ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন দিনের গান

প্রকাশিত: ২২:৩৩, ১৫ জানুয়ারি ২০২২

নতুন দিনের গান

নতুন দিনের কথা ভাবছিল বিপু। ওর ভাবনায় শুধু কাকু ও আগামী! আর মা-বাবার কড়া শাসন! দস্যিপনা এবং পড়াশোনায় ভুল হলে কাকুই তাকে রক্ষা করেন। কাকু বলেছেন, ‘দেখিস নতুন বছরটা তোর ভাল যাবে।’ তাই ডাকাতিয়া নদীর পাড়ে এসে শীতের বিকেলে নতুন বছরের কথা ভাবছিল সে। খেয়াঘাটের বটগাছের নিচে বসে মনে মনে গেয়ে চলেছে নতুন দিনের গান। নতুন বছর ভালভাবে লেখাপড়া করবে। মিঠুকে ছাড়িয়ে যাবে! বিপুদের বাসার অদূরে বিশালদেহী এক বটগাছ দাঁড়িয়ে আছে অনেকদিন ধরে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে গাছটা বুঝি ঝিঁঝি ব্যথায় মরে! বয়স তো আর কম হলো না। কত হবে? গোটা পঞ্চাশ হবে বুঝি। হোমরা-চোমরা যেমনি তার চেহারা, তেমনি তার আকারটাও বিদঘুটে। রোজ রোজ কতই না ছবি দেখে সে! গাছটার পাশ ঘেঁষে একটা মস্ত বড় রাস্তা এঁকেবেঁকে চলে গেলে অনেক দূরে। অজানা কোন দেশে। রাস্তার সঙ্গে গাছটার মনে হয় তার অনেক দিনের বন্ধুত্ব! বিপুর জন্মের ঠিক পর পরই। রাস্তার বুকে রগ টানা টানা আঙ্গুল যেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে গাছটার! মাঝে মাঝে পথ চলতি পথিকেরা তাতে হোঁচট খেয়ে পড়েন। ডাকাতিয়ার নিকটেই বিপুদের বাসা। বাগাদী রোডের বাঁ-দিকে রহমতপুর আবাসিক এলাকায় থাকে ওরা। ডানদিকে খেয়াঘাট। মন খারাপ হলে বিপু সোজা এসে পড়ে গাছটার ধারে। মনে হয়ে গাছটার সঙ্গে বিপুর অন্তরের ভাব অনেক দিনের। কাকুর পরে যেখানে এসে সে শান্তি খুঁজে পায়। আজ সারাদিন কেউ তার কাছে এসে বসেনি। কেমন আছ তো দূরে কথা, গত রাতে কটা ভূতকে তুমি আশ্রয় দিয়েছিলে, পেত্নী ইলিশ মাছের সন্ধান মিলল কিনা, তাও কেউ বলেনি। তার বিশাল দেহে দিনভর পাখ-পাখালির আনাগোনা। কাক, ঘুঘু, কোকিল, শালিক, চড়ুই, পায়রা, আরও কত কি পাখি! খাঁ খাঁ রোদে যেন তার দেহে মেলা বসে! সবাই আপন মনে গানও গায়। বিপুদের স্কুল আজ তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেছে। ক্লাসে ফলাফল দিয়েছে। উন্নতি বলতে তার নেই। গণি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ছেলেরা সবাই যার যার বাসায় ফিরল। কিন্তু বিপু ফিরল না। স্কুল থেকে ফিরল ঠিকই। বাগাদী রোডের চৌরাস্তায় এসে বাঁ-দিকে বাঁক না নিয়ে ডান দিকের সরু পথে পা বাড়াল সে। এলো খেয়াঘাটের বটতলায়। আর মনে মনে ভাবল, কি করে বাসায় মুখ দেখাবে সে? গুয়াখোলা রোডের মামাতো বোন চেরী ও মেরী বাসার বলবে ছিঃ ছিঃ! ক্লাস ফোরে বুঝি কেউ ফেল করে? বিপু একটা রুবিক কিউব আর আনন্দ মেলা শারদীয় সংখ্যার জন্য বোন বেনুর কাছে বায়না ধরেছিল। বার্ষিক পরীক্ষায় ভাল ফলাফলের শর্তে বোন রাজি হয়। কাকু বলেছিলেন ‘বিপু এবার তোর স্কুল ছুটিতে কলকাতায় নিয়ে যাব।’ বিপু আনন্দে বলছিল- - সত্যি কাকু? - হ্যাঁ, এবার পরীক্ষায় তোমার ভাল রেজাল্ট হলেই হয়, তাছাড়া নয়। মিঠু বোধ হয় বাসায় গিয়ে বলেছে যে, ‘বিপু অঙ্কে সাত, ইংরেজীতে আঠারো, বিজ্ঞানে বারো পেয়েছে। আজকাল মিঠু ক্লাসে প্রথম হয়ে ভীষণ ইচড়ে পাকতে শুরু করেছে! কোন কথাই ওর পেটে সয় না। নিজে ভাল রেজাল্ট করে তো তিন-তিনটে শিক্ষকের জন্য। প্রয়োজনে কখনও ওর কাছে কোন বই চাইলে বলবে- আমার পড়া আছে। আর আমার তো কোন মাস্টারই নেই! কাকুই পড়ান। না হলে দেখে নিতাম কে ভাল ছাত্র?’ বিকেল গড়িয়ে যায়। আধও আলোতে পরিবেশটা একেবারে থমথমে। সূর্যটা পশ্চিমাকাশে ডুবু ডুবু করছে। সূর্যের লাল গোলাকার থালাটা নদীর ঢেউয়ে পানিতে জ্বলজ্বল করছে। ওদিকে বাসায় রব পড়ে গেল, বিপু কোথায়? সে নেই! তাহলে গেল কোথায়? পাশেই মিঠুদের বাসা। কাকু ওদের বাসায় খোঁজ নিলেন। স্কুল থেকে বিপু অনেক আগেই ফিরেছে। কাকুকে মিঠু জানালো, আজ তাদের বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল কার্ড দিয়েছে। কাকুর বুঝতে আর বাকি রইল না। কাকু জানতেন মন খারাপ হলে বিপু খেয়াঘাটের বটতলায় গিয়ে বসে। তাই কাকু দেরি করলেন না। চলে গেলেন ডাকাতিয়া নদীর বটতলায়। বিপু এমন খারাপ ফলাফল করবে তা ভাবেওনি! বাসায় গেলে মায়ের প্রহার! বাবার বকুনি! বোনদের উপহাস! এসব ভাবতে ভাবতে ঘাড় ফেরাতেই কাকুর চোখে চোখ পড়ল তার। -কি রে, তুই এখনও এখানে? মিঠুর কাছে সব শুনেছি আমি। ফল খারাপ হলে পালিয়ে বেড়াতে হয় বুঝি? ক্যান, কাল রাতেও তো পড়লি ‘একবার না পারিলে দেখো শতবার। নতুন বছরে ভাল করবি! হ্যাঁরে, আমাদের ভিসা হয়ে গেছে; নতুন বছরের শুরুতে ১০ দিনের জন্য আমরা কলকাতা যাব বেড়াতে। চিন্তা করিস না! তুইও যাবি।’ আস্তে আস্তে দুজন বাসার দিকে যেতে লাগল। বাসার কাছে এসে মায়ের শাসনের কথা ভেবে বিপুর ভয় হচ্ছিল! ওর ভয়ার্ত মুখ দেখে কাকু অভয় দেন। কাকুর গায়ের চাদরে বিপুকে ঢেকে দেন তিনি। শীতের হিমেল বাতাসে বিপু কাঁপছিল। জড়ানো কণ্ঠে বিপুর গলা থেকে বেরুচ্ছে–‘আমরা করররবো জঅঅয়.....এএএকডিন!’ কাকু মুচকে হাসেন! মনে হলো বিপুর গান যেন নতুন দিনের। নতুন বছরের প্রত্যয়। বিজয়ের আভাস। আগামীতে ভাল ফলাফলে যে বিজয় মিঠুকে ছাড়িয়ে যাবে সে!
×