ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শিবির নেতার ভাগ্য বদলেছে যুবলীগ নেতার আশীর্বাদে

প্রকাশিত: ২২:২৬, ১৫ জানুয়ারি ২০২২

শিবির নেতার ভাগ্য বদলেছে যুবলীগ নেতার আশীর্বাদে

মীর শাহ আলম, কুমিল্লা ॥ জেলার চৌদ্দগ্রামের এক সময়ের প্রভাবশালী শিবির নেতা এসএন ইউসুফ। তিনি চৌদ্দগ্রাম উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়কের (সদ্য বহিষ্কৃত) আনুকুল্যে হয়ে যান ওই আসনের এমপি সাবেক রেলপথমন্ত্রীর ব্যক্তিগত স্টাফ। ওই যুবলীগ নেতার আশীর্বাদে মন্ত্রীর ব্যক্তিগত স্টাফ হয়ে মন্ত্রণালয় ও ক্ষমতার অতি নিকটে থাকার সুবাদে দরিদ্র পরিবারের সন্তান ওই শিবির নেতা ইউসুফকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। অতি অল্প সময়ে ভাগ্য বদলে যায় তার। রাতারাতি গ্রামের বাড়ির টিনের চালাঘর ভেঙ্গে গড়ে তোলেন নজরকাড়া বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স ভবন। নামে-বেনামে গড়েছেন অঢেল সম্পদ, হয়েছেন কয়েক কোটি টাকার মালিক। এ ছাড়াও আওয়ামী লীগের দুর্দিনের ত্যাগী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার কেন্দ্রে কানাঘুষাসহ ভুল বুঝিয়ে তাদের দূরে রেখে জামায়াতের অনেককে আত্মীকরণেরও বিস্তর অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। সম্প্রতি সাবেক ওই মন্ত্রীর স্টাফ থেকে ছিটকে পড়ার পর ইউসুফের জামায়াত-শিবির কানেকশন, নেতাকর্মীদের কোণঠাসা করে বিভাজন সৃষ্টি, অঢেল সহায়-সম্পদের মালিক বনে যাওয়াসহ নানান বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হতে থাকে। এ নিয়ে চৌদ্দগ্রামসহ জেলার সর্বত্র রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে। কম সময়ে বিশিষ্ট ব্যক্তি বনে যাওয়া এসএন ইউসুফ চৌদ্দগ্রামের এমপি ও সাবেক রেলপথমন্ত্রী এবং ওই যুবলীগ নেতার শ্রীপুর ইউনিয়নের ছেঁওরিয়া গ্রামের মৃত বজলুর রহমানের ছেলে। সরেজমিন ঘুরে ও বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, চৌদ্দগ্রাম উপজেলা সদরের নজ্মিয়া সিনিয়র মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন এসএন ইউসুফ। অভাবের পরিবারে দরিদ্রতার কারণে তিনি সেখানকার একটি বাড়িতে লজিং থেকে ওই মাদ্রাসায় লেখাপড়া করতেন এবং ওই সময় শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ‘বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির, চৌদ্দগ্রাম নজ্মিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা শাখা’র সাথীদের তালিকায় উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও পৌরসভার ১২ জন সাথীর মধ্যে ৫ নম্বরে রয়েছে মোঃ এসএন ইউসুফ (শ্রীপুর ইউনিয়ন) নাম। শিবিরের ওই সাথী তালিকায় বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির, চৌদ্দগ্রাম নজ্মিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা শাখার সভাপতি মোঃ লিয়াকত আলী শিকদার ও সেক্রেটারি মোঃ মহিন উদ্দিনের স্বাক্ষর রয়েছে। ‘শধংিধৎ ঐধহরভ’ (কাউসার হানিফ) নামে চৌদ্দগ্রাম উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের ফেসবুক আইডি থেকে ভাইরাল হওয়া পোস্টে লেখা হয়েছে- ‘ছাত্র শিবিরের সাথী এসএন ইউসুফকে মুজিব ভাইয়ের অফিসে চাকরির জন্য সুপারিশ করছে শাহ জালাল মজুমদার। মুজিব ভাই যখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে জানতে পারলেন ইউসুফ শিবিরের সাথী ছিল, সঙ্গে সঙ্গে তাকে বের করে দিয়েছেন। এই ইউসুফ মুজিব ভাইয়ের ওখানে থেকে চৌদ্দগ্রামের ত্যাগী আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে বানিয়ে বানিয়ে কথা বলে মুজিব ভাইয়ের কাছে মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করেছে। আল্লাহর বিচার আল্লাহ করেছে। শিবিরের সাথী ইউসুফ নিজেকে আজ আওয়ামী লীগ বলে দাবি করে। ‘তোকে চ্যালেঞ্জ করলাম, বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে তুই রাজপথে ছিলি আওয়ামী লীগের পক্ষে- এমন একটি দলিল দেখা ব্যাটা! তুই যে শিবিরের সাথী ছিলি তার প্রমাণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আছে। তুই ব্যাটা এখন আমাদের প্রিয় নেতার বিরুদ্ধে কথা বলিস! তোর বিচার হবে চৌদ্দগ্রামের মাটিতে।’ তার এই পোস্টখানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আকারে ভাইরাল হয় এবং শুক্রবার বেলা ১২টা পর্যন্ত ৫৯ জনে শেয়ার করে। এ ছাড়া বাংলাদেশ আওয়ামী তৃণমূল লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ‘টিপু চৌধুরী’ ফেসবুক আইডি থেকে ‘যদি দুদক ধরে, পালাবি কোথায়’ শিরোনামে একটি পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এই পোস্টে এসএন ইউসুফ ও শাহজালাল মজুমদারের ছবি দিয়ে উল্লেখ করা হয়, ‘এই শিবিরের কর্মী এসএন ইউসুফ যখন সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক মুজিবের এপিএস ছিলেন এবং শাহজালাল মজুমদার যখন উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক, তখন চৌদ্দগ্রামের কিছু নেতাকর্মী ও কিছু মানুষের কাছে তারা ২ জন ছিলেন গড ফাদার....।’ ‘তরধ টফফরহ ইযঁরুধহ’ (জিয়া উদ্দিন ভূঁইয়া) সাধারণ সম্পাদক, আওয়ামী যুবলীগ, বাহরাইন- তার ফেসবুক আইডিতে এসএন ইউসুফকে নিয়ে কয়েকটি পোস্ট দেন। একটিতে তিনি লেখেন, ‘হতগাইয়া পিয়ন এসএন ইউসুফ কোটি টাকার মালিক, রাজকীয় বিয়ে’। এদিকে স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, এসএন ইউসুফের পরিবার ছিল দরিদ্র। তার গ্রামের বাড়ি ছেঁওরিয়ায় কিছুদিন আগেও টিনের চালার নড়বড়ে ঘর ছিল। এপিএস হয়ে ক্ষমতার নিকটে থেকে অতি অল্প সময়ে আলাদীনের আশ্চর্য চেরাগের মতো রাতারাতি তার ভাগ্য বদলে যায়। একই সঙ্গে বদলে যায় মাদ্রাসায় পড়া ওই শিবির নেতার পোশাক-চালচলন ও চুলের স্টাইল। বাড়ির টিনের ঘর ভেঙ্গে গড়ে তোলেন বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স ভবন। বহু দামী ফার্নিচার রয়েছে প্রতিটি কক্ষে। নামে-বেনামে কিনেছেন জমি-জমা। গড়েছেন অঢেল সম্পদ, হয়েছেন বেশ কয়েক কোটি টাকার মালিক। বিয়ের অনুষ্ঠান করেছেন রাজকীয়ভাবে। ক্ষমতার সুবাদে বিয়ের অনুষ্ঠানে অতিথি হয়েছিলেন ক্ষমতাধর ও নামীদামী ব্যক্তিদের অনেকে। বিয়েতে অন্তত পাঁচ হাজার অতিথি আপ্যায়নে তিনি এলাকায় তাক লাগিয়ে দেন। সূত্র জানায়, তাকে (এসএন ইউসুফ) এপিএস হিসেবে নিয়োগের পর একাধিক গোয়েন্দা সংস্থাসহ জেলা পুলিশের একজন পদস্থ কর্মকর্তা এ বিষয়ে সতর্ক করলেও ওই যুবলীগ নেতার আশির্বাদপুষ্ট হওয়ায় তাকে ওই সময় বাদ দেয়া হয়নি। এদিকে দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের নানাভাবে কোণঠাসা করে ফায়দা লুটা, নাম ভাঙ্গিয়ে দোর্দ- দাপট ও অবৈধ সুবিধা বাগিয়ে নেয়া, রাতারাতি টাকার পাহাড় গড়ে লাইফ স্টাইল পরিবর্তন ও বোল পাল্টে যাওয়াসহ নানা কারণে তার থলের বিড়াল বের হতে থাকে। একপর্যায়ে সম্প্রতি এপিএস থেকে তাকে বাদ দেয়া হলে তার উত্থানের নানা কথা এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়াসহ এলাকার মানুষের মুখে মুখে। এছাড়া দলের পোড় খাওয়া অনেক নেতাকর্মী এসএন ইউসুফের উত্থানের বিষয়ে দুদক ও গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন।
×