ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

খুন-খারাবি পর্যন্ত হচ্ছে

সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ বাড়ছে ধনী পরিবারে ॥ শহুরে সমাজে নতুন সমস্যা

প্রকাশিত: ২২:২২, ১৫ জানুয়ারি ২০২২

সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ বাড়ছে ধনী পরিবারে ॥ শহুরে সমাজে নতুন সমস্যা

ফজলুর রহমান ॥ সম্পত্তি কেন্দ্র করে ধনী পরিবারগুলোতে বিরোধ বাড়ছে। সম্পত্তি থেকে বোনদের বঞ্চিত করা, বাবা-মাকে মারধরের পর বাড়ি থেকে বের করে দেয়া, বোনদের অসুস্থ বাবা-মাকে দেখতে না দেয়া, এমনকি এতিম ভাতিজাদের পৈতৃক নিবাসে ঢুকতে না দেয়ার মতো নানা ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনা থানা-পুলিশ থেকে আদালত পর্যন্ত গড়াচ্ছে। কখনও কখনও সম্পত্তির লোভ থেকে খুন-খারাবি পর্যন্ত ঘটে যাচ্ছে, যা মেট্রোপলিটন সমাজের জন্য এক নতুন সমস্যা দেখা দিচ্ছে। সমাজ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শহুরে সম্পত্তির দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের মধ্যে বেশি লোভ হচ্ছে। তাই লোভ থেকে এক প্রকারে সম্পত্তি আত্মসাতের জন্য এসব ঘটনা ঘটছে। অনেক ধনী পরিবারের ছেলে কিংবা মেয়ে বিদেশে পাড়ি জমানোর কারণেও এ সমস্যা দেখা দিচ্ছে। কয়েকটি ঘটনায় দেখা গেছে, বোনরা স্বামীর সংসার নিয়ে বিদেশ থাকেন। তাই ভাইদের মনে তাদের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে। আর এক বা একাধিক ভাই বিদেশ থেকে অন্যায়ভাবে বাবা-মার কাছ থেকে সম্পত্তি নিয়ে নিচ্ছে বা এককভাবে ভোগ-দখল করতে দেখা গেছে। আবার বাবা-মা বৃদ্ধ হয়ে গেলে তাদের কাছ থেকে সম্পত্তি নিয়ে তাদের পথে বের করে দেয়ার ঘটনাও ঘটছে। ফলে সম্পত্তি কেন্দ্র করেই ধনী পরিবারগুলোতে ভেঙ্গে যাচ্ছে পারিবারিক বন্ধন। ঘটছে নানা অঘটন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পাশপাশি এ পারিবারিক বিরোধ সামাল দিতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। রাজধানীতে বসবাসরত ধনী পরিবারগুলোর মধ্যে সম্পত্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব অনেক পুরনো। তবে ইদানিং সম্পত্তি নিয়ে মারামারি, খুনাখুনীর ঘটনা বেশি ঘটছে। সম্পত্তি দখল নিয়ে পরিবারের অন্য সদস্যদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি অভিযোগও এসেছে। গত বছরের ১৫ অক্টোবর মোহাম্মদপুর ২/২, ব্লক-এ লালমাটিয়ায় সম্পত্তি দখলে নিতে মা নার্গিস বেগমকে হাতুড়িপেটা করে রক্তাক্ত করেন তারই দুই সন্তান তানভীর আহমেদ সোহেল ও মেয়ে নায়না আহমেদ শান্ত। পরে নার্গিস বেগম থানায় মামলা করেন। সে মামলায় ছেলে তানভীর জেল খাটলেও মেয়ে নায়না ও তার স্বামী জামিনে বেরিয়ে মাকে ফের বাড়ি ছাড়ার হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। ফলে ভয়ে ওই বাড়িতে রাতে থাকছেন না নার্গিস বেগম। নার্গিস বেগম জনকণ্ঠকে বলেন, আমার স্বামী মারা যাওয়ার পর ছেলেমেয়েকে মানুষ করেছি। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। মেয়ের জন্য একটি পার্লারও করেছি। সব কিছু ঠিকঠাকই ছিল। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে হঠাৎ করে মেয়ে নায়না তার স্বামীকে নিয়ে সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়ার পাঁয়তারা শুরু করে। পরে আমার ছেলেকেও ফুসলিয়ে উভয়ে আমাকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে। এসব ঘটনায় বিভিন্ন সময় মোহাম্মদপুর থানায় তিনটা জিডি, একটা মামলা করেছি। সবশেষ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে গেলে তিনি তেজগাঁও বিভাগের ডিসিকে (সাবেক) বলে দেন। ডিসির নির্দেশে পুলিশ আমাকে বাসায় উঠিয়ে দেয়। কিন্তু অদৃশ্য কোন কারণে দুদিন পর ডিসি আমাকে ডেকে নিয়ে শাসায়। এখন দিনের বেলায় ওই বাড়িতে থাকলেও মেয়ে ও মেয়ের জামাইয়ের ভয়ে রাতে অন্যত্র থাকতে হচ্ছে। এ বিষয়ে মোহাম্মদপুর থানার ওসি আব্দুল লতিফ জনকণ্ঠকে বলেন, নার্গিস বেগমকে মারধরের মামলায় ছেলে জেলে আছে, আর মেয়ে ও মেয়ের জামাই জামিনে আছেন। ডিসি স্যারের নির্দেশে ওনাকে আমরা বাসায় উঠিয়ে দিয়েছি। যতটুকু জানি, ওনি ওই বাসায়ই আছেন। নতুন করে কোন ঝামেলা হলে এবং আমাদের জানালে আমরা বিষয়টি দেখব। ২০১৭ সাল থেকে ব্রেইন স্ট্রোক করে শয্যাশায়ী পশ্চিম আগারগাঁওর বাসিন্দা আক্তার জাহান। তার স্বামীও অসুস্থ। আক্তার জাহানের দুই মেয়ে, দুই ছেলে। তাদের অসুস্থতার সুযোগে দুই ছেলে কাজী আক্তারুজ্জামান ও কাজী আশরাফুজ্জামান ভূমি অফিসের কর্মকর্তার সহায়তায় ১৬৪, পশ্চিম আগারগাঁও হোল্ডিংসের মিসেস আক্তার জাহানের স্থাবর-অস্থাবর প্রায় অর্ধকোটি টাকার সম্পত্তি লিখে নেন। এ ক্ষেত্রে আক্তারুজ্জামান ও আশরাফুজ্জামান কৌশলে তাদের দুই বোনকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেন। আত্মসাত করা সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিলে বড় ভাই আক্তারুজ্জামান বিষয়টি ফাঁস করে দেন। পরে তাদের বোন কাজী রোকসানা শাহজাহান বাদী হয়ে গত বছরের ২৮ অক্টোবর মোহাম্মদপুর থানায় একটি জিডি করেছেন, নং ২৩০০। ঘটনাটি কোর্ট পর্যন্ত গড়ালে সম্প্রতি কোর্ট বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দেন। কাজী রোকসানা শাহজাহান বলেন, ভাইয়েরা আমাদের অসুস্থ বাবা-মাকে সুস্থ দেখিয়ে তেজগাঁও সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের কতিপয় কর্মকর্তার সহায়তায় অর্ধকোটি টাকার সম্পত্তি লিখে নেয়। আমাদের দুই বোনকে বঞ্চিত করে আত্মসাত করা ও ব্যবসা থেকে আয় করা ২৫-৩০ কোটি টাকা সরিয়ে বিদেশে থাকা শ্বশুর বাড়ির লোকদের কাছে হুন্ডি করে আশরাফুজ্জামান। এ সবের প্রতিবাদ করায় দুই ভাই আমাদের দুই বোনকে নানাভাবে হুমকি দেয়। শুধু সম্পত্তি লিখে নেয়া-ই নয়, সম্পত্তির লোভে বাবা-মা ও বোনকে হত্যার ঘটনাও ঘটছে। গেল বছরের ১৯ জুন কদমতলীতে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে মা মৌসুমী ইসলাম, বাবা মাসুদ রানা ও বোন জান্নাতুলকে হত্যা করেছেন বড় মেয়ে মেহজাবিন ইসলাম মুন। ঘটনাটির পর পুলিশ ও প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, জায়গা-সম্পত্তি নিয়ে এ ঘটনা ঘটেছে। ঘটনার আগে সম্পত্তি নিয়ে পরিবারের সঙ্গে বিরোধ ছিল মেহজাবিনের। সম্পত্তি লিখে দেয়ার জন্য বাবা-মাকে অনেক চাপ দিত। এ নিয়ে এর আগে বৈঠক-শালিসও হয়েছে। এর আগে ২০১৯ সালের ৮ মে পশ্চিম মালিবাগে সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের জেরে ছোট ভাই এসএম সালমান ইমানকে পিটিয়ে হত্যা করে বড় বোন নাদিয়া জেরিন তমা ও তার স্বামী শামীম হোসেন। পরে পুলিশ তমা ও তার স্বামীকে গ্রেফতার করে। সম্পত্তির এ লোভ সামলাতে পারছেন না সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও। এতিম শিশুদের পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার অভিযোগও উঠেছিল সুপ্রিমকোর্টের এক আইনজীবীর বিরুদ্ধে। পরে মধ্যরাতে হাইকোর্ট বসিয়ে আদেশ দেয়ার পর তাদের বাসায় ওঠাতে বাধ্য হন শিশুদের চাচা ও সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী কাজী রেহান নবী। ঘটনাটি ঘটেছে ২০২০ সালের অক্টোবরে। জানা গেছে, ধানমন্ডির একটি চারতলা বাড়ির মালিক সাবেক এ্যাটর্নি জেনারেল প্রয়াত কে এস নবী। তার ছোট ছেলে সিরাতুন নবীর মৃত্যুর পর সিরাতুনের দুই ছেলে কাজী আদিয়ান নবী ও কাজী নাহিয়ান নবী কিছু দিনের জন্য তাদের মায়ের আশ্রয়ে থেকে যায়। তবে আগেই শিশু দুটির বাবা-মায়ের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে। এর পর মায়ের কাছ থেকে নিজ পিত্রালয়ে ফেরার চেষ্টা করেও চাচা কাজী রেহান নবীর বাধায় বাসায় ঢুকতে পারেনি ওই দুই শিশু। পরে বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশ ও নজরে আসার পর মধ্যরাতে হাইকোর্ট বসিয়ে দুই শিশুকে বাসায় ওঠানোর আদেশ দেন দুই বিচারপতি। এরপর পুলিশ দুই শিশুকে বাসায় উঠিয়ে দিয়ে আসেন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ জনকণ্ঠকে বলেন, সভ্যতা, শিক্ষার দিক দিয় অগ্রগতি হলে সমাজে সম্পত্তি নিয়ে পারিবারিক বিরোধ হতো না। আইন, ধর্ম মানলেও এমনটি হতো না। কিছু লোভী লোক এমনটি করে হয়তো হয়রানি করতে পারে। কিন্তু শেষমেষ সাকসেস হতে পারে না। এমন বিরোধ কিংবা মামলা অনেক সময় আদালত পর্যন্তও গড়ায়। আইনের শাসন সঠিকভাবে চললে সবাই ন্যায়বিচার পেত। কিন্তু যার প্রভাব আছে, অর্থ আছে আইন তার পক্ষেই যায়। তিনি বলেন, জমি-জমার বিরোধ নিয়ে আইনশৃঙ্খলার অবনতি যেন না ঘটে, সেটি পুলিশ দেখতে পারে। সে ক্ষেত্রে পুলিশ জরুরী অবস্থাও জারি করতে পারে। কিন্তু কারও পক্ষ হয়ে কাজ করতে পারে না। এ বিষয়ে পুলিশকে কোর্টের আদেশ মানতে হবে। আইন অনুযায়ী, জমি-জমা কিংবা সম্পত্তি নিয়ে এমন পরিবারিক ঝামেলার বিষয়ে পুলিশের কিছু করার এখতিয়ার নেই। তবে সম্পত্তি নিয়ে খুন-খারাবি, মারামারি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটলে কিংবা ফৌজদারি অপরাধ সংঘটিত হলে এবং এসব ঘটনায় মামলা দায়ের হলে পুলিশ সেটি তদন্ত করবে। আর এ বিষয়ে আদালত যে রায় দেবেন, পুলিশ সেটি পালন করবে। তবে বাস্তবে পুলিশকে এক পক্ষের হয়ে হস্তক্ষেপ করার অভিযোগও ওঠে। এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মোঃ ফারুক হোসেন বলেন, সম্পত্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব পারিবারিক বিষয়। এ ক্ষেত্রে পুলিশের কিছু করার নেই। তবে সম্পত্তি নিয়ে ফৌজদারি অপরাধ সংঘটিত হলে সেটি দেখার দায়িত্ব পুলিশের। এর বাইরে গিয়ে পুলিশ কাজ করে না, করার কথাও নয়। ভাই-বোনের সম্পর্কই সবচেয়ে মধুর। তবে মাঝেমধ্যে এই সম্পর্কেও ছেদ পড়ে বাবা-মায়ের রেখে যাওয়া সম্পত্তি কিংবা অধিকার চাইতে গেলে। এ নিয়ে মামলা-মোকদ্দমার সংখ্যাও নেহাত কম নয়। এসব মামলায় বোনদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার ঘটনাই বেশি দেখা যায়। তবে মুসলিম আইনে বাবা বা মা মারা যাওয়ার পর তার যদি ছেলে ও মেয়ে থাকে, তবে রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে ছেলে যা পাবেন, মেয়ে তার অর্ধেক পাবেন। কিন্তু সম্পত্তির লোভে ভাইদের অনেকে না মানে রাষ্ট্রীয় আইন, না মানে মুসলিম আইন। ফলে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন ক্রমেই ক্ষয়িঞ্চু হচ্ছে। শিথিল হয়ে যাচ্ছে সব বন্ধন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নেহাল করিম জনকণ্ঠকে বলেন, সম্পত্তির কারণে সমাজের প্রায় ৯০ ভাগ লোকের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে, সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে। কেননা, আমাদের বেড়ে ওঠাটা সুন্দর হয়নি। আমাদের উদারতার অভাব রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক মানসিকতার ব্যাপার রয়েছে। অনেক অভিভাবক সন্তানকে সুন্দরভাবে লালনপালন করতে পারেনি। ফলে সন্তানদের মধ্যে স্বার্থপরতা কাজ করে। লোভ সামলাতে পারলেই এ সমস্যা অনেকটা কমে আসবে বলে মনে করছেন তিনি।
×