ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ ॥ মহাকাশের অনুসন্ধান

প্রকাশিত: ২১:২৯, ১৩ জানুয়ারি ২০২২

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ ॥ মহাকাশের অনুসন্ধান

অনেকেই বিজ্ঞানী গ্যালিলিও নামের সঙ্গে পরিচিত। তার চেয়ে পরিচিত প্রথম টেলিস্কোপ আবিষ্কারের সঙ্গে। যদিও গ্যালিলিও প্রথম টেলিস্কোপ আবিষ্কার কিংবা তৈরি করেননি। ১৬০৮ সালে ডাচ বিজ্ঞানী ঐধহং খরঢ়ঢ়বৎযবু যিনি ঔড়যধহহ খরঢ়ঢ়বৎংযবু নামেও পরিচিত, সর্ব প্রথম টেলিস্কোপ আবিষ্কার করেন। গ্যালিলিও ১৬০৯ সালে জনের তৈরি টেলিস্কোপটির উন্নতি করেন কেবল। চার শ’ বছর আগে যে বেসিক টেলিস্কোপের জন্ম, তা আজ বিশালতা ছড়িয়ে জন্ম দিয়েছে আরও জটিল, উন্নত টেলিস্কোপের। তারই একটি জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ। এটি এক ধরনের স্পেস টেলিস্কোপ। ১৯৪৬ সালে বিজ্ঞানী লেহম্যান স্পিৎজার সর্বপ্রথম বর্তমান স্পেস টেলিস্কোপের ধারণাটি দেন। যদিও স্পেস টেলিস্কোপের ধারণা বিজ্ঞানীদের মাথায় প্রথম আসে ১৯২৩ সালে। স্পেস টেলিস্কোপ দুই ধরনের হয়। একটি ধরন দিয়ে স্পেস ম্যাপ বা সার্ভে করা হয়। আরেকটি ধরন হলো স্পেসের কোন একটি পার্টকে একটি দূরত্ব পর্যন্ত দেখা হয়। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপটি স্পেসে রেখে স্পেসকে পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের একটি অবজারভেটরির টেলিস্কোপ। পৃথিবী থেকে তার নিয়ন্ত্রণ করা হয়। প্রথম স্পেস টেলিস্কোপ ছিল আমেরিকা কর্তৃক স্থাপিত ঙৎনরঃরহম অংঃৎড়হড়সরপধষ ঙনংবৎাধঃড়ৎু ২ বা সংক্ষেপে ঙঅঙ-২। ১৯৬৮ সালে এটি স্পেসে পাঠানো হয়। যুক্তরাষ্ট্র এটি তৈরি করে। কোন টেলিস্কোপ পৃথিবীতে স্থাপন করলে মহাকাশকে যত স্পষ্ট দেখা যায়, মহাকাশে টেলিস্কোপ রেখে আরও ভালভাবে দেখা যায়। কারণ, স্পেসের ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক রেডিয়েশন থেকে বেঁচে পৃথিবীতে আলো এসে পৌঁছানোর বিষয়টিতে মহাজাগতিক অনেক বাধা থাকে। মানুষের হাতে গড়া এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে শক্তিশালী টেলিস্কোপ জেমস ওয়েব টেলিস্কোপটি আকাশে ছোড়া হয় ২৫ ডিসেম্বর ২০২১। এটি বহন করে স্পেসে নিয়ে যায় অৎরধহব ঠঅ২৫৬ রকেট। অৎরধহব নাসা কর্তৃক তৈরি এক ধরনের স্পেশাল রকেট, যাতে দুটো রকেট থাকে এবং দুটো স্টেজের মধ্য দিয়ে স্পেসে উৎক্ষেপণের কাজ করে। লাঞ্চ করা হয় ফ্রেঞ্চ গায়ানার কড়ঁৎড়ঁ স্পেসপোর্ট থেকে। এর আগে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল হাবল স্পেস টেলিস্কোপ। হাবল স্পেস টেলিস্কোপটি মহাকাশে স্থাপন করা হয়েছিল ১৯৯০ সালে। এখনও পর্যন্ত এটি কাজ করে যাচ্ছে। বিজ্ঞানী এডউইন হাবলের নামানুসারে এটি করা হয়েছিল। ২.৫ মিটার দৈর্ঘ্যরে মিরর বসানো হাবল টেলিস্কোপটি জেমস টেলিস্কোপের আগে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় স্পেস টেলিস্কোপ হিসাবে গত ত্রিশ বছর কাজ করে যাচ্ছিল। নাসা বা ইউনাইটেড স্টেটসের ঘধঃরড়হধষ অবৎড়হধঁঃরপং ধহফ ঝঢ়ধপব অফসরহরংঃৎধঃরড়হ, ঊঝঅ বা ঊঁৎড়ঢ়বধহ ঝঢ়ধপব অমবহপু এবং ঈঝঅ বা ঈধহধফরধহ ঝঢ়ধপব অমবহপু যৌথভাবে জেমস স্পেস টেলিস্কোপটি তৈরি করেন। এটি তৈরি করতে ২০ বছরে ১৪ টি দেশের ২৫৮টি কোম্পানির ১০ হাজার বিজ্ঞানী এবং টেকনিশিয়ানের সাহায্য লেগেছে। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপটি এক ধরনের কড়ৎংপয টেলিস্কোপ। এতে দুটি মিরর থাকে। প্রাইমারি মিররটি বড় হয়, সঙ্গে সেকেন্ডারি ছোট একটি মিরর থাকে। ১৯৭২ সালে উরবঃৎরপয কড়ৎংপয এমন ধরনের টেলিস্কোপ প্রথম তৈরি করেন। এতে পূর্বের হাবল টেলিস্কোপের ইনফ্রারেড রেজ্যুলেশনকে আরও উন্নত করা হয়েছে। এই টেলিস্কোপে বসানো মূল মিরর বা আয়নাটি গওজও মিরি- গরফ-ওহভৎধৎবফ ওহংঃৎঁসবহঃ। এটি অনেক দূরে থাকা তারাগুলো থেকে আসা ক্ষীণ আলোকেও ধরতে পারবে। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের মূল আয়নাটি ১৮টি হেক্সাগনাল সেগমেন্টে ভাগ করা, মোট দৈর্ঘ্য ২১ ফুট ৪ ইঞ্চি। গোল্ড প্লেটেড বেরিলিয়াম উপাদান দিয়ে তৈরি আয়নাটি। হাবল টেলিস্কোপ ছিল ৭ ফিট ১০ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যরে মিরর। সব মিলে হাবল টেলিস্কোপের চেয়ে জেমস টেলিস্কোপ ছয়গুণ বেশি আলো সংগ্রহ করতে পারে। কেন জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ তৈরি করা হলো। নব্বই বছর আগে স্পেস টেলিস্কোপের প্রথম ধারণা এলেও ১৯৯০ সালের প্রথম শক্তিশালী হাবল টেলিস্কোপ ছিল বিজ্ঞানীদের প্রথম স্বপ্ন। কসমোলজির অনেক নতুন নতুন বিস্ময় বিজ্ঞানীদের হাতে এলো হাবল টেলিস্কোপের হাত ধরে। হাবল টেলিস্কোপ যেমন একটি নির্দিষ্ট সময়ে কার্যকরী থাকার সময়কাল নিয়ে যাত্রা করেছিল ত্রিশ বছর আগে, তেমনি এই সময়ের মধ্যে টেলিস্কোপের অনেক ধারণার উন্নতি এবং ইউনিভার্সের আরও গভীরে এবং আরও দূর পর্যন্ত গবেষণা এবং জানার প্রয়োজন দেখা দেয়। এরই প্রেক্ষিতে জেমস টেলিস্কোপের জন্ম। এটির মূল উদ্দেশ্য- ইউনিভার্স সম্পর্কে আরও বেশি জানা, ইউনিভার্সের উৎপত্তির কাছাকাছি সময়টিকে জানা, সেই সময়ে তারাগুলো এবং গ্যালাক্সি সম্পর্কে জানা, এমনকি প্রথম গ্যালাক্সি কি করে তৈরি হয়েছিল, তার রহস্য জানা। মিশন পিরিয়ড ১০ বছর। মেরিল্যান্ডে টেলিস্কোপটির মূল কন্ট্রোল সেন্টার। পাঠানোর তারিখ থেকে দশদিন পর প্রথমে দ্বিতীয় মিররটি ওপেন করা হয়েছে এবং তার দুইদিন পর মূল মিররটি ওপেনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। টেলিস্কোপটি বানাতে খরচ হয়েছে ১০ বিলিয়ন ডলার। যদিও শুরুতে বাজেট ছিল মাত্র ৫০০ মিলিয়ন ডলার। এটির মূল কাজ শুরু হয় ১৯৯৬ সালে, শেষ হয়েছিল ২০১৬ সালে। এটি আরও আগে উৎক্ষেপণের তারিখ ছিল, নানা কারণে পিছিয়েছে। আর তাতেই খরচ বিশগুণ বেড়ে যায়। এক সময় অর্থাভাবে আমেরিকান কর্তৃপক্ষ প্রকল্পটি বন্ধের হুমকি দিয়েছিল। এই টেলিস্কোপের নাম জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ নেয়া হয়েছে নাসার দ্বিতীয় এডমিনিস্ট্রেটর হেড ঔধসবং ঊফরিহ ডবনন-এর ১৯৬১ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত নাসার কাজের কৃতিত্বকে স্মরণে। ১৯৯২ সালে তিনি মারা যান। ২০০২ সালে প্রথম প্রস্তাব করা হয় নেক্সট স্পেস টেলিস্কোপের নাম হবে তার নামানুসারে। টেলিস্কোপটি যে পয়েন্টে রাখা হবে স্পেসে তার নাম- খধমৎধহমব ঢ়ড়রহঃ বা খ২, যেখানে গ্র্যাভিটেশন ফোর্সটি তুলনামূলক স্থির। এই পয়েন্ট পৃথিবী থেকে দেড় মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে। প্রতি দুইদিনে ২৮ গিগাবাইটের বেশি ডেটা পৃথিবীতে পাঠাবে টেলিস্কোপটি। এটি কাজ শুরু করতে ১ মাস লাগবে এবং ছয় মাস পর থেকে ডাটা পাওয়া শুরু করবে। টেলিস্কোপটি ১১০ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা সইতে পারে এবং - ২৩৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত ঠা-ায় কাজ করতে পারে। এটি তার মূল কাজ শুরু করতে গিয়ে ৩০০টি ভুলের সম্মুখীন হতে পারে! ঠিকমতো কাজ শুরু করতে ১৭৮টি মুভমেন্ট এবং মেকানিজম করতে হবে। হাবল টেলিস্কোপ দিয়ে ১৩.৪ বিলিয়ন বছর আগের আলো দেখা সম্ভব ছিল। কিন্তু জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ দিয়ে ১৩.৭ বিলিয়ন বছর আগের আলো দেখা সম্ভব। বিগ ব্যাঙ হয়েছিল ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে। তার মানে ইউনিভার্স শুরুর ১০০ মিলিয়ন বছর পরে যে প্রথম তারাটির জন্ম হয়েছিল, তার সম্পর্কে জানা সম্ভব হবে। সেই সঙ্গে প্রথম গ্যালাক্সি কিভাবে তৈরি হয়েছিল, তার উপরেও জানা যাবে। লেখক : চিকিৎসক ও বিজ্ঞান লেখক লন্ডন, ইংল্যান্ড [email protected]
×