ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

গণপরিবহন যত আসন তত যাত্রী নিয়ে চলবে

প্রকাশিত: ০০:৩০, ১৪ জানুয়ারি ২০২২

গণপরিবহন যত আসন তত যাত্রী নিয়ে চলবে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ অর্ধেক নয়; যত আসন তত যাত্রী নিয়ে চলবে গণপরিবহন। তবে দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলা যাবে না। ভাড়াও বাড়বে না। মানতে হবে স্বাস্থ্যবিধি। করোনা মহামারী প্রতিরোধে বিধিনিষেধ পালনে গণপরিবহনের ব্যাপারে নতুন এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। সংস্থাটি জানিয়েছে, নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গণপরিবহনে যত আসন রয়েছে তত যাত্রী পরিবহন করা যাবে। গত ১০ জানুয়ারি করোনা মহামারী প্রতিরোধে ১১ দফা বিধিনিষেধ জারি করে সরকার। ১১ দফা বিধিনিষেধের ছয় নম্বর দফায় বলা হয়েছে, ট্রেন, বাস এবং লঞ্চে অর্ধেক যাত্রী নিতে হবে। সব যানের চালক ও সহকারীকে আবশ্যিকভাবে কোভিড-১৯ টিকা সনদধারী হতে হবে। এতে আরও বলা হয়, জনসাধারণকে অবশ্যই বাইরে গেলে মাস্ক পরতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে সারাদেশে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে। বৃহস্পতিবার থেকে এ বিধিনিষেধ কার্যকর হবে বলেও জানানো হয়েছিল। তবে গণপরিবহনে অর্ধেক আসন খালি রেখে চালানোর প্রতিবাদ জানিয়ে গত বুধবার বিআরটিএ ভবনে কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরিবহন মালিক নেতাদের বৈঠক হয়। বৈঠকে মালিকরা বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত সব খোলা রেখে অর্ধেক আসন খালি রেখে বাস চললে তীব্র পরিবহন সঙ্কট হবেÑ এ যুক্তি তুলে ধরে তারা সরকারী নির্দেশনা পুনর্বিবেচনার দাবি জানায়। অন্যথায় চালক শ্রমিকরা বাস চালানো বন্ধ করে দিতে পারেন বলেও সরকারকে হুঁশিয়ার করেছিলেন মালিকরা। তখন বিআরটিএ চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার জানিয়েছেন, পরিবহন মালিকদের দাবি যৌক্তিক। তাই আসন অর্ধেক খালি রাখার শর্ত শিথিল করতে সরকারের কাছে আবেদন করা হবে। এর পরদিন বৃহস্পতিবার বিকেলে সড়ক পরিবহন সচিব মালিকদের দাবি মেনে নেয়ার কথা মৌখিকভাবে জানান। সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে বলেন, সব খোলা রেখে বাসে অর্ধেক যাত্রী পরিবহন করলে, পরিবহন সঙ্কটে ব্যাপক জনভোগান্তি হবে। এ বিষয়টি সরকারকে জানানো হয়েছিল। সরকার তা বিবেচনা করেছে। যত সিট ততজন যাত্রী পরিবহনের অনুমতি দেয়া হবে বলে মৌখিকভাবে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। তিনি আরও জানান, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব নজরুল ইসলাম মৌখিকভাবে বিষয়টি মালিক সমিতিকে জানিয়েছেন। বাসের আসনের সমান সংখ্যক যাত্রী পরিবহনের নির্দেশনা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ শীঘ্র দিতে পারে। পাশাপাশি করোনার টিকার সনদ ছাড়া চালক ও শ্রমিকরা বাস চালাতে পারবেন না বলে যে শর্ত রয়েছে, তা বহাল থাকছে। বিআরটিএর নির্দেশনা অনুযায়ী, সবার জন্য বাসে স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা রাখতে হবে। যাত্রার শুরুতে ও শেষে বাস জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। যাত্রী উঠানামা সামাজিক দূরত্ব মানতে হবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রজ্ঞাপন ও বিআরটিএর জারি করা নির্দেশনা অনুযায়ী, গণপরিবহনে চালক, শ্রমিক, যাত্রী সবার মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক। করোনার টিকা না নেয়া চালক শ্রমিকরা বাস চালাতে পারবেন না। তবে বাস ট্রাক ওনার্স এ্যাসোসিয়েশনের সহকারী সাধারণ সম্পাদক রাকেশ ঘোষ বলেন, ৯৫ ভাগ চালক শ্রমিক এখনও টিকা পাননি বা নেননি। তাহলে বাস কে চালাবে? এ সিদ্ধান্তের ফলে গণপরিবহন বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পরিবহন নেতারা বলছেন, গণপরিবহন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে চালক শ্রমিকদের কীভাবে দ্রুততম সময়ে টিকা দেয়া যায়, তাতে জোর দেয়া হয়েছে। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এ নিয়ে আলাপ চলছে। চালক শ্রমিকরা যেন পরিচয়পত্র অথবা লাইসেন্স দেখিয়ে টিকা নিতে পারেন- সেই প্রস্তাব করা হয়েছে। করোনা আর বিধিনিষেধকে পাত্তাই দিচ্ছেন পরিবহন শ্রমিকরা ॥ যত আসন তত যাত্রী নেয়ার এ নতুন সিদ্ধান্ত আসে বৃহস্পতিবার বিকেলে। এর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত পরিবহনে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলার বিধিনিষেধই বহাল ছিল। অথচ দিন ঘরিয়ে বিকেল হয়ে গেলেও পরিবহন শ্রমিকদের ৯৫ শতাংশের বেশি শ্রমিকই জানেন না যে, তারা অর্ধেক যাত্রী নিয় গাড়ি চালাবেন নাকি সিটপ্রতি যাত্রী নিবেন। রাজধানীর বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ডের বাসচালক, হেলপারের কাছে জানতে চাইলে তারা জানান, পরিবহন মালিক সমিতি থেকে তাদের কিছুই জানানো হয়নি। ফলে আসনপ্রতি যাত্রী নিয়েই চলাচল করছে দূরপাল্লার বাস। আর রাজধানীর সিটিং বাসগুলোতে আগের মতোই আসনের বাইরেও দাঁড়িয়ে যাত্রী নিতে দেখা গেছে। গাবতলী থেকে সিটপ্রতি যাত্রী নিয়ে বেলা আড়াইটায় যশোরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় সৌখিন পরিবহনের একটি বাস। বিআরটিএর নির্দেশনা অনুযায়ী, সবার জন্য বাসে স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা রাখতে হবে। যাত্রার শুরুতে ও শেষে বাস জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। অথচ বাসটি ছিল না কোন জীবাণুনাশক। চালকের মুখে ছিল না মাস্ক। চালক রফিক মিয়া বলেন, এসব শুনতে শুনতে (বিধিনিষেধ) কান জালাপালা হয়ে গেছে। আর বইলেন না তো! একই সময়ে বরিশালের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া সুবর্ণ পরিবহনেরও একই অবস্থা। চালক লোকমানের পাশে বসে কোন নির্দেশনা পেয়েছেন কিনা- এমনটি জানতে চাইলে তখন পাশে রাখা মাস্কটি লাগান তিনি। তবে যাত্রী নেয়ার বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে জানান চালক। শ্যামলী ও গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখা গেছে, পরিবহন শ্রমিকদের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতাই নেই। মাস্ক ছাড়াই কাউন্টারে বসে আছেন টিকেট বিক্রেতা ও সুপারভাইজার। গাবতলীর শতাধিকের মতো থাকা কাউন্টারের মধ্যে হাতেগোনা ২/১টি ছাড়া সব কাউন্টারের একই চিত্র। যাত্রীদের অনেকেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাউন্টারে আসছেন। তবে পরিবহন শ্রমিকদের প্রতিযোগিতা আর হাতাহাতিতে করোনা ঝুঁকিতে থেকে যাচ্ছেন যাত্রীরা। যে কাউকে টিকেট কাউন্টারে ঢুকতে দেখলেই পরিবহন শ্রমিকরা টানাটানি শুরু করে দেন। হোক মহিলা কিংবা পুরুষ যাত্রী, তা দেখার সময় নেই তাদের। নিজ পরিবহনের গুণকীর্তন আর টেনে বাসে তোলার অসম প্রতিযোগিতা দেখে মনে হয়, করোনা বলতে কিছুই নেই। এক প্রকারে যা ইচ্ছে, তা-ই করছেন পরিবহন শ্রমিকরা। তবে নতুন করে করোনা আক্রান্ত আর করোনার মধ্যে ঢাকায় থাকার তিক্ততা থেকে অনেক পরিবারকে ঢাকা ছাড়তে দেখা গেছে। লঞ্চে ঘাটে ভিড় বেড়েছে যাত্রীদের ॥ জনকণ্ঠের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতা জানান, নতুন করে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকায় সরকারের ফের বিধিনিষেধ এবং বিধিনিষেধ কার্যকর হওয়ার কথা শুনে রাজধানীর সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে দেশের দক্ষিণাঞ্চলগামী যাত্রীদের ভিড় বেড়েছে। প্রতিটি লঞ্চে গাদাগাদি করে যাত্রীরা উঠছেন। তাদের অনেকেই মানছেন না স্বাস্থ্যবিধি। সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে আসমা আক্তার বাড়ির উদ্দেশ ছোট ছেলেদের সঙ্গে ব্যাগ ও ল্যাকেজ নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। জানতে চাইলে তিনি জানান, তার গ্রামের বাড়ি বরিশাল। তিনি ঢাকায় মগবাজার এলাকায় ২ ছেলেকে নিয়ে স্বামীর সঙ্গে থাকতেন। তার স্বামী একজন বেসরকারী চাকরিজীবী। গতবারের মতো যদি এবারও লকডাউন দেয়া হয়, এই ভয়ে আগেই বাড়ি চলে যাচ্ছি। গত বছর লকডাউনে আমার স্বামীর চাকরি চলে যাওয়ায় আমাদের অনেক কষ্টে দিন পাড় করতে হয়েছে। মানুষের কাছে অনেক ঋণী হতে হয়েছে। এবারও যদি এমন হয়, এই ভয়ে আগেই বাড়িতে চলে যাচ্ছি। আসমা আক্তারের মতো এমন অনেক পরিবারকে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে বাড়ির উদ্দেশ যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। নতুন বিধিনিষেধে লঞ্চে সক্ষমতার অর্ধেকসংখ্যক যাত্রী নেয়ার নির্দেশ থাকলেও লঞ্চ কর্তৃপক্ষের সেই নির্দেশ পালন করতে দেখা যায় নাই। তবে শনিবার থেকে কার্যকর হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। টিকেট কেটে লঞ্চে প্রবেশ করার কথা থাকলেও পারাবত-১৫ লঞ্চের যাত্রীদের বিআইডব্লিউটিএর লোকজন জিজ্ঞাসা করলে কেউ টিকেট কাটে নাই বলে জানান। এ সময় বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ পারাবত-১৫ লঞ্চ সার্ভেই কাগজ এবং লঞ্চ মাস্টারদের রেজিস্ট্রেশন যাচাই করেন। টিকেট না কেটে যাত্রী উঠানোর জন্য তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়ে দেয়া হয়। ঢাকা নদীবন্দর ও লঞ্চ মালিকদের দাবি, তারা স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে তদারকি করছেন। যাত্রীদের মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে মাইকিং, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার বিকেল সরেজমিনে দেখা যায়, পুরো টার্মিনালে যাত্রীদের ভিড়। হুড়োহুড়ি করে লঞ্চে উঠছেন যাত্রীরা। টার্মিনালে প্রবেশপথ এবং লঞ্চে ওঠার সময় যাত্রীদের মুখে মাস্ক থাকলেও লঞ্চে ওঠার পর তারা তা খুলে ফেলছেন। প্রতিটি লঞ্চে স্বাস্থ্যবিধি মানতে মাইকিং করা হলেও যাত্রীদের অনেকেই তা মানছেন না। এছাড়া কয়েকটি লঞ্চের চালক ও স্টাফদেরও মাস্ক পরতে দেখা যায়নি। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে হুড়োহুড়ি করে এমভি ফারহান-৪ লঞ্চে ওঠেন শাহরিয়ার ম-ল। কিন্তু তার মুখে মাস্ক ছিল না। জানতে চাইলে শাহরিয়ার বলেন, তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে মাস্ক পরা হয়নি। এ কথা বলেই প্যান্টের পকেট থেকে মাস্ক বের করে মুখে পরেন তিনি। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের ঢাকা নদীবন্দরের উপ-পরিচালক মোঃ কবির হোসেন বলেন, লঞ্চে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে তদারকি করছি। কোন লঞ্চ যাতে অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে ঘাট ছাড়তে না পারে, সে ব্যবস্থা করা হয়েছে।
×