ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নাফিসা বানু

মানুষের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ

প্রকাশিত: ২১:৩৪, ১৫ জানুয়ারি ২০২২

মানুষের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ

নৈতিকতা ও মূল্যবোধ দুটি শব্দের একই ধরনের বা কাছাকাছি অর্থ বোঝালেও শব্দ দুটোর মধ্যে কিছুটা পার্থক্য ধারণা করা যায়। কিন্তু দুটি শব্দ একটি অপরটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শব্দ দুটির ব্যাখ্যা দর্শন শাস্ত্রীয় বিষয়। দর্শনশাস্ত্র নিয়ে কথা বলার যোগ্যতা বা শিক্ষা আমার নেই। সাধারণভাবে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ নিয়েই আমার আলোচনা। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অভাবে আমাদের পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্র আজ অবক্ষয়ের সম্মুখীন। পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্র একই সুতায় গাঁথা। সুতরাং পরিবারের অবক্ষয় দেখা দিলে তার প্রভাব পড়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর। প্রথমে আমরা জানতে চেষ্টা করি নৈতিকতা বলতে কি বোঝায়। নৈতিকতা বলতে বোঝায় নীতি সম্পর্কিত বোধ বা অনুভূতি। এটি মানবিক গুণাবলী বা অন্য আরও অনেক গুণাগুণের সমন্বয়কে বোঝায়। নৈতিকতা মানুষের আচরণ বা চরিত্রকে প্রকাশ করে। মানুষের চরিত্রের আদর্শ বা নৈতিক গুণাবলী হলো নৈতিকতা। নৈতিকতার সহজ পরিভাষা হলো নম্রতা, ভদ্রতা, সচ্চরিত্র এবং উত্তম আচরণ। নৈতিকতা মূলত সিদ্ধান্ত, উদ্দেশ্য এবং কর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত। নৈতিকতা প্রকাশের মাধ্যমে একজনের চরিত্র বিকশিত বা প্রকাশিত হয়। মানুষ তার পরিবার সমাজ রাষ্ট্র ও ধর্মের ওপর ভিত্তি করে সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়ম-নীতি খুব সচেতনভাবে মেনে চলে। পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্র আরোপিত এই সব নিয়ম-নীতি ও আচরণবিধি মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে। এই নিয়মগুলো মেনে চলার প্রবণতা, মানসিকতা ইত্যাদি নীতির চর্চা করাকে বলা যায় নৈতিকতা। নৈতিকতাকে আরেক অর্থে আমরা বলতে পারি আত্মশুদ্ধি বা মূল্যবোধ। নৈতিকতার মধ্যে লুকিয়ে আছে সততা, মহত্ব, ন্যায়পরায়ণতা ও আদর্শবাদিতা। অপরদিকে মূল্যবোধ বলতে বোঝায় মানুষের আচরণকে পরিচালনা করে যে সকল নীতি ও মানদণ্ড তা। মানুষের আচরণের মানদণ্ড তার নিজ নিজ বিশ্বাস ও নীতির ওপর নির্ভর করে। পৃথিবীর সব মানুষের বিশ্বাস ও নীতি এক হয় না। যেমন একেক জন মানুষ একেক ধর্মের অনুসারী বা বিশ্বাসী, সেক্ষেত্রে তারা নিজ নিজ ধর্মের নীতি, আদর্শ ও বিশ্বাসকে অনুসরণ করে চলে। যেমন ইসলাম ধর্মের নীতি অনুযায়ী একজন আরেকজনের সঙ্গে দেখা হলে তাকে সম্মান জানিয়ে সালাম দিয়ে থাকে প্রচলিত ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী। অন্যদিকে অন্য ধর্মের মানুষ নিজ নিজ ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী সম্মান প্রদর্শন করে থাকে নিজ নিজ ধর্মীয় রীতির ভিত্তিতে। মূল্যবোধের ভিত্তি হলো ধর্ম, দর্শন, দীর্ঘদিনের লালিত আচরণ, বিশ্বাস, সমাজের নিজস্ব আদর্শ ও নিয়ম-নীতি। সমাজে বিদ্যমান রীতিনীতি ও প্রথার মাধ্যমে ভাল-মন্দ, ভুল-সঠিক, কাক্সিক্ষত-অনাকাক্সিক্ষত বিষয় সম্পর্কে সমাজের মানুষের যে ধারণা সেগুলোকেই আমরা মূল্যবোধ বলে বিবেচনা করি। একজন সচেতন মানুষ সামাজিক চাপে পড়ে বা ব্যক্তিগত, সমষ্টিগত স্বার্থের কারণে নয়, অথবা কোন পার্থিব ভয় বা প্রলোভনের কারণে নয়, বরং নৈতিক মূল্যবোধ ও বিবেককে প্রাধান্য দিয়ে তার সমস্ত কাজ সম্পাদন করেন। তবে তিনিই প্রকৃত পক্ষে নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ হিসেবে বিবেচিত বা স্বীকৃত হবেন সমাজ বা রাষ্ট্রের কাছে। মূল্যবোধ গড়ে ওঠে দীর্ঘদিন একই সমাজে একসঙ্গে বসবাস করার ফলে যে সব অভিজ্ঞতা অর্জিত হয় তা থেকে। নীতি-নৈতিকতা বা মূল্যবোধ এসব একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের মূল চালিকাশক্তি। এসবের অভাব রাষ্ট্রের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক মানদণ্ডকে সমালোচিত করে। মানুষের আচরণের মানদণ্ড বিশ্বাস ও নীতির ওপর নির্ভর করে। সে বিশ্বাস ও নীতিই হলো মূল্যবোধ বা নৈতিকতা। নৈতিকতা সম্বন্ধে সচেতনতা জাগরণের শিক্ষাকেই মূল্যবোধের শিক্ষা বলা যায়। নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ মানুষকে তার মানবতাবোধ জাগ্রত করতে সহায়তা করে থাকে। নৈতিক আদর্শ সংবলিত সমাজ বলতে বোঝায়, যে সমাজে কোন অনাচার, অবিচার, সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, শোষণ, নিপীড়ন, স্বার্থপরতা এসব অনৈতিক চর্চা থাকবে না। সেই সমাজকেই নৈতিকতার আদর্শে আবর্তিত সমাজ বলা হয়। সকল প্রকার দুর্নীতি, অন্যায়, অসততা থেকে মুক্ত জীবনই আদর্শ জীবন হিসেবে বিবেচিত হয়। এ ছাড়া প্রত্যেকের ধর্ম বিশ্বাস মতে স্বীয় ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে চলা, সত্য ন্যায় এর পথে থাকা, অপরের ক্ষতি না করা, পরোপকারী হওয়া ইত্যাদির চর্চাই হলো সাদামাটা অর্থে নৈতিকতার বিকাশ বা বহির্প্রকাশ। মানবিক গুণসমৃদ্ধ চরিত্রই হলো নৈতিক মূল্যবোধের ফল। সুতরাং দেখা যায় নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শব্দ দুটি একে অপরের পরিপূরক হিসেবে বিবেচিত। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের প্রথম শিক্ষা শুরু হয় পারিবারিক শিক্ষা থেকে। পরবর্তীতে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা থেকে। অনেক সময় শিক্ষাঙ্গনের শিক্ষা মানুষের মনে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলে। এ ছাড়া আগে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সমাজ বা ধর্ম থেকেও মানুষ নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের শিক্ষা অর্জন করতে পারে। বিবেকের সঙ্গে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সম্পর্ক খুব নিবিড়। একজন বিবেকবান মানুষই নৈতিক মূল্যবোধের অধিকারী হতে পারেন। উদ্দেশ্যের সঙ্গে বিবেক একসঙ্গে বা ওতপ্রোতভাবে কাজ করে। যদি বিবেক ভাল কোন উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করার নির্দেশ দেয় তবে তা অবশ্যই নৈতিক হবে। আবার এও বলা যায় বিবেককে জাগ্রত করা নৈতিকতার অংশ বলে বিবেচিত। যেমন আমি যদি কোন ভাল উদ্দেশ্য নিয়ে কোন কাজ করি তার ফল যদি খারাপ হয় তাহলে তাকে অনৈতিক বলা যাবে না। কারণ আমার উদ্দেশ্য ছিল সঠিক ও সৎ। কিন্তু উদ্দেশ্য সঠিক বা সৎ না হলে তা হবে অনৈতিক কাজ। সাধারণত বিচারকদের বিচারের ক্ষেত্রে এটা লক্ষণীয়। যেমন একজন বিচারক যদি সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে বিচার করে ভুল করেন তা গ্রহণীয়। কারণ, সৎ ও নিরপেক্ষ উদ্দেশ্য নিয়ে যদি বিচারক সাক্ষী-প্রমাণ পর্যালোচনা করেন এবং এর মধ্যে কোন সারবত্তা না পান তাহলে তিনি মামলা খারিজ করবেন। তার বিচার ভুল হলেও নৈতিকতার মানদণ্ডে তার কোন ভুল নেই বলেই বিবেচিত হবে। এ ছাড়া পরিবার থেকে মানুষ ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করে। কোরানের আলোকে ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা পরিবার থেকে নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে। অন্য ধর্মের অনুসারীরাও নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থের অনুসারী। প্রত্যেকে নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থের মাধ্যমেই নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে। বর্তমানে আমাদের সমাজ অবক্ষয়ের সম্মুখীন। ধর্মের নামে মানুষ মানুষকে খুন করছে ধর্ম প্রচারের জন্য। এটা কি কোন ভাল কাজ? এটা কি নৈতিক মূল্যবোধের পরিপন্থী নয়? জানামতে কোরানের কোথাও এভাবে মানুষ খুন করে ধর্মপ্রচারের উল্লেখ নেই। বলা আছে ‘ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি নয়। যার যার ধর্ম তার তার কাছে।’ শিক্ষার ক্ষেত্রে দেখা যায় শিক্ষার্থীরা নকল করছে যা অনৈতিক। নকল করে পাস করা যায়, তাতে মেধা বা জ্ঞান বৃদ্ধি পায় না। জানামতে কোরানে উল্লেখ করা আছে যার হক তাকে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য। কিন্তু সমাজের মানুষ আজ অর্থ-সম্পদের লোভের জন্য অন্য মানুষের হক নষ্ট করে তা নিজে কুক্ষিগত করছে। এটাও নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অভাবের কারণেই হয়ে থাকে। আমরা যে মূল্যবোধের প্রচার করি তা মূলত অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তি জীবনে বাস্তবায়ন করতে সচেষ্ট হই না। সঙ্কীর্ণ স্বার্থের আবর্তে নৈতিকতা, আদর্শ ও মূল্যবোধ বিসর্জিত হচ্ছে। অবশ্য ব্যতিক্রমধর্মী কিছু মানুষ আছেন যারা চরম খারাপ সময়ও নৈতিকতা আদর্শ ও মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুত হন না। যদিও তাদের সংখ্যা খুবই কম, তবুও সমাজ আজ তাদের জন্যই কিছুটা টিকে আছে। বর্তমানে সমাজ ও রাষ্ট্রে অবক্ষয় বিশৃঙ্খলা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে। সুতরাং এক্ষেত্রে এই অবক্ষয় ও বিশৃঙ্খলা প্রতিহত করতে হবে। সমাজে আজ অবক্ষয়ের কারণে খুনোখুনি, হানাহানি বেড়েই চলেছে। আজকাল কিশোর অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে। মানুষ মানুষকে সামান্যতম স্বার্থের কারণে খুন করছে। সমাজের মানুষের মধ্যে ন্যূনতম নৈতিকতা বা মূল্যবোধ কাজ করে না। বিভিন্ন ধরনের অপরাধ সমাজে বেড়েই চলছে। মানুষ কেমন যেন হিংস্র ও স্বার্থপর হয়ে পড়ছে। এই সমাজকে অবক্ষয়ের হাত থেকে বাঁচাতে না পারলে তা রাষ্ট্রের ওপরও প্রভাব ফেলবে। এ জন্য প্রয়োজন নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চর্চা করা। যা একটি পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তর থেকে শুরু করা যায়। আজকে পৃথিবীর যে সব দেশকে উন্নত দেশ হিসেবে গণনা করা হয়, দেখা যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেসব দেশের মানুষ সমাজের বা রাষ্ট্রের নীতি-নৈতিকতাকে অনুসরণ করে জীবনযাপন করছে। বর্তমানে আমাদের প্রথম প্রয়োজন শিক্ষা ব্যবস্থাকে সঠিক পথে চালিত করা । যে শিক্ষা আমাদের তরুণ প্রজন্মকে জ্ঞানী, দক্ষ, ভাল-মন্দ বোঝার মতো করে গড়ে তুলতে সাহায্য করে এবং তার পাশাপাশি ন্যায়বান, রুচিশীল, নান্দনিক নৈতিক ও মানবিক বোধসম্পন্ন গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক ও সর্বোপরি আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে সে রকম শিক্ষা প্রসারে আমাদের সদিচ্ছা জরুরী। আমাদের দেশে আমরা ধর্ম নিরপেক্ষতা চর্চা করে থাকি। সুতরাং নিজ নিজ ধর্ম বিশ্বাসী প্রত্যেকটি মানুষ যেন নিজ নিজ ধর্মের আলোকে নিজের মধ্যে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ জাগরিত করেন। কারণ, সকল ধর্মের শিক্ষায় নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে প্রধান্য দেয়া হয়েছে। নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বিবর্জিত মানুষ পশুর সমান। তবে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সকলের নিকট এক রকম থাকে না। কারও মধ্যে বেশি বা কারও মধ্যে কম থাকে। আসুন, আমরা সবাই মিলে পরিবার, রাষ্ট্র ও সমাজে নৈতিকতা ও মূল্যবোধর চর্চার মাধ্যমে দেশকে উন্নত, সভ্য, কলুষমুক্ত হিসেবে গড়ে তুলি। এটি আমাদের জাতীয় কর্তব্য বলে মনে করি। শুধু সঠিক নৈতিকতা ও মূল্যবোধ চর্চাই পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। লেখক : সদস্য (অর্থ) নির্বাহী বোর্ড বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ
×