ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

১২শ’ বছরের পুরনো

পূর্ণাঙ্গ বৌদ্ধ বিহার মন্দির কমপ্লেক্স আবিষ্কার

প্রকাশিত: ২১:৪৭, ১৫ জানুয়ারি ২০২২

পূর্ণাঙ্গ বৌদ্ধ বিহার মন্দির কমপ্লেক্স আবিষ্কার

সাজেদ রহমান ॥ যশোরের কেশবপুর উপজেলার কাশিমপুর গ্রামের ডালিঝাড়া ঢিবির প্রত্মস্থানে প্রত্মতাত্ত্বিক খনন করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর খুলনা ও বরিশাল বিভাগীয় অঞ্চলের অফিসের একটি খনন দল একটি পূর্ণাঙ্গ ‘বৌদ্ধ-বিহার-মন্দির কমপ্লেক্স’ আবিষ্কার করেছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এই স্থাপনাগুলো আনুমানিক খ্রি. ৯ম থেকে ১১ শতকের মধ্যবর্তী সময়ের। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ ভারতের পশ্চিমবাংলার সংলগ্ন দক্ষিণাঞ্চলে এমন স্থাপনা প্রথম আবিষ্কৃত হলো। দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুসারে এই স্থাপনাগুলোর এমন কিছু অনন্য ও ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্বদিকে ইতোপূর্বে আবিষ্কৃত অন্যান্য বৌদ্ধবিহারগুলোর থেকে একেবারেই ভিন্ন ও আলাদা। প্রতœতাত্ত্বিক ও স্থাপত্যিক এই বৈশিষ্ট্যাবলীর বিবেচনায় এই ‘বৌদ্ধ বিহার-মন্দির কমপ্লেক্স’-এর ধ্বংসাবশেষ বাংলাদেশ ও ভারতের বিহার, ওড়িশা ও পশ্চিমবাংলার সমসাময়িক অন্যান্য বৌদ্ধস্থাপনা থেকে আলাদা। এই ব্যতিক্রমী, অনন্য ও বিরল ‘বৌদ্ধবিহার-মন্দির’ স্থাপনাটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে মানববসতির বিস্তার ও পরিবর্তন এবং ইতিহাসের ক্ষেত্রে একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন বলে মনে করছেন বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ। ২০২০ সালের ২২ জানুয়ারি থেকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর কেশবপুর উপজেলার ডালিঝাড়া ঢিবিতে খনন শুরু করে। স্থাপনাটির সামগ্রিক পরিকল্পনায় বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্বাংশের অন্যান্য বৌদ্ধ বিহার/মহাবিহারগুলোর মূল স্থাপত্যিক পরিকল্পনাই অনুসৃত হয়েছে। যদিও উত্তর দিকের ভিক্ষুকক্ষসহ বাহুটি এখনও উন্মোচিত হয়নি। এক্ষেত্রে তিনদিকে ভিক্ষুকক্ষ ও একদিকে মন্দিরসহ একটি আয়তাকার পরিকল্পনা অনুসৃত হয়েছে। মাঝখানে রয়েছে বিহারের অঙ্গন। বিহারাঙ্গনের মধ্যেও অন্যান্য স্থাপনা থাকতে পারে, যেমন অন্যান্য বিভিন্ন বিহারে রয়েছে। প্রাপ্ত মৃৎপাত্র এবং স্থাপত্য শৈলীগত বিবেচনায় এই বিহারটির সময়কাল আনুমানিক ৯ম- ১১শ’ শতক। বৌদ্ধবিহার খনন সম্পর্কে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের আঞ্চলিক পরিচালকের কার্যালয় খুলনার কর্মকর্তারা বলছেন, খননের ফলে আনুমানিক ৯ম-১১শ’ শতকের একটি বৌদ্ধ বিহার উন্মোচিত হয়েছে। বিহারের পূর্বদিকে দুটো বৌদ্ধ মন্দির এবং উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে টানা বারান্দা, ভেতরের ও বাইরের দিকে দেয়ালসহ সর্বমোট ১৮টি কক্ষ উন্মোচিত হয়েছে। বিস্তৃত খনন করা সম্ভব হলে আরও স্থাপত্যিক কাঠামোর উন্মোচন হবে। প্রত্নতাত্ত্বিক খনন টিমের সদস্য গবেষণা সহকারী উর্মিলা হাসনাত বলেছেন যে, খননের ফলে অলঙ্কৃত ইট, পোড়ামাটির ফলকের ভগ্নাংশ ও মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ পাওয়া গেছে। পোড়ামাটির ইট ও ফলকের ভগ্নাংশগুলোতে পদ্মফুল ও বিভিন্ন জ্যামিতিক নক্সা অঙ্কিত রয়েছে। এছাড়াও চুন সুরকি, বালি দ্বারা নির্মিত স্টাকো পাওয়া যায়। স্টাকোগুলোতে নানাধরনের ফুলেল ও জ্যামিতিক নক্সা পাওয়া গেছে। এখানে একটি বিশেষ ধরনের বাটি আকৃতির মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে যা সাধারণত ৭ম-১১শ’ শতকের বৌদ্ধবিহারসহ অন্যান্য প্রত্নস্থানে পাওয়া যায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. স্বাধীন সেন বলেছেন, স্থাপনাটির পূর্বদিকের অংশ ঢিবি আকারে ছিল। তবে খননের ফলে উন্মোচিত স্থাপনার বিস্তার উত্তর ও পশ্চিমের বর্তমান কৃষিজমির মধ্যে বিস্তৃত হয়েছে। এখনও নতুন নতুন দেয়ালের অংশ ও ফিচার উন্মোচিত হচ্ছে।’ বৌদ্ধ বিহারটি আয়তাকার। পূর্বদিকে ২টি মন্দির, উত্তরবাহুতে ২টি ভিক্ষুকক্ষ, দক্ষিণ বাহুতে ৯টি ভিক্ষুকক্ষ, পশ্চিম বাহুতে ৭টি ভিক্ষুকক্ষ রয়েছে। পশ্চিমবাহুর মাঝখানে একটি বড়কক্ষ রয়েছে। এই কক্ষটির পশ্চিমে একটি বৃহদাকার অভিক্ষেপ রয়েছে। পশ্চিমবাহুর মধ্যবর্তী এই অভিক্ষেপ ও বড় কক্ষটিই বিহারের প্রধান প্রবেশদ্বার ছিল। বৌদ্ধবিহারটির পূর্বদিকে দুইটি বৌদ্ধ মন্দির উন্মোচিত হয়েছে। যার মধ্যে উত্তর-পূর্বকোণের মন্দিরটির পরিমাপ হলো উত্তর-দক্ষিণে আনুমানিক ১৯ মিটার ও পূর্ব-পশ্চিমে আনুমানিক ২৪ মিটার। পূর্বদিকে মাঝ বরাবর (পশ্চিম দিকের বাহুর মধ্যবর্তী প্রবেশদ্বারের ঠিক বিপরীতে) উন্মোচিত বৌদ্ধমন্দিরটির পরিমাপ উত্তর-দক্ষিণে আনুমানিক ২১ মিটার ও পূর্ব-পশ্চিমে আনুমানিক ২৪ মিটার। মন্দির সম্বলিত ঢিবিটি চারপাশের ভূমি থেকে প্রায় ২.৫ মিটার উঁচু। উভয় মন্দিরই আবদ্ধ কক্ষ তৈরি করে তার মাঝে নির্মিত হয়েছে। এই ধরনের স্থাপনারীতি সেলুলার স্থাপনারীতি হিসেবে পরিচিত। বিহারটি উত্তর-দক্ষিণে ৬০ মিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে ৯০ মিটার। বিহারের আঙ্গিনার পরিমাপ ৩৪.৫ মি. (উত্তর-দক্ষিণে) ও ৪০.৬ মি. (পূর্ব-পশ্চিম)। বিহারের ভেতরের দিকের এখন অবধি উন্মোচিত দক্ষিণ ও পশ্চিম বাহু সংলগ্ন বারান্দার পরিমাপ উত্তর-দক্ষিণ বরাবর ৪২ মিটার এবং পূর্ব-পশ্চিম বরাবর ৪৪.৬ মিটার। ভেতরের এই বারান্দার প্রস্থ ২.৪০ মিটার ২.৫৫ মিটার। দক্ষিণ বাহু সংলগ্ন বাইরের বারান্দার প্রস্থ ৪.৫০ মিটার। পশ্চিম দিকের বাইরের এবং প্রবেশপথ সংলগ্ন বারান্দা বা পরিসরের প্রস্থ হলো ৪.৭৫ মিটার। এই বারান্দা গিয়ে দক্ষিণ বাহুর বারান্দার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। প্রবেশদ্বারের অভিক্ষেপ: পশ্চিমবাহুর মাঝ বরাবর ৯ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৯.৬৫ মিটার প্রস্থ সংবলিত প্রবেশপথ উন্মোচিত হয়েছে। প্রবেশপথের অভিক্ষেপের শেষসীমা এখন অবধি চিহ্নিত করা যায়নি। কারণ তা সংলগ্ন শস্যবিশিষ্ট জমির মধ্যে প্রসারিত হয়েছে। বিহারের কক্ষ: বিহারের উত্তর বাহুতে ২টি, দক্ষিণ বাহুতে ৯টি এবং পশ্চিম বাহুতে এখনও পর্যন্ত ৭টি কক্ষ উন্মোচিত হয়েছে। পশ্চিমবাহুর মাঝখানের কক্ষটি বড় এবং প্রবেশপথ হিসেবে ব্যবহৃত হতো এবং এই কক্ষের পশ্চিমেই অভিক্ষেপটি যুক্ত হয়েছে। উন্মোচিত কক্ষগুলোর পরিমাপ দৈর্ঘ্যে ৫.২৩ মি. থেকে ৪.৭১ মি. এবং প্রস্থে ৪.৬১ থেকে ৪.১৭ মি. পর্যন্ত। মধ্যবর্তী সেলের পরিমাপ ১.৯৮ মি. থেকে ২.০৮ মি.। কক্ষগুলোকে পরস্পর থেকে পৃথককারী পরিসরের পরিমাপ হলো ৪৫ সেমি থেকে ১৬৫ সেমি। বিহারের উত্তরবাহু ও বিহারাঙ্গনের বেশিরভাগ স্থান এখনও খনন করা যায়নি। কারণ সেখানে বিভিন্ন শস্য রয়েছে। পানের বরজ ও মেহগনী বাগান রয়েছে। পূর্বদিকের মন্দিরদুটো ছাড়া বাকি অংশে ঢিবি কেটে প্রায় সমান করে চাষাবাদ করা হয়েছে। ফলে ঢিবির মধ্যে চাপা পড়া স্থাপত্যিক অবশেষের ওপরের দিকের কাঠামো আগেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে ইট তুলে নিয়ে যাওয়ার কারণে। জানা যায়, জায়গাটিতে একসময় ছিল আমবাগান। ১৯৮৮ সালে এক ঝড়ে বাগানের বেশিরভাগ গাছ ভেঙ্গে পড়ে। কাশিমপুরের ডালিঝাড়া ঢিবিতে তখন আম, কচু ও কলাগাছ লাগানোর উদ্যোগ নেন বাগানমালিক। চাষের জন্য মাটি প্রস্তুত করতে গিয়ে একটু গভীরেই শক্ত ইটে বাধা পাওয়া যায়। বিষয়টি স্থানীয় মানুষের চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। কিন্তু এলাকার বাইরে এ ঘটনা তখন খুব একটা জানাজানি হয়নি। ওই ঘটনার প্রায় ৩০ বছর পর ২০১৯ সালের নবেম্বরে বাগানটির মালিক রিজিয়া সুলতানা ও তার স্বামী মোস্তফা মোড়ল সিদ্ধান্ত নিলেন সেখানে আবারও আমের চারা লাগাবেন। এবার জমি আরও বেশি খুঁড়তে গিয়ে বিশাল লাল ইটের স্তূপ পাওয়া গেল। খবরটি প্রচার হওয়ার পর ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের খুলনা কার্যালয়ের উপপরিচালক আফরোজা খান এবং সহকারী পরিচালক এ কে এম সাইফুর রহমান এসে জানালেন ওই জমিটি তারা একটু খুঁড়ে দেখতে চান। জমির নিচে পুরোনো ইটের স্তূপ থাকতে পারে, এটা আগে থেকেই জানার কারণে অনুমতি দিলেন রিজিয়া ও মোস্তফা দম্পতি। এরপর ২০২০ বছরের জানুয়ারি থেকে শুরু হয় খননকাজ, খননের চার দিনের মাথায় বেরিয়ে আসে লাল ইটের তেরি বিশাল স্থাপনার চিহ্ন। তিন মাস ধরে খননকাজের পর বেরিয়ে যায় চমকপ্রদ সব তথ্য। ওই ইটের স্তূপ আসলে মধ্যযুগের এক বৌদ্ধমন্দির কমপ্লেক্সের একাংশ। তিন মাস খননের পর তথ্য উপাত্ত পেয়ে জায়গাটি আবার মাটি দিয়ে ভরাট করে রেখেছে প্রত্মতত্ত্ব অধিদফতর। ভবিষ্যতে আবার খনন কাজ চালাবে তারা।
×