়টিও উঠে আসছে। তবে শাস্তি প্রদান করে কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে জনগণের মধ্যে চাপানো যায় না। ভেতরের অন্তর্নিহিত বোধ থেকে সবাইকে এই মুহূর্তে স্বাস্থ্যবিধি মানা সবচেয়ে জরুরী। রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষার্থীদের টিকা দেয়ার লাইনের সারি হতবাক করার মতোই। কেন্দ্রের বাইরে থেকে এমন লাইন শুরু করা হয়। আর ভেতরেও আছে লম্বা লাইনের সারি। নিয়ম-শৃ্ঙ্খৃলা ও বিধিবহির্ভূত গা ঘেঁষে দাঁড়ানোয় ওমিক্রণ সংক্রমণের শঙ্কা বাড়ছে। শিক্ষার্থীদের বাবা-মায়েরাও যে সুশৃঙ্খলভাবে নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছেন তা কিন্তু নয়। তারাও সন্তানদের সঙ্গে ভেতরে ঢুকে উপচেপড়া ভিড়কে বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছেন, যা কোনভাবেই কাক্সিক্ষত নয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, প্রথম দিকে তেমন কোন ভিড় ছিল না। প্রত্যেকে সুষ্ঠু ও সুরক্ষিতভাবে টিকা নিতে পেরেছে। নিয়ম-শৃঙ্খলারও ব্যত্যয় ঘটেনি। যতই দিন যাচ্ছে ভিড়ের চাপ ততই মাত্রা ছড়াচ্ছে। সব টিকা কেন্দ্রে বসার এবং বিশ্রামের জায়গা নির্ধারিত আছে। কিন্তু সিংহভাগই কিছু মানছে না। করোনা সংক্রমণের প্রবল দাপটে সারাবিশ্ব হিমশিম খাচ্ছে। পশ্চিমা দেশগুলো ইতোমধ্যে ভয়ানক ছোঁয়াচে রোগটি মোকাবেলা করতে হিমশিম খাচ্ছে। করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন তার বিধ্বংসী থাবায় বিশ্ববাসীকে নাজেহাল করে ছাড়ছে। তবে এবার সংক্রমণ অত্যধিক হলেও মৃত্যু অন্যবারের চেয়ে কম। যদিও এত অল্প সময়ে কোন কিছু প্রমাণ করা যায়নি। এটি মূলত অনুমান বা ধারণা। সময় যত যাবে বাস্তব প্রেক্ষাপট ততই স্পষ্ট হবে। আর তখনই নিশ্চিতভাবেই বলা যাবে কি মাত্রায় সংক্রমণ, মৃত্যু কতখানি বিচলিত হওয়ার মতো। বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশে যতদিন সম্ভব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সেজন্যই টিকা গ্রহণ কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করা হয়েছে। নানা বিপত্তি সত্ত্বেও প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে সরকারের পক্ষ থেকে- তেমন অনুমানই পাওয়া যাচ্ছে সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভিমতে। বহুল সংক্রমণ করোনা থেকে কবে নিস্তার মিলবে তেমন আলামত উঠে আসলেও সব যেন অনিশ্চয়তার কবলে। ধারণা দেয়া হচ্ছে, ওমিক্রনই করোনার সবশেষ ভ্যারিয়েন্ট। ইতোমধ্যে করোনার লাগাতার সংক্রমণে দেশের ভাবী প্রজন্মের যে সমূহ ক্ষতি হয়েছে তার থেকে ঘুরে দাঁড়ানোও এক বড় চ্যালেঞ্জ। সব ক্ষতি পোষানো না গেলেও শিক্ষা কার্যক্রমের সময় নষ্ট এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে ভাবা উচিত। লেখক : সাংবাদিক
×