ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মিহির কান্তি মজুমদার

ওমিক্রনে কোথায় আশার আলো

প্রকাশিত: ২২:৫২, ১৭ জানুয়ারি ২০২২

ওমিক্রনে কোথায় আশার আলো

করোনাভাইরাস সৃষ্ট কোভিড-১৯ নামের বৈশ্বিক মহামারীতে ইতোমধ্যে সারাবিশ্বে ৫৫ লাখের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। আক্রান্ত হয়েছে ৩২ কোটির বেশি। মৃত্যুর মিছিলের পাশাপাশি জনজীবন ও জীবিকা হয়েছে অচল। মারণঘাতী এ ভাইরাসের মধ্যে আশার আলো থাকে কি করে? থাকে এজন্য যে, কোন মহামারী দীর্ঘকাল ধরে থাকে না। ইতোমধ্যে জৈব প্রযুক্তিসহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি হয়েছে ব্যাপক। চতুর্দশ শতকে ‘ব্ল্যাক ডেথ’ নামে পরিচিত বৈশ্বিক মহামারী ‘বিউবোনিক প্লেগ’ প্রায় ২০ কোটি মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছিল। ইউরোপের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ থেকে অর্ধেকের মৃত্যুর জন্য দায়ী এ মহামারীর বিস্তারকাল ছিল ৭ বছর (১৩৪৬ থেকে ১৩৫২)। বিংশ শতাব্দীর বৈশ্বিক মহামারী ‘স্পেনিশ ফ্লু’তে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫০ কোটি। মৃত্যুর সংখ্যা ৫ কোটির বেশি। এ মহামারীর স্থায়িত্বকাল ছিল মাত্র ৩ বছর (১৯১৮-১৯২০)। টিকা এবং ওষুধ আবিষ্কার না হলেও বিউবোনিক প্লেগ বা স্পেনিশ ফ্লু মহামারী টিকে থাকতে পারেনি। ব্যাপক সংক্রমণের কারণে জনগণের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি (ঐবৎফ ওসসঁহরঃু) টিকতে দেয়নি মহামারীকে। ‘বিউবোনিক প্লেগ’ রোগের ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী টিকা তৈরি হয়েছে মহামারীর ৫৫০ বছর পরে ১৮৯৭ সালে, আর ‘স্পেনিশ ফ্লু’ সংশ্লিষ্ট ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের টিকা তৈরি হয়েছে ১৯৩৮ সালে। অর্থাৎ, মহামারী শেষ হবার ২০ বছর পরে। কোন মহামারী চলাকালে সে রোগের টিকা ও নিরাময়ের ওষুধ আবিষ্কারের নজির কোনকালেই ছিল না। কিন্তু এ মহামারীর টিকা ও ওষুধ দুটোই আবিষ্কার হয়েছে মহামারী চলাকালে, তাও আবার মহামারীর এক বছরের মধ্যে। জৈব প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতি এবং টিকা উদ্ভাবনের পরিবর্তিত কৌশল সবকিছু বদলে দিয়েছে। কাজেই এ উন্নয়নের যুগে বৈশ্বিক মহামারী আরও দীর্ঘ সময় তা-ব চালাবে তা ধরে নেয়ার কারণ নেই। অবশ্য ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ক্ষমতা অনেকগুণ বেশি। ভ্যাকসিন গ্রহণকারীর শরীরের এ্যান্টিবডি বা আগে করোনার অন্য ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে সৃষ্ট এ্যান্টিবডি এড়িয়ে ওমিক্রনের পুনরায় দ্রুত সংক্রমণ করার ক্ষমতা আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এজন্য ওমিক্রনকে ‘উদ্বেগজনক ভ্যারিয়েন্ট (ঠধৎরধহঃ ড়ভ ঈড়হপবৎহ)’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। ভাইরাস পূর্ণাঙ্গ প্রাণ নয় বলে জীবজগত ও উদ্ভিদ জগতের প্রচলিত বংশ বিস্তার পদ্ধতি অনুসরণে কোন ভাইরাস বংশ বিস্তার করতে পারে না। সংশ্লিষ্ট প্রাণের দেহকোষে সংযুক্ত হয়ে দ্রুত গতিতে প্রতিলিপি তৈরি করেই বংশ বিস্তার করে। প্রতিলিপি তৈরির সময় প্রতিনিয়ত ভাইরাস অবয়বে পরিবর্তন ঘটায়। একে বলা হয় মিউটেশন। যেসব মিউটেশনে মূল ভাইরাসের আলাদা বৈশিষ্ট্য তৈরি হয় এবং বংশ বৃদ্ধি করে তাকে টিকে থাকতে সাহায্য করে, তাকে ওই ভাইরাসের ভ্যারিয়েন্ট বলা হয়। করোনা প্রজাতির বর্তমান সার্স কভ-২ ভাইরাসেরও মিউটেশন হয়েছে হাজার হাজার। কিন্তু টিকে থাকার ক্ষমতা থাকায় ভ্যারিয়েন্ট হিসেবে নাম দেয়া হয়েছে মাত্র ১২টির। ওমিক্রন এর মধ্যে সর্বশেষ সংযোজন। সংক্রমণের উচ্চহারের কারণে খুব দ্রুতই ওমিক্রন উদ্বেগজনক ভ্যারিয়েন্ট হিসেবে নাম পেয়েছে। সংক্রমণ ক্ষমতা, তীব্রতা ও মারণঘাতী বিবেচনায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনার বর্তমান প্রজাতির ৪টি ভ্যারিয়েন্টকে ‘উদ্বেগজনক ভ্যারিয়েন্ট’ ঘোষণা করেছে। এগুলো হচ্ছে- বেটা (প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকায় শনাক্তকৃত), গামা (ব্রাজিলে শনাক্তকৃত), ডেল্টা (ভারতে শনাক্তকৃত) এবং ওমিক্রন (দক্ষিণ আফ্রিকায় শনাক্তকৃত)। মিক্রনের গায়ের স্পাইক বা কাঁটায় মিউটেশনের সংখ্যা অনেক এবং এসব স্পাইকের প্রয়োজনে আঁকাবাঁকা হয়ে দেহকোষে সংক্রমণ করার ক্ষমতাও অনেক বেশি। হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাসতন্ত্রে প্রথম ২৪ ঘণ্টায় ওমিক্রন ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে ৭০ গুণ বেশি বংশ বিস্তার বা প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে। দেহকোষে অনুপ্রবেশের পরে কোভিড-১৯ রোগ সৃষ্টিতে এ ভ্যারিয়েন্টের সুপ্তিকাল অনেক কম, গড়ে মাত্র ০৩ দিন। অর্থাৎ, সংক্রমণের ৩ দিনের মধ্যে কোভিড রোগের উপসর্গ তৈরি করতে পারে। এ ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত ব্যক্তির উপসর্গ খুব কম। সর্দি, শুকনা কাশি, মাথাব্যথা এবং কোন কোন ক্ষেত্রে একটু গায়ে ব্যথা বা মাথাধরা, যেগুলো সাধারণ সর্দি জ্বরেও হয়। গন্ধ না পাওয়া বা স্বাদ না পাওয়া এসব ভিন্ন মাত্রার উপসর্গ নেই। লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের গবেষকগণের মতে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে ওমিক্রনের পুনঃসংক্রমণের ক্ষমতা ৫.৪ গুণ বেশি। সংক্রমণের গতি-প্রকৃতি এবং এ্যান্টিবডি এড়িয়ে পুনঃসংক্রমণ ক্ষমতা অত্যন্ত বেশি হওয়ায় ওমিক্রনে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে ঝড়ের গতিতে। নবেম্বর/২০২১-এর প্রথম দিকে দক্ষিণ আফ্রিকায় ওমিক্রনের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। তীব্র ঝড়ের গতির সংক্রমণের কারণে সে দেশে ১৫ নবেম্বরের মধ্যে সংক্রমণের ২২% এবং ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে সংক্রমণের ১০০% দখল করে। মাত্র এক মাসের মধ্যে মারণঘাতী ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট হয়েছে দেশছাড়া। উন্নত দেশসমূহেও ওমিক্রনের সংক্রমণ ঘটেছে দ্রুত গতিতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১ ডিসেম্বর/২০২১ তারিখে প্রথম ওমিক্রন সংক্রমণ শনাক্ত হয়। সেই ডিসেম্বরের মধ্যেই ওই দেশে ৫৯% সংক্রমণের জন্য দায়ী ওমিক্রন। গত ৩ জানুয়ারি সে দেশে ১০.৩০ লাখ এবং ১০ জানুয়ারি ১৩ লাখ করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। ১ দিনে এত সংক্রমণ কোন মহামারীতে কোনকালে কোন দেশে ঘটেনি। কিন্তু দ্রুত সংক্রমণ ক্ষমতা থাকায় ওমিক্রন সে ঘটনাই ঘটিয়েছে। ইতালি, স্পেন, পর্তুগাল, জার্মানি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্য, ডেনমার্কসহ ইউরোপের অধিকাংশ দেশে সংক্রমণের সংখ্যা বাড়ছে ঝড়ের গতিতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের এসব দেশে টিকা গ্রহণকারী মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। কিন্তু তারা মোটেও ছাড় পায়নি। ছাড় পায়নি তরুণ প্রজন্মও। ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের এ ঝড়ের গতির সংক্রমণে তাহলে আশার আলো কোথায়? ওমিক্রন সংক্রমণের শুরুর দেশ দক্ষিণ আফ্রিকায় ১০০% সংক্রমণ ওমিক্রনের দখলে। অত্যন্ত মারণঘাতী ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সেখানে জায়গা হারিয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার হেলথ রিসার্চ ইনস্টিটিউট এক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ওমিক্রন কম মারণঘাতী এবং ওমিক্রনে আক্রান্ত রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সংখ্যা অনেক কম। এছাড়াও ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় ওমিক্রনে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে মারাত্মক জটিলতায় ভোগার আশঙ্কা ৭০%-এর কম। ডেল্টা ও অন্য ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত রোগীদের চেয়ে ওমিক্রনে আক্রান্ত রোগীদের হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজনীয়তা ৮০% কম বলেও উল্লেখ আছে প্রতিবেদনে। এ মারাত্মক সংক্রমণ ক্ষমতার দাপট নিয়ে ওমিক্রন আমাদের দোরগোড়ায়। ইতোমধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকায় খেলতে যাওয়া ক্রিকেটারের মাধ্যমে ওমিক্রন অনুপ্রবেশ করেছে এ দেশে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে তান্ডব সৃষ্টি করে তৃতীয় ঢেউ সৃষ্টি করেছে। ভারতে একদিনে শনাক্ত ২ লাখ ছাড়িয়েছে। দিল্লীর স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যমতে দিল্লীতে সংক্রমণের ৮৪% ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট দখল করেছে। আমরাও ওমিক্রন সংক্রমণের একটা বড় ঢেউয়ের মধ্যে ঢুকে গেছি এবং আতঙ্কে আছি। সংক্রমণ বাড়ছে লাগামছাড়া গতিতে। সংক্রমণের এ লাগামছাড়া গতি ও আতঙ্কের মধ্যে আশার আলো হচ্ছে- ওমিক্রন সংক্রমণের ঝড়ে মারণঘাতী ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট অতি দ্রুত জায়গা হারাচ্ছে। ব্যাপক সংক্রমণের কারণে সংক্রমিত মানুষের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা (ঐবৎফ ওসসঁহরঃু) তৈরি হচ্ছে। দেশে টিকা প্রদানের কার্যক্রম সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং বুস্টার ডোজ দেয়া শুরু হয়েছে। ওমিক্রন আক্রান্তদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এবং রোগের তীব্রতা সৃষ্টির আশঙ্কা অনেক কম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ (ফুড এ্যান্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন) করোনাভাইরাস প্রতিরোধী কয়েকটি ওষুধের অনুমোদন দিয়েছে। বাংলাদেশও এ ওষুধ উৎপাদন শুরু করেছে। ইতোমধ্যে এ বৈশ্বিক মহামারীর ২ বছর পূর্ণ হয়েছে। দিগন্তে এটাই আশার আলো প্রজ্বলিত করছে। কাজেই এ বৈশ্বিক মহামারী সাধারণ সর্দি-জ্বরের মতো কম মারণঘাতী আঞ্চলিক (বহফবসরপ) রোগ হিসেবে রূপান্তরে খুব বেশি সময় হয়ত লাগবে না। কিন্তু ততদিনে নিরাপদ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, সঠিকভাবে মাস্ক ব্যবহার করা, ঘনঘন সাবান পানিতে হাত ধোয়া এবং সংক্রমণ প্রতিরোধী অন্যান্য ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। পিসিআর ও জেনম সিকোয়েন্সিং পরীক্ষার সংখ্যা বৃদ্ধি এবং নিয়মিত পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম সম্প্রসারণ করতে হবে। সর্বোপরি ভবিষ্যতের প্রয়োজনে আমাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা ব্যবস্থাকে আরও গতিশীল করার কথা বিবেচনায় আনতে হবে। লেখক : সাবেক সচিব
×