ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বিদ্যালয়গামী ছাত্রীদের ঝরে পড়া

প্রকাশিত: ০০:১৭, ১১ জানুয়ারি ২০২২

বিদ্যালয়গামী ছাত্রীদের ঝরে পড়া

করোনার বহুল সংক্রমণে সবচেয়ে বেহাল অবস্থা জাতির মেরুদ- শিক্ষা কার্যক্রম। দেড় বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া কতখানি সম্ভব হয় সে বিচারের ভার সময়ের ওপরই ছেড়ে দেয়া। ৮ মার্চ ২০২০ সালে দেশে প্রথম করোনা শনাক্ত হলে সবার আগে বন্ধ করে দেয়া হয় শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক কর্মযোগ। সেই ১৭ মার্চ থেকে। যেদিনটি ছিল বঙ্গবন্ধু শেখঝ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষের শুভক্ষণ। একদিকে চরম ছোঁয়াচে এই রোগটির ক্রমাগত বিস্তারÑ অপরদিকে উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ সূচকের ওপর অবরুদ্ধতার কঠিন জাল ফেলা। প্রতিদিনের শিক্ষা কার্যক্রমের যে নিয়মিত শৃঙ্খলা সেখানেও আসে অযাচিত এক চরম স্থবিরতা। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় নিজের অবস্থান তৈরি করলেও হরেক রকম বিপর্যয় এখন অবধি কাঠামোর শিকড়ে গেড়ে বসে আছে। অবকাঠামোগত দৃষ্টিনন্দন উন্নয়নের পাশাপাশি মানসিক চেতনার যে অবধারিত বিকাশ সেখানে এখনও ভর করে আছে অপ্রত্যাশিত জড়তা। তার মধ্যে সমাজের অর্ধাংশ অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া নারীদের অবস্থা সবচেয়ে বিপজ্জনক। ‘জন্মই যার আজন্ম পাপ’Ñ এমন আপ্তবাক্য এখনও কন্যা সন্তানের পৃথিবীর আলো দেখায় ভর করে আছে। শুধু সরকারী কর্ম প্রচেষ্টায় সমাজের সব অভিশাপ দূরীভূত হয় না। ব্যক্তিক মনস্তাত্ত্বিক সচেতনতায় যদি মান্ধাতা আমলের অপসংস্কৃতি জড়িয়ে থাকে সেখানে নতুন সময় অবারিত হতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। আর অসহায় বালিকাদের বেলায় তা হয় পর্বত সমান বাধা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর উন্নয়ন দশক পার করে যুগপূর্তির মহাসম্মিলনে দেশকে যে মাত্রায় এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সেখানে সমানভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে পিছিয়ে পড়া নারীরাও। কিন্তু শ্রেণী বিভক্ত সমাজে শুধু বিত্তের ফাঁরাকই নয় তার চেয়েও বেশি লিঙ্গ বৈষম্যের যে অহেতুক নিপীড়ন তা থেকে মুক্তি সহজে মেলা আসলে কঠিনই। আর শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সমতায় অনেকখানি এগুলেও ২০২০-২১ সালের বিধ্বংসী করোনা কেমন যেন সব তছনছ করে দিল। ২০১৬-২০১৯ বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম সমতাভিত্তিক সমাজ নিবির্মাণে ১৫০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৪৭-৪৯তম অবস্থানে ওঠানামা করে। তবে দক্ষিণ এশিয়ায় একেবারে শীর্ষে। কিন্তু বিশ্ব কাতারে প্রাইমারি শিক্ষায় ছেলেমেয়ের জোরালো অবস্থানে বাংলাদেশ সবার অগ্রগামী। অর্থাৎ বর্তমান সরকার অন্তত প্রাইমারি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রী বৈষম্য নিরসনে অনেকটা সফল হয়েছিল। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর হরেক রকম কর্মদ্যোতনায়। গ্রাম-গঞ্জে, প্রত্যন্ত অঞ্চলের অবোধ বালিকাদের জন্য শেখ হাসিনার প্রয়োজনীয় অর্থ প্রদান সংশ্লিষ্টদের শিক্ষা কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করতে নির্ণায়কের ভূমিকায় নামে। বিশেষ করে হতদরিদ্র বালিকাদের জন্য উপবৃত্তিসহ আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে শিক্ষার মতো অনন্য উন্নয়নসূচক মনোযোগ দিতেও সক্ষমতার পরিচয় দেয়। যারই অবধারিত তথ্য উঠে আসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বার্ষিক প্রতিবেদনে। পরের সময়গুলো শুধু বাংলাদেশ নয় সারা বিশ্বে এক দুঃসহ ক্রান্তিকালের অনভিপ্রেত দুর্যোগ। শিক্ষা তার প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম বন্ধ করলেও প্রযুক্তির বিশ্বে পাঠদানের যে নতুন জগত উন্মোচন করে সেখানে সিংহভাগ ছাত্রছাত্রীই সম্পৃক্ত হতে ব্যর্থ হয়। বাংলাদেশ এখনও গ্রামনির্ভর কৃষি অর্থনীতির দেশ। আর বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই বাস করে প্রান্তিক এলাকায়। অনলাইন শিক্ষা যাদের জন্য কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। কারণ বেশিরভাগ দরিদ্র সন্তানের অনেকের ঘরে টিভি পর্যন্ত নেই। যাদের টিভি আছে তাদের বিদ্যুত ঘাটতির চরম অব্যবস্থাপনায় সংসদ টিভিতে যোগদানের অন্তরায় হয়েছে। আবার শহরাঞ্চলের সামান্য সংখ্যক যারা এই প্রযুক্তির বিশ্বে পাঠ গ্রহণের সুযোগ ছিল তাদের যথেষ্ট মনোযোগের অভাবে তারাও নতুন কার্যক্রমে অংশ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে যা হওয়ার তাই ঘটেছে। হতদরিদ্র পিতামাতা করোনার অসহনীয় সময়ে তাদের আয়-রোজগার কমে যাওয়ার সমূহ বিপাকে পড়তে এক প্রকার বাধ্যই হয়। যেহেতু বিদ্যালয়ের সরাসরি কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়নিÑ সেখানে তাদের জীবন ও জীবিকায় পড়ে দুর্বিষহ পালাক্রম। অবোধ বালিকারা পড়ে সেই চিরায়ত সামাজিক ব্যাধি বাল্যবিয়ের আবর্তে। আইন করে যা ঠেকানো সম্ভব হয়নি সেখানে করোনা কত সহজেই তাদের অপরিণত বিয়ের দিকে ঠেলে দিল। আর কচিকাঁচা বালকরা শিশুশ্রমে জড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি। আন্তর্জাতিক শিশু সংস্থা ইউনিসেফ বৃহত্তর এশিয়ার ওপর এক জরিপ চালিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে সেখানে এমন সব ভয়ঙ্কর তথ্য উঠে আসে। সেটারই অবধারিত অসহনীয় পরিণাম বিদ্যালয়গামী ছাত্রীদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। তা প্রকাশ পেতে থাকে ২০২১ সালে ১২ সেপ্টেম্বর যখন স্কুল খুলে দেয়া হয়। বোর্ড পরীক্ষায়ও বসতে পারেনি অনেক ছাত্রী। ক্লাসে অনুপস্থিতির সংখ্যায় ছাত্রীরাই বেশি এগিয়ে। তথ্য উপাত্ত খুঁজে বের করা হয় সিংহভাগ মেয়েরাই বিয়ে করে সংসার ধর্ম পালন করে যাচ্ছে। তাদের মূল শিক্ষা কার্যক্রমে আদৌ ফিরিয়ে আনা যাবে কিনা সেটাও ঘোর অন্ধকারে। এমনিতে বাপের বাড়িতেও কন্যা সন্তানদের বৈষম্যের আবর্তে ফেলা হয়। পাশাপাশি নিজের ভাইয়ের সঙ্গে তার অধিকারের মাত্রাও থাকে সীমিত। আর শ্বশুরবাড়ি কোন সুযোগ দেবে তা ভাবাও যায় না। অপরাজিতা প্রতিবেদক
×