ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ছাদে ছাদে বিকট শব্দ, কান পাতা দায়!

পুরান ঢাকায় সাকরাইন উৎসব দিনে উড়ল ঘুড়ি, রাতে আলোর খেলা

প্রকাশিত: ২১:৫৩, ১৪ জানুয়ারি ২০২২

পুরান ঢাকায় সাকরাইন উৎসব দিনে উড়ল ঘুড়ি, রাতে আলোর খেলা

জবি সংবাদদাতা ॥ পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সাকরাইন উৎসবকে কেন্দ্র করে প্রায় সব বাসার ছাদে ছাদে উড়েছে নানান রঙবেরঙের ঘুড়ি। কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ঘুড়িগুলোর নামও বেশ চমৎকার। রয়েছে চোখদার, পানদার, বলদার, দাবাদার, লেজওয়ালা, পতঙ্গ ইত্যাদি নামের ঘুড়ি। উৎসব শুরুর দু-এক দিন আগেই এসব ঘুড়ি কিনে রেখেছিলেন শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীরা। নিজের ঘুড়িকে সবচেয়ে উপরে তোলার প্রতিযোগিতার সঙ্গে ঘুড়ি কাটাকাটির লড়াইয়ে বেশি আনন্দ পায় কিশোর-কিশোরীরা। পৌষের শেষ দিন বাংলাদেশসহ পুরো উপমহাদেশেই পৌষসংক্রান্তি উৎসবের আয়োজন করা হয়। রাজধানীর পুরান ঢাকায় এ উৎসবকে বলা হয় সাকরাইন। এ উপলক্ষে দিনমান ছাদে ছাদে চলে ঘুড়ি ওড়ানো। গানবাজনার অনুষ্ঠান। সন্ধ্যার পর সেই উৎসবই পরিণত হয় আলোর খেলায়। অন্যান্যবারের মতো শুক্রবার এ উৎসব উদ্যাপন করা হয়। বেলা চারটার দিকে যাত্রাবাড়ীর দয়াগঞ্জ পার হয়ে গেন্ডারিয়ায় ঢুকতেই দেখা গেল, আকাশজুড়ে ঘুড়ির মেলা। লাল, নীল, বেগুনি নানা বাহারি তার রং। একে একে বানিয়ানগর, সূত্রাপুর, লক্ষ্মীবাজারসহ পুরো এলাকার বেশির ভাগ ছাদেই ছেলে-বুড়ো, তরুণ-তরুণীর ভিড়। ছাদে গানবাজনার তালে ঘুড়ি ওড়াচ্ছিলেন তাঁরা। ধোলাইখাল টায়ার স্টান্ড একটি বাড়ির ছাদে এমনই একটি চোখদার ঘুড়ি ওড়াচ্ছিলেন সানজিদা নামের এক তরুণী। তিনি জানান, এটা তাঁর নানার বাসা। উৎসব উপলক্ষে সব আত্মীয় এখানে জড়ো হয়েছেন। ছোটবেলা থেকেই সাকরাইনে ঘুড়ি ওড়াতেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। সন্ধ্যার পর পর্যন্ত থেকে দেখা গেল, দিনে যে উৎসব ছিল ঘুড়ি ওড়ানোর, রাতে তা-ই পরিণত হয়েছে আলোর খেলায়। বেশির ভাগ বাড়ির ছাদই আলোকসজ্জা করা। কোনো বাড়ির ছাদ থেকে ফোটানো হয় আতশবাজি, কোথাও কোথাও মুখে কেরোসিন নিয়ে মশালে ফুঁ দিয়ে তৈরি করা হয় আগুনের হলকা। পুরান ঢাকার স্থানীয় কয়েকজন জানালেন, পৌষসংক্রান্তির এ উৎসব কয়েক শ বছরের পুরোনো। আগে এ উৎসব মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন উদ্যাপন করত। তবে কালক্রমে তা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার উৎসবে পরিণত হয়েছে। ধোলাইখাল একটি বাসার ছাদে গিয়ে দেখা গেল, বড় বড় সাউন্ড বক্সসহ গানবাজনার নানা আয়োজন। এ আয়োজনের উদ্যোক্তা ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৪২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের ছেলে। তাদের সাউন্ডবক্সে বিকট শব্দে বেজেছে বাংলা-হিন্দি গান। গানের তালেতালে নৃত্য করেছে উঠতি বয়সী ছেলে-মেয়েরা। মাঝেমধ্যেই বিকট শব্দে ফোটানো হয়েছে পটকা। বাংলা পৌষ মাসের শেষ দিনকে ঘিরে পুরান ঢাকার সাকরাইন উৎসবকে কেন্দ্র করে এতসব আয়োজন ছিল। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে ফানুস উড়ানো, পটকা ফোটাতে নিরুৎসাহিত করা হলেও সে কথা কেউ কানে নেয়নি। ফলে বৃহস্পতিবার রাতে কিছুটা সহনীয় হলেও শুক্রবার সকাল থেকে পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের যেন ঘরের বাইরে কান পাতা দায় হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও বিকট শব্দে শিশুদের অবিরাম কান্না করতে দেখা গেছে। বারো মাসে তেরো পার্বণের দেশে পৌষ মাসের শেষ দিনটিকে ঘিরে পুরান ঢাকায় হিন্দু ধর্মালম্বীরা মূলত সাকরাইন উৎসব করে থাকে। তবে ধীরেধীরে পুরান ঢাকার অন্য ধর্মাবলম্বীরাও এই উৎসবে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছেন। শুক্রবার সকালে সূর্যোদয়ের পর থেকেই বাসাবাড়ির ছাদে ঘুড়ি ওড়ানো শুরু হয়েছিল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আয়োজন আরো বাড়ে। ঘুড়ি ওড়ানোর জন্য সুতা-মাঞ্জা দেওয়া থেকে শুরু করে পিঠা উৎসবেরও আয়োজনও ছিল পুরান ঢাকার অনেক বাড়িতে। বাংলা বাজার, পাতলাখান লেন, কাগজীটোলা, ধোলাইখাল, শাঁখারিবাজার, কলতাবাজার এলাকার অনেক বাসার ছাদে বিকট শব্দে সাউন্ড সিস্টেমের কারণে অনেকটা আতঙ্ক দেখা দিয়েছে এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে। এদিকে ২০২২ সালের ইংরেজি নববর্ষের প্রথম প্রহর উদযাপনের ফলে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে আগুনের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়াও অনবরত আতশবাজির বিকট শব্দে নগরবাসী পড়েন ভোগান্তিতে। আতশবাজিতে কেঁপে ওঠে গোটা মহানগরী আর ফানুসের আগুন ছিটকে পড়ে বিভিন্ন এলাকার বাসাবাড়িতে। এসব বিষয় মাথায় রেখে পৌষ-সংক্রান্তি বা সাকরাইন উৎসবের দিন বিকট শব্দের আতশবাজি ও ফানুস ওড়াতে বারণ করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। কিন্তু তাদের সেই নির্দেশনা তোয়াক্কা করেনি কেউ। হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকজন বললেন, কয়েক পুরুষ ধরেই তাঁরা এ উৎসব দেখছেন, নিজেরাও অংশ নিচ্ছেন। তবে তাঁরাও ছোটবেলায় এ উৎসব যেমন দেখেছেন, এখন তাতে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। আগে এ উৎসব উপলক্ষে বাড়ির জামাইদের দাওয়াত করা হতো। তাঁরা কেউ গুড়ের কলস, কেউ দুধের কলস, কেউ মাছ-মাংস, কচ্ছপ এসব আনতেন। তাঁরা সকালবেলা উঠেই হলুদ দিয়ে গোসল করতেন। এরপর ছাদে উঠে ঘুড়ি ওড়াতেন। শ্বশুরবাড়ি থেকে জামাইদেরও ঘুড়ি দেওয়া হতো। জামাইয়েরা ঘুড়ি কাটাকাটি খেলতেন। তাতে উৎসাহ দিতেন বউয়েরা। সন্ধ্যায় ছাদ থেকে নেমে যেতেন তাঁরা। রাতে চলত জামাইদের আনা খাবার-দাবারের আয়োজন। সূত্রাপুর এলাকার সিপন বিশ্বাস বললেন, আগে পৌষসংক্রান্তিতে রাতের ফানুস বা আতশবাজির আয়োজন থাকত না। তবে দিনভর ঘুড়ি ওড়ানো ছিলই। তখন সাউন্ডবক্স ছিল না, তবে মাইক ছিল। সেই মাইকে চলত গানবাজনা। কয়েক বছর ধরে দুই দিনব্যাপী সাকরাইন উৎসবের আয়োজন করা হচ্ছে। এবারও স্থানীয়দের আয়োজন দুদিনের।
×