ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুর রাজাক গুরনার অভিবাসী অভিজ্ঞতা

প্রকাশিত: ০০:০৬, ১৪ জানুয়ারি ২০২২

আবদুর রাজাক গুরনার অভিবাসী অভিজ্ঞতা

১৯৪৮ সালে পূর্ব আফ্রিকার দ্বীপ রাষ্ট্রে জন্ম নেয়া আবদুর রাজাক গুরনা জানজিবার স্বাধীনতা-উত্তর কালে যখন আরব বংশোদ্ভূত নাগরিকদের হত্যা করা হচ্ছিল, তখনই ১৯৬৮ সালে শরণার্থী হিসাবে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান। শরণার্থী কালের স্মৃতি নিয়ে লেখা প্রথম উপন্যাস ‘মেমোরি অভ ডিপারচার’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৭ সালে। সঙ্গত কারণে ঔপনিবেশিক এবং উত্তর-ঔপনিবেশিক কালের স্মৃতি, অভিবাসী হিসেবে নিজ অভিজ্ঞতা তার লেখালেখির বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে। নিরলস সত্য বয়ানে আপোসহীনভাবে তুলে ধরেন আফ্রো-ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতাবাদ। একটি দ্বীপ রাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী আবদররাজাককে তার চিরচেনা সাগর, তার ঢেউ খেলানো তীর, কূলকূল ধ্বনি, ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়গুলো আন্দোলিত করেনি। বরং ঔপনিবেশিক কালের শোষণ, জানজিবার বিপ্লব, স্বাধীনতা আন্দোলন, গণহত্যা, শরণার্থী হওয়ার অভিজ্ঞতা তাকে গভিরভাবে আন্দোলিত করে। ফলে মাতৃভূমির অতীত স্মৃতি, পরিচয় সঙ্কট, স্থানান্তরের দুর্বিষহ যন্ত্রণা এবং ফেলে আসা অতীত তাকে জাগ্রত করে, লেখার রসদ যোগায়। আবদুররাজাকের সাহিত্যচর্চা শুরু মূলত যুক্তরাজ্য গমনের পর থেকেই। তখন বয়স মাত্র একুশ বছর।তার শরণার্থীসত্তা তাকে উপন্যাস আর গল্পে ঔপনিবেশিক আর উত্তর-ঔপনিবেশিক যন্ত্রণাকে তুলে ধরতে সাহায্য করে।শিক্ষা জীবন শেষে বেছে নেন অধ্যাপনার জীবন। পড়ান ঔপনিবেশবাদ আর গুগি ওয়া থিয়াঙ্গো আর ওলে সোয়াইঙ্কা আর সালমান রুশদীদের। অবসর গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত তিনি যুক্তরাজ্যের কান্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের অধ্যাপক এবং উত্তর উপনিবেশিকতাবাদই পড়াতেন। তার উপন্যাসের সংখ্যা দশটি, ছোট গল্পগ্রন্থ সাতটি এবং আরও রয়েছে প্রবন্ধ, সমালোচনা গ্রন্থ, নন-ফিকশন। ১৯৯৪ সালে তিনি প্যারাডাইস উপন্যাস রচনা করেন। এতে তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে জার্মানদের অধীনে জানজিবারের দুর্বিষহ ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের কথা বিভিন্ন চরিত্র চিত্রণের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলেন। সুইডিশ একাডেমি এই উপন্যাসটির জন্যই তাকে ২০২১ সালের সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী ঘোষণা করেন। আবদুররাজাক গুরনা রচিত সর্বশেষ উপন্যাস আফটারলাইভস, যেটি ২০২০ সালে প্রকাশিত হয়। এ উপন্যাসটি আবর্তিত হয়েছে হামজা নামে একজন আফ্রো-আরব যুবককে কেন্দ্র করে। এই উপন্যাসে চিত্রিত হয় পূর্ব আফ্রিকায় জার্মান উপনিবেশকালে একজন তরুণের বিক্রি হয়ে জার্মানদের পক্ষে যুদ্ধ করার গল্প। আবদুররাজাক গুরনা প্রায় সব উপন্যাসে, ছোট গল্পে সোহালী, আরব, হিন্দী, জার্মান আর ইংরেজী ভাষার উপমা, প্রবাদের ব্যবহার এবং ঔপন্যাসিক যোসেফ কনরাডের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। গুরনার নোবেলপ্রাপ্তি, উত্তর-উপনিবেশবাদী নাকি তার বিরুদ্ধবাদী তা নিয়ে ইতোমধ্যে বিতর্ক শুরু হয়েছে। সমালোচকদের মতে, গুরনারকে কোনভাবেই উত্তর-উপনিবেশবাদী প্রতিবাদী লেখক বলা যাবে না। তিনি যে আদতে উত্তর-উপনিবেশবাদী লেখক নন, সে প্রসঙ্গে আরও বলা হচ্ছে যে, তিনি নিজের মাতৃভাষায় লেখেন না। লেখেন উপনিবেশের ভাষা ইংরেজীতে। তিনি অভিবাসী হিসেবে ইংল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছেন। গুরনার ইংল্যান্ডে ইংরেজী সাহিত্য ও ভাষা পড়ান, তার নিজের ভাষা-সাহিত্য নয়। তিনি কথাও বলেন ইংরেজীতে। তিনি যেমন ‘আফটারলাইভস’-এ উপনিবেশবাদী শক্তি জার্মানির (উত্তর-উপনিবেশের নয়) সমালোচনা করেছেন, শেষে আবার ইউরোপের (যারা উপনিবেশ স্থাপন করেছিল) অবদানের কথা স্মরণ করে প্রশংসাও করেছেন। ৭৩ বছর বয়সী তানজানিয়ার এ অভিবাসী নাগরিক এখন বাস করছেন সাসেক্সে। সহযোগী সম্পাদক হিসেবে কাজ করছেন ওয়াসাফিরি পত্রিকায়। মা, মাতৃভূমি, মাতৃভাষা ও সোহালি এখনও তার স্মৃতিতে উজ্জ্বল। বিতর্ক, সমালোচনা কিংবা প্রশংসা সবই তার ঝুলিতে রয়েছে। ভবিষ্যতে সেইগুলো হয়ত বাড়বে, কিংবা হয়ত নতুন করে নির্মিত হবেন আবদুররাজাক গুরনাহ।
×