ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সাকরাইন উৎসবে ঘুড়িতে রঙিন পুরান ঢাকার আকাশ

প্রকাশিত: ২১:৪৮, ১৫ জানুয়ারি ২০২২

সাকরাইন উৎসবে ঘুড়িতে রঙিন পুরান ঢাকার আকাশ

মনোয়ার হোসেন ॥ গত কয়েক দিন ধরেই পুরান ঢাকার অলিগলিতে চলেছে ঘুড়ির বিকিকিনি। বাড়ির ছোট ছেলেদের হাত ধরে অগুনতি ঘুড়ি পৌঁছে গেছে প্রাচীন শহরের ঘরে ঘরে। সে সব রঙ্গিলা ঘুড়ির ঝাঁক শুক্রবার শীতের সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি উড়েছে আকাশে। সেই সুবাদে সূত্রাপুর, শাঁখারীবাজার, লক্ষ্মীবাজার, বাংলাবাজার, গেন্ডারিয়া, ধূপখোলা মাঠ, নারিন্দাসহ প্রাচীন নগরীর পুরনো অংশটির আকাশ ছিল ঘুড়ির দখলে। বাতাসে ভর করে নীলাকাশে ডানা মেলেছিল রঙিন ঘুড়ির দল। উড়ে বেড়ানো ঘুড়ির আশ্রয়ে নাগরিক মনটি যেন ছুঁতে চেয়েছে আকাশকে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পৌষের শেষ দিনে এমন বর্ণবহুল দৃশ্য একান্তই পুরান ঢাকার। শত শত বছর আগে নবাবী আমলের প্রচলিত সাকরাইন উৎসবের পরম্পরায় আজও বর্ণিল হয় এই যান্ত্রিক শহর। পুরান ঢাকাবাসীর কাছে এসে পৌষ সংক্রান্তি পরিণত হয়েছে সাকরাইন উৎসবে। যে উৎসবে ঘুড়ি হয় দিনব্যাপী আনন্দের উৎস। শুক্রবার সেটাই ঘটেছে শহর ঢাকার একাংশে। আকাশজুড়ে পরিভ্রমণ করেছে অজ¯্র রংমাখা বহুমাত্রিক অবয়বের ঘুড়ি। শুধু তো ওড়াউড়ি নয়, চলেছে নাটাই ঘুরিয়ে কাটাকাটি খেলা। এক ঘুড়িবাজের নাটাইয়ের সুতোর টানে বিচ্ছিন্ন হয়েছে অপর ঘুড়িবাজের সাধের ঘুড্ডিটা। ঘুড়ি কাটার সঙ্গে সঙ্গে কণ্ঠ থেকে সজোরে বেরিয়েছে ‘ভোকাট্টা’ চিৎকার। এ দিন প্রায় প্রতিটি বাড়ির ছাদ মুখরিত হয়েছে ভোকাট্টা চিৎকারে। আবার নাটাই থেকে কাটাপড়া ওই ঘুড়ির পেছনে ছুটেছে শিশুদের দল। ছেলে থেকে বুড়ো বাড়ির সবাই শামিল হয়েছে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যে পরিণত হওয়া সাকরাইন উৎসবে। পুরুষের পাশাপাশি নাটাই ঘুরিয়ে ঘড়ি ওড়ানোর আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়নি কিশোরী থেকে তরুণী কিংবা সারাদিন ঘর সামলানো নারী। শুধুই কি ছিল ঘুড়ির ওড়াউড়ি, ছিল তার চেয়ে অনেক কিছু বেশি। ঘুড়ি উড়ানোর আয়োজনকে কেন্দ্র করে ঘরে ঘরে চলেছে ব্যাপক খানাপিনা। পোলাও, কোরমা থেকে কাচ্চি বিরিয়ানি। সরু গলির ছাদে ছাদে উচ্চস্বরে বেজেছে লাউড স্পিকার। উচ্চতালের গানের সুরে চলেছে তুমুল নাচানাচি। দিনভর ঘুড়িখেলা শেষে সন্ধ্যা পেরুনো রাত আলোকিত হয়েছে নয়ন জুড়ানো আতশবাজিতে। কেরোসিন মুখে পুরে পাড়ার দুরন্ত ছেলেটি আগুনে ফুঁ মেরে ছুড়ে দিয়েছে রাত্রি রাঙ্গানো প্রবল হলদে অগ্নিগোলক। শীতের সকালে ঘুড়ি ওড়ানো শুরু হলেও সাকরাইন উৎসবের পরিপূর্ণ আমেজটি ধরা দিয়েছে বিকেলে। মধ্যাহ্নভোজ শেষে বাড়ির সবগুলো মানুষ জড়ো হয়েছিলেন ছাদে। সকলের চোখ ছিল আকাশের পানে। মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে চোখগুলো কেন্দ্রীভূত ছিল উড়তে থাকা ঘুড়ির দিকে। বাহারি লেজ নাড়িয়ে উড়েছে লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, বেগুনীসহ বহু বর্ণের ঘুড়ি। চোখদার, পান, শিংদার, ভোয়াদারসহ নানা রঙের ঘুড়ির ওড়াউড়ি দেখে কেটেছে ঢাকাবাসীর আনন্দময় সময়। সন্ধ্যার পর আতশবাজি, ফানুস আর আগুনের আলোয় ঝলমল করেছে শত বছরের সাকরাইন উৎসব। এক সময় সাকরাইনের ঘুড়ি ওড়ানোর সুতোর ধার বাড়াতে গোপনে মাঞ্জা দেয়া হতো। পৌষের প্রথম দিন থেকেই শিরিষ, কাচের গুঁড়া, সাগুদানা মাখিয়ে সুতার মাঞ্জা দেয়া হতো। হালের আধুনিকতায় এখন আর কাউকে কষ্ট করে মাঞ্জা দিতে হয় না। ঘুড়ির দোকানেই পাওয়া যায় মাঞ্জামারা ধারালো সুতো। এদিন সূত্রাপুরের মোহিনী মোহন দাস লেনের বাসিন্দা আসাদুজ্জামান আরশাদ নিজ বাড়ির ছাদে বড় পরিসরে সাকরাইন উৎসবের আয়োজন করেন। জনকণ্ঠের এই প্রতিনিধিকে তিনি বলেন, আমাদের এলাকার মানুষের কাছে ঈদ কিংবা পূজার মতোই রাশি রাশি আনন্দ নিয়ে হাজির হয় সাকরাইন উৎসব। বছরের এই দিনটিতে ঘুড়ির সঙ্গে আমাদের মনটাও যেন উড়ে যায় আকাশে। শৈশব থেকে দেখে আসছি এ উৎসব। এক সময় নিজে ঘুড়ি উড়িয়ে পার করে দিতাম পৌষ সংক্রান্তির সারাটি দিন। আর এখন বাড়ির অভিভাবক হওয়ায় নিজেকে উৎসব আয়োজনের দায়িত্বটা নিতে হয়। ভাই-বোন এবং ভাগিনা-ভাগ্নি ও ভাতিজা-ভাতিজিরা সবাই আজ আমার বাসায় আমন্ত্রিত। বন্ধুরাও আছে সেই তালিকায়। তাদের নিয়ে দিনভর ঘুড়ি ওড়ানোর পাশাপাশি চলবে খানাপিনা। সন্ধ্যায় আকাশ থেকে ঘুড়ি নামার হবে আরেক দফা চা-নাশতার আপ্যায়ন। এরপর শুরু হবে আতশবাজি। কেউ বা কেরোসিন মুখে আগুনের মাঝে ফুঁ মেরে ছুড়ে দেবে আগুনের গোলা। এভাবেই আনন্দ-আড্ডায় মোটামুটি রাত দশটা অবধি থাকবে সাকরাইন উৎসবের রেশ। আসাদুজ্জামান আরশাদের বন্ধু শামীম খান এক সময় থাকতেন সূত্রাপুরের একই মহল্লায়। একটি বেসরকারী ব্যাংকের এই কর্মকর্তা পেশাগত কারণে বর্তমানে বসবাস করেন বনানীতে। তবে সাকরাইনের উৎসবের টানে দুপুর বেলাতেই ছুটে এসেছিলেন বন্ধুর বাসায়। কথা প্রসঙ্গে বলেন, সারা বছর এই দিনটার জন্য অপেক্ষা করি। তাই অর্ধেক অফিস করে ছুটে এসেছি উৎসবে শামিল হতে। এর একটাই কারণ, পুরনো বন্ধুদের দেখা হওয়ার পাশাপাশি সাকরাইন উৎসবের মাধ্যকে খুঁজে পাই হারিয়ে যাওয়া শৈশবকে। এই দিনটি মনে করিয়ে দেয় সেই চিন্তা কিংবা চাপমুক্ত সেই দুরন্ত সময়কে। ইতিহাসের তথ্যসূত্র থেকে জানা যায়, নবাবী আমলে ১৭৪০ সাল থেকে ঢাকায় শুরু হয় সাকরাইন নামের ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব। নবাবরা খাজনা আদায়ের দিনটিতে ঘুড়ি উড়িয়ে মেতে উঠতেন উৎসবে। সেই উৎসবটির প্রচলন ঘটেছে পুরান ঢাকায়। অন্যদিকে, ৩১ পৌষের এ দিনে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এ উৎসব পালন করতেন। কালের বিবর্তনে সাকরাইন এখন সর্বজনীন উৎসব।
×